সিলেট ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ২:৩১ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৭, ২০১৮
নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘ভোর ৬টার পর এসে আমাকে আর পাবে না তোমরা, আমি সকলকে ছেড়ে চলে যাব’—এই খুদে বার্তা স্বজনদের মুঠোফোনে পাঠিয়েছিলেন বৈশাখী ধর তৃপ্তি (২৭)। তাঁর কথাই সত্য হলো। সেই ভোরের পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপর তিনি লাশ হয়ে সুরমা নদীর জলে ভাসছিলেন। একসময় পরিচয়হীন এই লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরিবার যখন তাঁর খোঁজ পায়, তখন তিনি কবরে সমাহিত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কবর থেকে তোলা হয় সেই লাশ।
স্বামীর সোহাগে তুষ্ট ছিলেন না তৃপ্তি। অভিমানী তৃপ্তি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। ৫ দিন আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন তৃপ্তি। স্বামী, পিতা-মাতা হন্য হয়ে খুঁজেছেন তাকে। কিন্তু পাননি। অবশেষে গত বুধবার তৃপ্তির গলিত লাশ মিলল সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের সুরমা নদীতে।
তবে- এরই মধ্যে তৃপ্তির মৃত্যু নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে।
পুলিশ জোর দিয়ে বলছে- তৃপ্তি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু সুরমা নদীতে তৃপ্তি কীভাবে আত্মহত্যা করলো সেই প্রশ্নের কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
বৈশাখী ধর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি নিয়েছিলেন সিলেট রেলওয়েতে। রেলওয়ের ডাক বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। বিয়ে হয়েছিল ১০ মাস আগে। গত শনিবার গভীর রাতে বৈশাখী স্বামীর ঘর থেকে ওই খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলে বড় বোন ও বোনের স্বামীর কাছে। এরপর ভোর থেকে বৈশাখী নিখোঁজ ছিলেন।
বৈশাখীর স্বামী রিংকু চন্দ্র ধরের সঙ্গে তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার ভার্তখলার বাসায় থাকতেন। রিংকু সিলেট পল্লী উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচন ফাউন্ডেশনের সদর কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক।
বৈশাখী সিলেট সদরের বহরদাস পাড়ার পরিতোষ ধরের মেয়ে। ২১ এপ্রিল শনিবার গভীর রাতে খুদে বার্তা পাওয়ার পর বৈশাখীর বোন সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করে রিংকুর সঙ্গে। রিংকু তখন জানান, বৈশাখীর সঙ্গে তাঁর সামান্য ঝগড়া হয়েছিল, সেটি মিটমাট হয়ে গেছে।
বুধবার দুপুরে বৈশাখী ধরের লাশ পাওয়া যায় সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের পাশে সুরমা নদীতে। সুরমা নদী সিলেট থেকে সুনামগঞ্জে এসেছে। বৈশাখীর লাশ সুরমার জলে ভাসতে ভাসতে এসে লাগে দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের খাদ্যগুদামের ঘাটে। দোয়ারাবাজার থানা-পুলিশ লাশটি উদ্ধার করলেও পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি। পরে বেওয়ারিশ হিসেবে লাশটি বুধবার বিকেলে দাফন করা হয় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের মরাটিলা কবরস্থানে।
বৃহস্পতিবার পরিবারের লোকজন সুনামগঞ্জে একটি লাশ উদ্ধারের খবর পান। বয়স, পরনের পোশাক, শারীরিক গঠনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তারা সুনামগঞ্জে আসেন। সুনামগঞ্জে এসে নিশ্চিত হন লাশটি বৈশাখীর। এরপর কবর থেকে লাশ তোলার আবেদন করলে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লাশ তোলার অনুমতি দেন। সন্ধ্যায় বৈশাখীর লাশ নিয়ে পরিবারের লোকজন সিলেটে ফেরেন।
বৈশাখী ধরের ফুফাত ভাই রাশিন্দ্র চন্দ্র দে জানান, রিংকু ও বৈশাখী যে বাসায় থাকতেন সেটির ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসি) ফুটেজে দেখা গেছে, বৈশাখী ২২ এপ্রিল ভোট ৫টা ৪৯ মিনিটে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এরপর তাঁর কোনো খোঁজ মিলছিল না।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, পরিতোষ ধরের সঙ্গে কথা বলে এবং মেয়েটির ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়ার পরই লাশ কবর থেকে তোলার অনুমতি দেওয়া হয়।
বুধবার রাতেই বৈশাখীর বাবা রিংকু ধরের বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুরমা থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে একটি মামলা করেন। পুলিশ রাতেই রিংকুকে গ্রেপ্তার করেছে।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল ফজল মামলা ও গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলায় রিংকুর বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগও করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, লাশ উদ্ধারের পর পিতার মামলায় তৃপ্তির স্বামী রিংকুকে গ্রেপ্তার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু রিংকুর মুখ থেকে পাওয়া তথ্যের জোরালো যুক্তির হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। তৃপ্তির পুরো নাম বৈশাখী ধর তৃপ্তি। বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার দাশপাড়া গ্রামে। তৃপ্তির পিতা আশুতোষ ধর। আর তার স্বামী রিংকু ধর সিলেটের পল্লী বিমোচন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে মাস্টার্স পাস করা তৃপ্তি ছিলেন সিলেট রেলওয়ের মেইল বিভাগের কর্মকর্তা। এক বছরও হয়নি তৃপ্তি ও রিংকুর বিয়ের। দুই চাকরি জীবনও বেশি দিনের নয়। দুই বছর আগে তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে প্রায় ৮ মাস আগে সুখের সংসার পেতেছিলেন। বিয়ের পর রিংকু ও তৃপ্তি বাস করতেন দক্ষিণ সুরমার মাহবুব কমপ্লেক্সের ভাড়া বাসায়। দুই জনই চাকরিজীবী। সকাল থেকে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন।
বিকেলে তারা ঘরে ফিরতেন। বিয়ের পর ভালই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু প্রায় দুই মাস আগে রিংকু ও তৃপ্তির মধ্যে মনোমানিল্য দেখা দেয়। চাকরিতে ব্যস্ত থাকায় তৃপ্তি স্বামী রিংকুকে ততটা সময় দিতে পারতেন না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। সাংসারিক জীবনে কিছুটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসেরও সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে তাদের সংসারে প্রায় সময়ই ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকতো।
এমনকি মাঝে মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ থাকে। রিংকু ও তৃপ্তির পরিবারের সদস্যরা এসে তাদের বিবাদ প্রায় সময় মিটিয়ে দিয়ে যান। শনিবার সকালে প্রতিদিনের মতো দক্ষিণ সুরমার মাহবুব কমপ্লেক্সের বাসা থেকে বের হয়ে যান বৈশাখী ধর তৃপ্তি। বাসা থেকে বের হওয়ার দিন দুপুর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এরপর স্বামী ও পিতার পরিবারের সদস্যরা হন্য হয়ে তৃপ্তিকে খুঁজতে থাকেন। এ ঘটনায় রোববার সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় তৃপ্তির স্বামী রিংকু ধর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানায় স্ত্রী নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি করেন। পাশাপাশি তারা রিংকুকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু পরিচিত জন কিংবা আত্মীয় স্বজনের বাড়ি- কোথাও যায়নি তৃপ্তি। গত বুধবার দুপুরে খবর আসে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারের সুরমা নদীতে এক মহিলার লাশ ভাসছে। খবর পেয়ে তৃপ্তির স্বামী ও পিতার বাড়ির সদস্যরা গিয়ে তার লাশ শনাক্ত করেন। তৃপ্তির শরীর গলে গেছে। মুখ কিছুটা বিকৃত। পরিবারের সদস্যরা লাশ শনাক্ত করার পর তৃপ্তির মরদেহ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
এদিকে- তৃপ্তির বাবা আশুতোষ ধর বাদী হয়ে তার স্বামী রিংকুর বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুরমা থানায় মামলা করেছেন। মামলায় রিংকুর বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলার প্রেক্ষিতে গত বুধবার বিকালে তৃপ্তির স্বামী রিংকু ধরকে দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বৈশাখী ধর তৃপ্তির মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে পুলিশ রাতভর থানায় রেখে রিংকুকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। পুলিশ তৃপ্তির পিতার দায়ের করা মামলায় রিংকুকে আদালতে হাজির করে। আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল জানিয়েছেন- বৈশাখী ধর তৃপ্তি নিজ থেকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ- তৃপ্তি নিখোঁজের খবর জানার পর পুলিশ মাহবুব কমপ্লেক্সে যায়।
সেখানে সিসিটিভির ফুটেজ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে নিখোঁজের দিন শনিবার তৃপ্তি একাই বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে আর কেউ ছিল না। এ ছাড়া নিখোঁজের আগের দিন তৃপ্তি তারা মা-বাবাকে মোবাইল ফোনে জানিয়েছিল, আমার আশা ছেড়ে দেও তোমরা। আমাকে পাইবা না। আমি আত্মহত্যা করবো।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd