পা হারালেও স্বপ্ন মরেনি রুবিনার, খুঁজছেন ভরসা

প্রকাশিত: ১:৪৩ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৮

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : কথার শুরুতেই ছোট ভাইয়ের জন্য আক্ষেপ করেন রুবিনা। কাঁপা গলায় বলেন, ‘আমার এখন কী হবে জানি না। ছোট ভাইটিকে নিয়ে বেশি চিন্তা হয়। আমার মতো কষ্ট করলে ও পড়বে কিভাবে। আমি বিসিএস দিতে চাই। শিক্ষা ক্যাডার হতে চাই। এখন কি পারব, ভাইয়া।’ বলেই রুবিনা তাকিয়ে থাকেন। তাঁর চোখে অসহায়ত্ব। পাশেই বসে থাকা রুবিনার মা রহিমা বেগম আঁচলে মুখ লুকিয়ে চোখের পানি মুছছিলেন। বললেন, ‘আমাক লক্ষ্মী মাইয়াডা না খাইয়া চিন্তায় শেষ হইয়া গেলো। লেখাপড়ায় ভালা। নিজেরাই খরচ জোগাড় করে। এখন আর পারতাছিল না। ও আমাক আশা-ভরসা। আর হেই মাইয়ার দুই পা কাইটা গেলো। এখন কী হইবো।’

রুবিনা খাতুন (২৩)। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারের (চতুর্থ বর্ষ) ছাত্রী। গত ২৮ জানুয়ারি কমলাপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তাঁর দুটি পা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডের ২৬ নম্বর শয্যায় গিয়ে দেখা যায় কাতরাচ্ছেন রুবিনা। রুবিনা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে নিশ্চিত হওয়া গেছে, হতাশা ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেললাইনে পড়ে গিয়েছিলেন রুবিনা। শেষ মুহূর্তে ট্রেন দেখলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। তবে রুবিনাকে এভাবে থেমে যেতে দিতে চান না সহপাঠীরাও। দরিদ্র মেধাবী মেয়েটির উন্নত চিকিৎসা ও কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য সমাজের সামর্থযবান ব্যক্তিদের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা পালাক্রমে সেবা-যত্নও করছেন। শিক্ষকরাও বারবার এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন।

রহিমা জানান, তাঁদের বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানার শানি্তনগর গ্রামে। স্বামী রবিউল ইসলাম ছিলেন দিনমজুর। সাড়ে তিন বছর আগে তিনি মারা যান। এরপর গবাদি পশু পালন করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছিলেন তিনি। তাঁদের বড় মেয়ে জুলেখা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। ছেলে রুবেল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষে পড়ছে। ছেলে-মেয়েরা টিউশনি করে এবং বৃত্তির টাকায়ই লেখাপড়া করছিল।

রুবিনা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামছুজ্জামানের অধীনে চিকিৎসাধীন। ডা. শামছুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মেয়েটির দুটি পা-ই হাঁটুর কাছ থেকে কেটে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্ত দেওয়ার পর এক অবস্থা স্থিতিশীল। দুটি পায়ে ড্রেসিং ও অস্ত্রোপচার করে ঘা শুকিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। এ চিকিৎসায় আমাদের কাছে কমপক্ষে এক মাস যাবে। এরপর তিন-চার মাস লাগবে প্রতিস্থাপন বা পুনর্বাসনসংক্রান্ত চিকিৎসায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘কৃত্রিম পা হলে মেয়েটি তাতে ভর করে হাঁটতে পারবে। চিকিৎসাটি ব্যয়বহুল। তবে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ফাইবারের ভালো পা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও আমরা যোগাযোগ করছি। আর্থিক সহায়তা পেলে মেয়েটিকে পুনর্বাসন করা সম্ভব।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবুল হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে রুবিনা তার আজকের অবস্থান নিশ্চিত করেছে। একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়ে তারা দুই ভাই-বোন মেধার স্বাক্ষর রেখে দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এখন পর্যন্ত রুবিনার ফলাফল অত্যন্ত ভালো। একটি দুর্ঘটনায় মেয়েটি আজ সবার সাহায্যপ্রার্থী। সবাই চষ্টো করলে আমরা হয়তো তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারব।’ রুবিনার সহপাঠী ইমাম হোসেন বলেন, ‘ওকে আমরা থেমে যেতে দিতে চাই না। সমাজের সামর্থ্যবানদের সহায়তা পেলে রুবিনা হাঁটতে পারবে। সংসারের হালও ধরতে পারবে।’

রুবিনার জন্য ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নয়াবাজার ব্রাঞ্চের সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ১৩৬১৫১৭৪৩৪৪, মো. আবুল হোসেন ও মোসা. রুবিনা খাতুন, অ্যাকাউন্টে সহযোগিতা পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিভাগীয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে ০১৯৩৯০৫০৯৬৬ এই ফোন নম্বরে।

রুবিনা কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি স্থানীয় বিনয়পুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে এসএসসি এবং কালীগঞ্জ মহাবিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ঢাকায় থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার জন্য ডাচ&-বাংলা ব্যাংকের মাসিক আড়াই হাজার টাকার শিক্ষাবৃত্তি পান তিনি। গত ডিসেম্বর মাসে ওই বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। বোনের মতোই ফলাফল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায় রুবেল। রংপুরে থেকে লেখাপড়া করা ভাইকে মাঝেমধ্যে টাকা দিতেন রুবিনা। দুটি টিউশনি করে পাওয়া এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে কতই বা দেওয়া যায়!

রুবিনা বলেন, বৃত্তি শেষ হওয়ার পর কিভাবে চলবেন বুঝতে পারছিলেন না তিনি। এপ্রিলে ফাইনাল পরীক্ষা। তাই বেশি টিউশনিও করা যাবে না। এ নিয়ে হতাশায় পড়ে যান। একসময় বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বাড়ি যাওয়ার পথে রেললাইন অতিক্রম করছিলেন তিনি কমলাপুরে। এ সময় কিভাবে তিনি পড়ে গেলেন এবং ট্রেনে কাটা পড়লেন, তা বুঝতে পারছেন না এখনো।

রুবিনা জানান, তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সমাজকর্ম বিষয়টি পাওয়ার কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেন। স্বপ্ন দেখতেন বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার হবেন।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

February 2018
S S M T W T F
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
2425262728  

সর্বশেষ খবর

………………………..