সিলেট ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৯শে শাবান, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১০:২২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৯
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : তিনি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। চড়েন হাসপাতালের গাড়িতে, থাকেন মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডে নিজের আলিশান ফ্ল্যাটে। নিজের নামে ছাড়াও স্ত্রী ও স্বজনদের নামে বিপুল সম্পদ গড়ে দিয়েছেন তিনি। একেবারে শূন্য থেকে বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া এই তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর নাম আবু সায়েম মোহাম্মদ এমদাদুল হক সাদেক। বর্তমানে কাজ করছেন শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্স (এনআইএনএস) হাসপাতালে। মাত্র ৮ বছরের চাকরি জীবনেই কোটিপতি বনে যাওয়ার এমন ম্যাজিক দেখিয়েছেন তিনি। তবে তার পেছনে রয়েছেন প্রভাবশালী মামা। অভিযোগ রয়েছে, মামার খুঁটির জোরেই তিনি বেপরোয়া।
তোয়াক্কা করেন না হাসপাতালের সিনিয়র কর্মকর্তাদেরকেও। এ নিয়ে অনেকে ক্ষুব্ধ হলেও ভয়ে মুখ খোলেন না কেউ।
সূত্র জানায়, ২০১০ সালে নিউরোলজি বিশেষায়িত হাসপাতাল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট নিউরো সায়েন্স চালু হয়। এর আগে এটি একটি প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত হতো। পরিচালক একজন হিসাবরক্ষক, একজন প্রজেক্ট এসিস্ট্যান্ট, একজন পিয়ন ও একজন আয়াসহ ৫-৬ জন ওই প্রজেক্টের অধীনে কাজ করতেন। তবে হিসাবরক্ষক আবু সায়েম মোহাম্মদ এমদাদুল সাদেক ছিলেন প্রজেক্টের সর্বেসর্বা।
অভিযোগ রয়েছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে সাদেকের ভাগ্যোন্নয়ন শুরু হয়। ওই সময় তিনি লক্ষ লক্ষ টাকার ভুয়া ভাউচার তৈরি করে বিল উত্তোলন করেন। টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেন। এর বিনিময়ে হাতিয়ে নেন কোটি টাকা। নিজ এলাকা গাইবান্ধার সাঘাটায় বিঘার পর বিঘা জমি ক্রয় করেন। বোন জামাইকে এলাকায় পাট ও তেলের ব্যবসায় নামান। কিনে ফেলেন ট্রাক। যেখানে একটি টিনের চালা ছিল, সেখানে তোলেন পাকা দালান। মাত্র ৬ হাজার টাকার প্রজেক্ট কর্মচারী হয়ে ওঠেন কোটিপতি।
২০১২ সালে প্রজেক্ট শেষ হয়ে রাজস্বে আসে। যেহেতু সাদেকের সরকারি চাকরির বয়স শেষ, তাই নিয়ম ভেঙে চাকরিবিধি তৈরি করা হয়। প্রকল্পের চাকরিজীবীদের বয়স শিথিল করে মন্ত্রণালয়ের যোগসাজশে অ্যাকাউন্টস্ অফিসার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার দু’টি পদ সৃষ্টি করা হয়। সাদেককে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এ পদটি ২য় শ্রেণির, যা নিয়োগ হয় পিএসসি’র মাধ্যমে। তাই বেতন স্কেল কমিয়ে করা হয় ৩য় শ্রেণির। এতে নিয়োগ চলে যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে। এরপরে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাদেক। তার গ্রামের কমপক্ষে ৫০ জনকে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেন। এ ছাড়া সরকারি জেলা কোটা ভেঙে ১০-১২ জন কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয় তার এলাকা থেকেই। মূলত হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণে রাখতেই এই ব্যবস্থা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাদেকের রয়েছে মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের মতো জায়গায় ১৪৫০ বর্গফুটের দু’টি ফ্ল্যাট। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। রাজধানীর আগারগাঁয়ে কয়েকজন মিলে তৈরি করছেন ১০ তলা একটি ভবন। ব্যাংকে রয়েছে এফডিআর। বউয়ের নামে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ৫০ লাখ টাকার এফডিআর। ছোট ভাইয়ের নামেও একইভাবে ব্যাংকে রয়েছে এফডিআর ও সঞ্চয়পত্র। বউ আর মেয়ের নামে নিজ গ্রামে ক্রয় করেছেন কয়েক একর জমি। রাজশাহীতে রয়েছে কয়েক একরের আম বাগান।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, নামমাত্র মেরামত দেখিয়ে তিনি হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। বিভিন্ন অর্থবছরের প্রজেক্ট থেকে কেনা ভারী মেশিনগুলোর ফাইল তিনি কাউকে দেন না। সেগুলো রেখেছেন তার নিজ গ্রামের নিয়োগকৃত লোকের কাছে। অন্য কেউ চাইলেও সেগুলো পান না। অনেক ফাইল অডিট করিয়ে গায়েব করে ফেলেছেন। মেশিন মেরামত বিভাগেও বসানো হয়েছে তার নিজ গ্রামের লোক। কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সেখান থেকে তুলে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ।
বর্তমানে বেশ কয়েকটি কোম্পানির সঙ্গে তার রয়েছে মালিকানাধীন সম্পর্ক। নামসর্বস্ব কোম্পানির কাছ থেকে প্রডাক্ট কিনে বিল ভাউচার দেখিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট করেন।
সূত্র জানায়, সরকারি গাড়ির বরাদ্দ দেন তিনি নিজেই। সরকারি কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা গাড়ি না পেলেও তার বাসার লোকজন, আত্মীয়স্বজন এসব গাড়ি ব্যবহার করেন নিয়মিত। এসব গাড়ির তেল ও জেনারেটরের তেলও বরাদ্দ দেন তিনি। ফলে এখানেও রয়েছে তার দুর্নীতির বিশাল ক্ষেত্র। ব্যবহার না করেও ব্যবহার দেখিয়ে তিনি এবং তার সহযোগী ইকবাল প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা তুলে নেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতাল প্রজেক্টের অনেক জিনিসপত্র তার বাসায় ব্যবহার করেন। এরমধ্যে রয়েছে ফ্রিজ, মাইক্রো ওভেন, এসি, ক্যামেরা, ল্যাপটপ, ভিডিও ক্যামেরা, রয়েছে হাসপাতালের স্টিলের ফার্নিচারও। যেগুলো ট্রাকে করে তার গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। এগুলো তিনি মেশিনের সঙ্গে টেন্ডারে যোগ করে দিতেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহের পর সুযোগ বুঝে নিজের লোক দিয়ে বাসায় নিয়ে যান। এ ছাড়া হাসপাতালের চেয়ার, টেবিল, আলমারি তার বাসায় ব্যবহার করা হচ্ছে। হাসপাতালে তার বিশ্বস্ত কিছু লোকজনকে ম্যানেজ করে তিনি এসব জিনিস বাসায় নিয়ে গেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভাউচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা, আরএফকিউ পদ্ধতিতে কোটেশন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৫ লাখ, এলটিএম পদ্ধতিতে জরুরি কিন্তু নিবন্ধিত কোম্পানিদের মধ্যে থেকে কোটেশন বিজ্ঞপ্তির টেন্ডার দিয়ে নিম্ন দরদাতার কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ এবং তার বেশি মূল্যের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী উন্মুক্ত টেন্ডার দিয়ে হাসপাতালের মালামাল ক্রয় করার নিয়ম। কিন্তু ক্রয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় থাকা সত্ত্বেও যথাযথ নিয়ম মানা হয় না।
একটি মাত্র কোম্পানিকে দিয়ে এমএসআর সামগ্রী এবং ওষুধ ক্রয় করা হয়েছে দুই কোটি টাকার উপরে। কেনাকাটায় নামে-বেনামে কোম্পানি তৈরি করে ক্রয় করা হয়েছে লাখ লাখ টাকার মালামাল। এলটিএম-এর মাধ্যমে নিবন্ধিত কোম্পানির কাছ থেকে কোটেশনের মাধ্যমে ক্রয়ের বিধান থাকলেও এনআইএনএস হাসপাতাল আজও পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধিত করেনি। বিনা টেন্ডারে প্যাডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি কোম্পানির প্যাড ব্যবহার করে কেনাকাটা করা হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকার নন ইডিসিএল ওষুধ। এমনকি টেন্ডারের মাধ্যমে ২০১২-১৩ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নামমাত্র মূল্যে পয়সার হিসাবে যেসব ওষুধ ক্রয় করা হয়েছে, তা বিনা টেন্ডারে কেনা হয়েছে কয়েকগুণ বেশি দামে।
হাসপাতালের এ সিন্ডিকেটটি গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে টেন্ডারের মাধ্যমে ফার্নিচার ক্রয় করে। টেন্ডারে সম্পূর্ণ কাঠের ফার্নিচার ক্রয়ের কথা থাকলেও হাসপাতালে সরবরাহ করা হয় বোর্ডের। এসব বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হাসপাতালের এসব অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ইতিপূর্বে নামে-বেনামে একাধিক চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে সেসব অভিযোগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে আবু সায়েম মোহাম্মদ এমদাদুল হক সাদেকের বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি তার অফিসের ল্যান্ড ফোনেও পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সস ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বলেন, সাদেক যদি কোনো দুর্নীতি করে থাকে তবে তা দুদককে জানান। তারাই খুঁজে বের করবে তার এত সম্পদ কোথা থেকে এসেছে। তিনি আরো বলেন, তার কারণে যারা দুর্নীতি করতে পারে না, তারাই হয়তো আপনাকে তথ্য দিয়েছেন। সাদেক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচালক সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, সে অনেকের চেয়ে ভালো। তবে তার সম্পদের কথা দুদককে বলেন। তারা অনুসন্ধান করবে
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd