বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তার বরাবরে লেখা একটি দরখাস্ত বুধবার বিকালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন ডিস ব্যবসায়ী থেকে তারকা বনে যাওয়া হিরো আলম।
‘হামলাকারীদের বিচার চাই’ শিরোনামে ওই খোলা চিঠিতে বগুড়ার আলোচিত এই স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজেকে একজন নিরীহ, অসহায় ও গরীব ঘরের সন্তান উল্লেখ করে ভোটের দিন তার সঙ্গে যারা অন্যায় আচরণ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের বিচার চেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠিতে হিরো আলম যা লিখেছেন তা পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আপনার কাছে আমি গরিব হিরো আলম খোলা চিঠি লিখছি। আমি নিরীহ এবং খুব সাধারণ গরিব ঘরের সন্তান, এক দুঃখী মায়ের ছেলে। আমি স্বপ্ন দেখি, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টাও করি। এগিয়ে যেতে চাই আমার মনোবল দিয়ে। চানাচুর বিক্রেতা থেকে আচার বিক্রেতা ছিলাম। সিডি আলম থেকে ডিস আলম, এরপর নিজের প্রচেষ্টায় হিরো আলম হতে পেরেছি। মানুষের ভালবাসায় আর মিডিয়ার সহযোগিতায় আজ আমি হিরো।
কারো প্ররোচনায় নয়, নিজের মনোবল থেকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৯ বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) সংসদীয় আসনে প্রার্থী হবার জন্য মনোবল অটুট ছিল। মহাজোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় পার্টির মনোনয়নপত্র কিনেছিলাম। কারণ, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে আমার এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছে জাতীয় পার্টির সরকার। আমার এলাকার জনগন পল্লীবন্ধু এরশাদের উন্নয়নের কথা আজও বলেন। এই জন্যই জাতীয় পার্টির মনোনয়ন কিনেছিলাম। মনোনয়ন নেয়ার পর থেকে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসি আমি। জাতীয় পার্টি হয়তো আমাকে যোগ্য মনে করেনি, তাই হয়তো দলীয় মনোনয়ন আমাকে দেয়া হয়নি। এতে আমি হতাশ হয়নি, কারণ জাতীয় পার্টির মনোনয়ন যাচাই বাছাইয়ে বগুড়া-৪ আসনে অনেকের মধ্যেও আমি ২য় ছিলাম। আমি তারপরেও মনোবল অটুট রেখে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করি। এরপর নানাভাবে আমি হয়রানির শিকার হয়েছি। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট থেকে বৈধতা নিয়ে বগুড়া-৪ আসনে ‘সিংহ’ প্রতীক নিয়ে ভোটযুদ্ধে অংশগ্রহন করি। শুরু থেকেই মিডিয়া আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে।
ভোটের মাঠে প্রচার প্রচারণায় ভোটারদের আলোচনায় এসেছিলাম। এই আসনের সব প্রার্থীর চেয়ে আমি জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিলাম। ভোটের কয়েকদিন আগে বগুড়া-৪ আসনের কাহালু উপজেলা ও নন্দীগ্রাম উপজেলা এলাকার বিভিন্ন জায়গায় আমার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে দুবৃত্তরা। ওই দুবৃত্তরা কখনো আওয়ামীলীগ, আবার কখনো বিএনপির নাম ভাঙিয়ে এসব করেছে। আমার নির্বাচনী অফিসও ভাংচুর করেছে। আমি অনেক কষ্টে রোজগারের টাকায় নির্বাচনে অংশ গ্রহন করি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আমি খোলা চিঠির মাধ্যমে আপনার কাছে বিচার দিচ্ছি। আমার সাথে অন্যায় হয়েছে। অন্যায়কারীদের বিচার চাই।
‘এরপর ৩০ ডিসেম্বর ভোটের দিন।’
আমার ‘সিংহ’ প্রতীকের এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয়া হয়েছে। যেসব এজেন্ট কেন্দ্রে গিয়েছিল, তাদের বের করে দেয়া হয়। নন্দীগ্রাম ও কাহালু উপজেলার ভোটকেন্দ্র গুলোতে ভোটারদের কাছ থেকে জোর করে প্রকাশ্য ভোট নেয়া হয়েছে। অধিকাংশ কেন্দ্রে গিয়ে দেখেছি ব্যালট পেপার নেই। অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেননি। আমি অবাক হয়ে যাই, হতাশ হয়ে যাই বাস্তব চিত্র দেখে। দখলে থাকা কেন্দ্রের দুবৃত্তরা কেউ বলে ‘তারা নৌকার লোক’, কেউ বলে ‘তারা ধানের শীষের লোক। ভোট কেন্দ্র দখল করে দুবৃত্তরা ইচ্ছেমত নিজেদের প্রতীকে সীল মারছিল। আমি বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়েছি, কিন্তু আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ধাক্কা দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।
ভোটের দিন বেলা সাড়ে ১০টার দিকে নন্দীগ্রাম উপজেলার চাকলমা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখি একই চিত্র। সেখানে পুলিশ ছিল মাত্র একজন। রাস্তায় আর কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহীনির সদস্য আমার চোখে পড়েনি। আমি বলছিলাম, ভোটারদের ভোট দিতে দিন। ভোট কেন্দ্রে বহিরাগত কেউ থাকবেন না। এখানে কেউ থাকলে আমি অভিযোগ করব। এই কথা বলতেই চাকলমা গ্রামের শাহজাহান আলী, সুইট, রতন, মানিক, নন্দীগ্রাম সদরের রইচ উদ্দিন, কৈগাড়ী গ্রামের মেয়াজ্জেম সহ অন্তত ১৫/২০ জন লোকজন আমার ওপর হামলা করে বেধরক মারপিট করে।
এসময় আমার সাথে থাকা কর্মীদের সহ কয়েকজন সাংবাদিককে লাঞ্চিত করে ওই সন্ত্রাসীরা। উপস্থিত শতশত ভোটার অবাক হয়ে দেখছিল। দুবৃত্তদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছিল। আতঙ্কে সাধারন জনগন ছোটাছুটি করছিল। একজন পুলিশ ছিল, যে কারণে হয়তো তিনি আমাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসার সাহস পাননি। আমার সাথে সাথে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন সময়ের কন্ঠস্বর ও জাতীয় দৈনিক ভোরের ডাকের রিপোর্টার নজরুল ইসলাম। তাঁর কাছ থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়ার জন্য সন্ত্রাসীরা টানাটানি করে ব্যর্থ হয়ে নববার্তার বগুড়া প্রতিনিধি রাসেল এর কাছ থেকে একটি ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়।
আমার ব্যক্তিগত ক্যামেরা পারসনের কাছ থেকে একটি ভিডিও ক্যামেরা ও আমার কাছ থেকে দুটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়েছে ওই সন্ত্রাসীরা। আমাদের মারধর করে ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। আমার ওপর হামলার ঘটনার একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যা গণমাধ্যমেও প্রচার হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আপনি দেখুন। কীভাবে একজন প্রার্থীর ওপর ন্যাক্কারজনক হামলা করা হয়েছে ! সন্ত্রাসীরা আপনার দলের নাম ব্যবহার করে আপনার সুনাম খুন্ন করেছে। ভিডিওতে দেখুন, ওরা বলছে, তাঁরা আওয়ামীলীগের লোক। ওরা আপনার দলের নাম বলেছিল বলেই আমি প্রেস ব্রিফিং এ আপনার দলের নাম বলেছি। এজন্য আমি দু:খিত এবং অনুতপ্ত।
প্রিয় জননেত্রী,
আমার ওপর সন্ত্রাসীর হামলার পরপরই স্থানীয় প্রশাসনের সাথে একাধিকরার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাশে পাইনি। ভোটের দিন দুপুরে আমি সাংবাদিকদের ব্রিফিং করে ভোট বর্জনের ঘোষনা দেই। পরে বগুড়ার রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের সাথে সরাসরি ভোট বর্জন করে একটি লিখিত অভিযোগ করেছি। ভোটের পরে দুই দিন পার হয়ে গেছে। তারপরেও হামলার ঘটনায় কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি প্রশাসন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা,
আপনার কাছে আমি হিরো আলম খোলা চিঠির মাধ্যমে বিচার দিচ্ছি। হামলাকারী যেই হোক, এরা আপনার দলের হতেই পারে না। যারা সত্যিকারের দল করে এবং দলকে ভালবাসে, তারা কখনো দলের নাম ব্যবহার করে হামলা করতে পারে না। ওরা সন্ত্রাসী। যারা আওয়ামীলীগ ও ইসির নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তাদের বিচার করুন। যারা আমারমত সাধারণ গরিব নিরিহ প্রার্থীর ওপর হামলা করেছে, ভিডিও চিত্র দেখে দেখে তাদেরকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি করছি। সেই সাথে সাংবাদিকের ক্যামেরাসহ ছিনতাইকৃত মোবাইল ফোন ও ভিডিও ক্যামেরা উদ্ধারের অনুরোধ করছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আমি কার কাছে যাব। মায়ের কাছেই সন্তানেরা বিচার দেয়। কষ্টের কথাগুলো মায়ের কাছেই বলে। আমি গরীব মায়ের গরীব ছেলে। আমার আবেকভরা কথাগুলো আপনার কাছে তুলে ধরলাম।
ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন।
ইতি/নিবেদন
অসহায় আশরাফুল হোসেন আলম (হিরো আলম)
উল্লেখ্য, বহুল আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের স্বপ্ন ভেঙে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে জয়ী হয়েছে বিএনপির প্রার্থী মোশারফ হোসেন।
এই আসনের মোট ১০৫টি ভোটকেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির প্রার্থী মোশারফ হোসেন পেয়েছেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৭২২ ভোট ও নৌকা প্রতীক নিয়ে মহাজোট প্রার্থী জাসদের রেজাউল করিম তানসেন পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৬৭৯ ভোট। আর ভোট বর্জন করা হিরো আলম পেয়েছেন ৬৩৮ ভোট।