গোয়াইনঘাটে হিদাইরখাল এখন মরণফাঁদ

প্রকাশিত: ৬:২০ অপরাহ্ণ, জুন ২৩, ২০১৮

গোয়াইনঘাটে হিদাইরখাল এখন মরণফাঁদ

গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি :: সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সারীর মোহনায় বিতর্কিত ও অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের ফলে পরিবেশগত ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে। অপরিকল্পিত এই বাঁধটি শুধু কৃষি আবাদ কিংবা যাতায়াত ব্যবস্থাই ধ্বংস করছে না, পুরো এলাকার মরণফাঁদ পরিণত হয়েছে।

উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের সানকীভাঙ্গা হাওর, আসামপাড়া, আসামপাড়া হাওর, চৈলাখেল ৯ম খণ্ড, চৈলাখেল ৮ম খণ্ড, বাউরভাগ হাওর, নয়াগাঙ্গেরপার (একাংশ), আলীরগাঁও ইউনিয়নের কাকুনাখাই খলা, রাজবাড়ী কান্দি, বুধিগাঁও হাওর, নাইন্দা হাওর, তিতকুল্লী হাওর, লাম্বাডুবা হাওর, বালির হাওর এবং জৈন্তাপুর উপজেলার বিড়াখাই, হাটিরগ্রাম, গাথি, ডুন্ডীরপার, সাতলারপার, শেওলারটুক, মল্লিফৌদ, কান্দি, বাউরভাগ, কৈনাখাই, ভিত্রিখেল, গুফরাজান, খাড়–বিল, ববরবন্দ, লামনীগ্রাম, কাটাখালসহ দুই উপজেলার শতাধিক গ্রামের অগণিত রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ী, ফসলী জমি রক্ষা করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

অর্ধশতাধিক বছর আগে নির্মিত পুরনো পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধসহ অত্রাঞ্চলের অগণিত ফুটব্রীজ, রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গিয়ে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। হিদাইরখালের ভয়াবহতার কারণে অত্রাঞ্চলের মানুষজন কৃষি আবাদ, যাতায়াত এবং গৃহপালিত গবাদি পশু পালনে প্রতিবন্ধকতাও দেখা দিয়েছে।

সরেজমিন শনিবার (২৩ জুন) পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলসহ দুর্ভোগ পোহানো মানুষজনের বাড়িঘর পরিদর্শনকালে ফুটে উঠে এর বাস্তব দৃশ্যপট।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে জানা যায় যে, বছর খানেক আগে আলীরগাঁও ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে প্রমত্তা সারী নদীর উপকণ্ঠে পানি প্রবাহমান একটি শাখা নদী মাটি দিয়ে ভরাট করে একটি বিতর্কিত বাঁধ নির্মাণ করা হয়। হিদাইরখাল (বাউলীখাল) নামক উক্ত বাঁধই এখন অত্রাঞ্চলের বিষফুড়ায় পরিণত হয়েছে।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে জনদুর্ভোগের শিকার মানুষজন জানান, সুদীর্ঘ কাল থেকে আমরা ডাউকী পিয়াইন নদীর পানির দ্বারা বন্যাক্রান্ত হতাম। পাহাড়ি ঢল নেমে আসলে ঘণ্টা দু’এক কিংবা দু’একদিন অবস্থান করে সে পানি নেমে যেত। কিন্তু উক্ত হিদাইরখাল বাঁধ তৈরির ফলে এখন আর সারী উপকণ্ঠের পানির প্রবাহের পথ বন্ধ হওয়াতে সেই পানি নামছে না এবং এটা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরজমিনকালে দেখা যায় যে, ৩৫ বছর পুরনো পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত জাফলং-সানকীভাঙ্গা বেড়িবাঁধ-কাম-রাস্তায় বিভিন্ন স্থানে পানি ফুলে তা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে। স্থানে স্থানে বড় বড় গর্ত, খানাখন্দ অবস্থা সৃষ্টি হওয়াতে জনসাধারণ, যানবাহন চলাচলে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সানকীভাঙ্গা দক্ষিণপাড়ায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে সারী নদীর হিংস্রতায় ভেঙ্গে গেছে বিশাল এলাকা। সেখানে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কর্তৃক বাঁশ এবং কাঠ দ্বারা আড়া দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এলাকাবাসী জানান, একটু ভারী বর্ষণ কিংবা উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি বাড়লেই অত্রাঞ্চলের সব’কটা বাড়িঘরই পানিবন্দী হয়ে পড়ে। পানির তুড়ে ইতিপূর্বে ভেঙ্গে গেছে বহু বাড়িঘর। ভিটেমাটি হারিয়ে ৪/৫টি বাড়িঘর ভেঙ্গে যাওয়ায় অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন বসবাসকারীরা। হিদাইরখালের ভাঙ্গন ভয়াবহতায় শিকার একটি বাড়ী দেখতে গিয়ে ডুবে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে পড়ে স্থানীয় এক শিশু। ৩দিন পেরিয়ে গেলেও বুধিগাঁও’র আব্দুল আজিজের কন্যা আসমা বেগমের কোন হদিছ পাওয়া যায়নি।

সানকীভাঙ্গা দক্ষিণপাড়া অগ্রগামী তরুণ সংঘের সভাপতি তারা খাঁন, সানকীভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম খাঁন, স্থানীয় ইউনিয়নের ওয়ার্ড সদস্য আবুল হাসনাত, আওয়ামী লীগ নেতা আশ্রব খাঁন, শাহজাহান মাষ্টার, ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক আফাজ উদ্দিন, সানকীভাঙ্গা যুব উন্নয়ন ক্লাবের যুবনেতা কুদ্দুস খাঁন জানান, পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের এই নিম্নাঞ্চলের মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে আলীরগাঁও ইউনিয়নের হিদাইরখাল বাঁধ। ওখানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় জলাবদ্ধতা এবং পাহাড়ি ঢল আসলে সারী নদীর অতিরিক্ত পানি উপড়ে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ এবং বাড়ী ঘর ভাঙ্গনের দেখা দিচ্ছে। ফসলী জমিগুলো বালি ও পলি ভরাটের কারণে মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

স্থানীয় হাজী সোহরাব আলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো: ছরোয়ারদী বলেন, আলীরগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামসহ নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলোর শিক্ষার্থীরা অনায়াসে সড়ক দিয়ে এই বিদ্যাপীঠে আসত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হিদাইরখাল বাঁধের কারণে রাস্তাঘাট ভাঙ্গন, বিলীন হওয়ায় শিক্ষার্থী এবং এই অঞ্চলের জনসাধারণ যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। এসব দুর্ভোগের নেপথ্যে বিতর্কিত ওই বাঁধটি অপসারণে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কৃপা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় ৩নং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন পরিষদের বারবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফুর রহমান লেবু জানান, গোয়াইনঘাটের আলীরগাঁও ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের স্থানীয় হিদাইরখালের প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহমান শাখা নদী মাটি দিয়ে ভরাট করে পানি প্রবাহের পথ বন্ধ করে দিয়ে আমার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের সানকীভাঙ্গা হাওর, আসামপাড়া, আসামপাড়া হাওর, চৈলাখেল ৯ম খণ্ড, চৈলাখেল ৮ম খণ্ড, বাউরভাগ হাওর, নয়াগাঙ্গেরপার (একাংশ), আলীরগাঁও ইউনিয়নের কাকুনাখাই খলা, রাজবাড়ী কান্দি, বুধিগাঁও হাওর, নাইন্দা হাওর, তিতকুল্লী হাওর, লাম্বাডুবা হাওর, বালির হাওর। এছাড়াও জৈন্তাপুর উপজেলার বিড়াখাই, হাটিরগ্রাম, গাথি, ডুন্ডীরপার, সাতলারপার, শেওলারটুক, মল্লিফৌদ, কান্দি, বাউরভাগ, কৈনাখাই, ভিত্রিখেল, গুফরাজান, খাড়–বিল, ববরবন্দ, লামনীগ্রাম, কাটাখালসহ বিভিন্ন স্থানে সারী নদীর অতিরিক্ত পানি ফুলে গিয়ে জলাবদ্ধতা এবং ভাঙ্গনে তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় কৃষি আবাদ, জনবসতি এবং যাতায়াতের সড়ক যোগাযোগ হুমকির মুখে পড়েছে। সানকীভাঙ্গা দক্ষিণপাড়ায় হিদাইরখালের চরম ভয়াবহতায় ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে বিশাল এলাকা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আমি বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে আড়া দিয়ে বেড়িবাঁধ-কাম-সড়কটি রক্ষার চেষ্টা করছি। এছাড়াও সড়কটির বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন-খানাখন্দ অবস্থা পরিবর্তনে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। নদী শাসন কিংবা নদীর মোহনায় ইচ্ছাকৃত বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রবাহের গতিপথ বন্ধকরণ বা এ জাতীয় যেকোনো কর্মকাণ্ড পরিবেশ এবং নদী শাসন নীতিমালার পরিপন্থী। বিষয়টি দ্রুত সমাধানে উদ্যোগ নিয়ে অত্রাঞ্চলের জানমাল রক্ষায় আমি সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এরই লক্ষ্যে গত ২১ জুন গোয়াইনঘাটের একটি সভায় সিলেটের জেলা প্রশাসক মহোদয়কে এ বিষয়ে আমি অবগত করেছি।

গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত কুমার পাল জানান, জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আমি অবহিত হয়েছি, বিষয়টির সমাধানে কর্তৃপক্ষে অবহিত করা হয়েছে। আশা করা যায়, অচিরেই এ ব্যাপারে কার্যত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

June 2018
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  

সর্বশেষ খবর

………………………..