ধর্মীয় উপাসনালয় ভেঙ্গে এখন ‘সুরমা টাওয়ার’

প্রকাশিত: ৬:৫০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৩১, ২০১৮

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সিলেটকে বলা হয় দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী। এখানে রয়েছে হাজার বছরের লালিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। মাঝে মধ্যে এ সম্প্রীতিতে যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেনি স্বার্থান্বেষী মহল তা নয়। দরগায় বোমা হামলা, বিষ প্রয়োগে দরগা পুকুরের গজার মাছ হত্যা সবকিছুর পিছনেই একটি মহলের ইন্ধন রয়েছে বলে সচেতন মহলের ধারণা। এতকিছুর পরও যে ওই মহলটি সফল হয়েছে তা বলা যাবে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই ঘৃণা ছুড়েছে ওই সকল বর্বোরোচিত ঘটনার নেপথ্যের কলাকুশলীদের। সিলেটের মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অটুট বন্ধন থাকা সত্ত্বেও ঠেকানো যায়নি নগরীর সুরমা মার্কেটের পার্শ্ববর্তী খৃষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয় গির্জা ও বাইবেল পাঠাগারটি।
তথ্য গোপন করে সম্পূর্ণ বে আইনীভাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে ওই জায়গাটি। গির্জা ও পাঠাগার ভেঙ্গে ফেলে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে বিলাস বহুল মার্কেট ও ফ্ল্যাট বাড়ি। গির্জা ভেঙ্গে ফেলার ঘটনায় যে শুধু খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজন ব্যথিত হয়েছিলেন তা নয়। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের লোকজনই সে সময় নিন্দা জানিয়েছিলেন এমন ন্যাক্কারজনক কর্মকা-ের। সিলেটের ইতিহাসে ধর্মীয় উপাসনালয় ভেঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরির এটাই প্রথম ঘটনা বলে মত প্রকাশ করেছিলেন তারা। সচেতন মহল এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন প্রশাসনের। দলীয় সরকারের প্রভাবে তাদের সে দাবি আলোর মুখ দেখেনি। ধর্মীয় উপাসনালয়ের জায়গায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের রূপরেখা চূড়ান্ত হয়। অথচ ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার যে পাওয়ার অব এ্যাটর্ণি বলে ওই জায়গা খৃষ্টান সম্প্রদায়কে দান করেছিল তাতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে গির্জা ও পাঠাগারের জায়গা কোনো অবস্থাতে লিজ বা বিক্রি করা যাবে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার কসবে সিলেট মৌজার ১৮৭৮ খতিয়ানের ৬০০৬ নং দাগে ১.১০ একর জায়গা পাওয়ার অব এ্যাটর্নির মাধ্যমে দান করে তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল ডায়সিসান ট্রাস্ট এসোসিয়েশনকে। পাওয়ার এ্যাটর্ণিতে উল্লেখ করা হয় দানকৃত জায়গার মধ্যে ৪০ ডেসিমেল জায়গা ধর্মীয় উপাসনালয় গির্জা ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের পড়ালেখার জন্য একটি করে (পরবর্তীতে বাইবেল পাঠাগার) জন্য বরাদ্দ। ঐ জায়গা কোন অবস্থাতে বিক্রয়, লিজ বা ভাড়া দেওয়া যাবে না। গির্জা বা পাঠাগারের জায়গা ছাড়া বাকী জায়গা ট্রাস্ট তাদের তহবিল সমৃদ্ধকরণে বা গির্জা ও পাঠাগারের উন্নয়নে বিক্রয়, লিজ বা ভাড়া দিতে পারবে। ট্রাস্টের পক্ষে পাওয়ার অব এ্যাটর্ণিতে স্বাক্ষর করেন চেয়ারম্যান রেভা জেমস ডগলাস ব্লেয়ার। ১৯৬৯ সালে ওই ট্রাস্টের নাম পরিবর্তন করে ঢাকা ডায়সিসান ট্রাস্ট করা হয়।
মূলত ট্রাস্টের জায়গা লিজ নিয়েই গড়ে উঠে বর্তমানের সুরমা মার্কেট। গির্জা ও পাঠাগারের যে ৪০ ডেসিমেল জায়গা বিক্রয়, লিজ ও ভাড়া দেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল অনেক আগেই তার উপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে একটি ভূমিখেকো চক্রের। ৪০ ডেসিমেলের মধ্যে ১২.৬৫ ডেসিমেল জায়গা অনেক আগেই হাতছাড়া হয়ে যায় খৃষ্টান সম্প্রদায়ের। বাকী থাকে শুধু গির্জা ও বাইবেল পাঠাগারের আশপাশের মাত্র ২৭.৩৫ ডেসিমেল জায়গা। ওই জায়গাতেই প্রতি রোববারে নগরীর খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজন এসে জড়ো হতেন প্রার্থনায়। উপাসনা শেষে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতেন বাইবেল পাঠাগারে বসে। কিন্তু ওই এক চিলতে জায়গাও রেহাই পায়নি স্বার্থান্বেষী মহলের লোলুপ দৃষ্টি থেকে। ট্রাস্টের নেতৃস্থানীয় স্বার্থপর লোকদের হাত করে তা ওই জায়গা আত্মসাতের নকশা প্রণয়ন করে তারা। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে ক্রয় বিক্রয় হয় এ জায়গাটি। মাত্র ৪৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান রেভা মাইকেল এস বাড়ৈ গির্জা ও পাঠাগারের জায়গাটি বিক্রি করে দেন সাউথ সুরমা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীনের নামে। দলীল সম্পন্নের সময় ট্রাস্টের চেয়ারম্যান রেভা. মাইকেল এস বাড়ৈর পক্ষে খাস মোক্তার হিসেবে ৩৪নং জালালী, সাইফুল্লাহ আল হোসাইন দলিলে স্বাক্ষর করেন। পরিচয়কারী হিসেবে স্বাক্ষর করেন এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম। উল্লেখ্য মাইকেল বাড়ৈর খাস মোক্তার সাইফুল্লাহ আল হোসাইন জায়গার ক্রেতা জয়নাল আবেদীনের সহযোগী ও সাউথ সুরমা সিটির সক্রিয় পরিচালক এবং সোনারগা আবাসকি প্রকল্পের পরিচালক। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে সুরমা মার্কেট এলাকায় ২৭.৩৫ ডেসিমেল জায়গা বিক্রয় করা হয় মাত্র ৪৫ লাখ টাকায়। অথচ এ জায়গার চলতি মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা বলে দাবি করেছেন সুরমা মার্কেটের ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় লোকজন। সূত্রমতে জানিয়েছে, পানির দামে ওই জায়গা বিক্রি করতে ক্রেতারা ট্রাস্টের চেয়ারম্যানকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করেছেন। গোপনে তার সাথে মোটা অংকের লেনদেনও হয়েছে বলে সূত্র জানায়। জায়গার দলিলেও সুকৌশলে গোপন করা হয়েছে সঠিক তথ্য। দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে ‘বর্ণিত ভূম্যিাদি দীর্ঘদিন যাবত পরিত্যক্ত ও অব্যবহৃত পতিত ভূমির ন্যায় বিদ্যমান ছিল ও এখনও আছে এবং তফশিল বর্ণিত ভূম্যাদি ট্রাস্ট বা ইহার উপকারি ভূমি খৃষ্টান সম্প্রদায়ের কাহারও কোনো উপকার হইতেছে না এবং তফশিল বর্ণিত ভূম্যাদি হইতে কোন উপস্বত্ত্বাদি পাওয়া যাইতেছে না।’ এই জায়গায় যে একটি গির্জা ও বাইবেল পাঠাগার ছিল সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয় দলিলে। অথচ এই গির্জাও পাঠাগারের কথা ১৯৬৫ সালের পাওয়ার অব এ্যাটর্ণিতে স্পস্ট উল্লেখ আছে। এছাড়া পাওয়ার অব এ্যাটর্ণিতে ওই জায়গা বিক্রয়, লিজ বা ভাড়া দিতে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাও গোপন রাখা হয় কৌশলে।
জায়গা কিনে নেওয়ার পরই সাউথ সুরমা সিটি লিমিটেড প্রথমেই ভেঙ্গে ফেলে গির্জা। বিলাস বহুল ২০ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য শুরু করলে খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজন পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। সেই সাথে গোটা সিলেট জুড়ে নিন্দার ঝড় উঠে। খৃস্টান সম্প্রদায়ের জায়গা ফেরত দিয়ে সেখানে গির্জা পুননির্মাণ করে সিলেটের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির হাজার বছরের ইতিহাস অটুট রাখার আবেদন জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃবৃন্দ। এ ব্যাপারে তারা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। গির্জা ভেঙ্গে ফেলা ও ট্রাস্টের জায়গা বেআইনিভাবে বিক্রির ঘটনা উল্লেখ করে ঢাকার জনৈক এস আর রোজারিও নামক ব্যক্তি ২০০৪ সালের ১৩ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে একটি স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপির অনুলিপি দেওয়া হয় তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা, ধর্মমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রী, অর্থ ও পরিকল্পামন্ত্রী, ঢাকাস্থ বৃটিশ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, নরওয়ে, জার্মান, ফ্রান্স, কোরিয়া ও সুইডিস হাইকমিশনারের কাছে। এছাড়া এন্টিকরাপশনের ডিজি, আইজি রেজিষ্ট্রেশন ঢাকা, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ ও ঐক্য ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা এন্টিকরাপশন অফিসার, সিলেট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক, সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক এবং সিলেট হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের কাছেও স্মারকলিপির অনুলিপি পাঠানো হয়।
এক সময় দাবির মুখে প্রশাসন গির্জার স্থানে মার্কেট নির্মাণের কাজ স্থগিত করে দেয়। কিন্তু সাউথ সুরমা সিটির লোকজনও থেমে থাকেননি। তারা প্রশাসন ম্যানেজের ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। নিষেধাজ্ঞা থাকাবস্থায় বেশ কয়েক মাস বন্ধ থাকে কাজ। এ সময় তারা পাঠাগারটিতে স্থাপন করে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেন মহানগর শাখার অফিস। যার সভপতি সাউথ সুরমা সিটি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জয়নাল আবেদীন। মূলত এ অফিসের মাধ্যমেই নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে দখল টিকিয়ে রাখেন তারা। পরবর্তীতে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তারা পুনরায় কাজ শুরু করেন ওই জায়গায়। তবে বেআইনিভাবে ক্রয়কৃত জায়গাটি বেশি দিন নিজেদের দখলে রাখতে পারবেন না নিশ্চিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা জায়গাটি বিক্রি করে দেন। বতর্মানে সেখানে সুরমা টাওয়ার নামে একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।সূত্র- সিল নিউজ বিডি

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..