‘পলো বাওয়া‘ উৎসবে মাতলো বিশ্বনাথের গোয়াহরী গ্রামবাসী

প্রকাশিত: ১:৫২ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০১৮

বিশ্বনাথ প্রতিনিধি :: প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম তারিখে ‘পলো বাওয়া উৎসব’ পালন করেন সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের গোয়াহরী গ্রামের লোকজন। পূর্ব নির্ধারিত তারিখ হওয়ায় রোববার সাতসকালেই গ্রামের লোকেরা তাদের দক্ষিণ বিলে ছুটে আসতে থাকেন পলো দিয়ে মাছ শিকার করতে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শৌখিন মাছ শিকারিদের সঙ্গে উৎসুক দর্শকদেরও ভিড় বাড়তে থাকে বিলের পাড়ে। অনেকটা উৎসব উদযাপনের মতো প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী পলো দিয়ে মাছ ধরে আনন্দ উদযাপন করেন সকলে। প্রায় দুই শতাধিক বছর ধরে গ্রামে পলো বাওয়া উৎসব চলে আসছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এ উৎসব ঘিরে অনেক প্রবাসীরাও সন্তানদের নিয়ে দেশে বেড়াতে এসেছেন। নতুন প্রজন্মের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন পলো বাওয়া উৎসবকেও।

সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হৈ হৈ করে একসাথে পলো-জাল হাতে মাছ শিকারে নেমে পড়েন সবাই। ঝপ ঝপ শব্দের তালে তালে চলতে থাকে পলো পাওয়া। প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী এ ‘পলো বাওয়া উৎসবে’ গোয়াহরি গ্রামের সব বয়সী পুরুষ অংশ নেন। গ্রামের ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি ঘর থেকে একজন পুরুষ পলো নিয়ে উৎসবে অংশগ্রহন করেন। যাদের পরিবারে পুরুষ সদস্য বাড়িতে নেই, তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে কোন আত্মীয় মাছ শিকারে অংশ নেন। এ বছর বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ থাকায় উৎসবে অংশগ্রহণ করা কাউকেই খালি হাতে ফিরতে হয়নি। এমনকি শিশুরাও জাল দিয়ে বিলের তীরের কাছে মাছ শিকার করতে সক্ষম হয়েছে।

আর তরুণ-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সবাই বোয়াল, রুই, গজার, কালীবাউস, শোল, বাউশ, কার্পু, কাতলা, শিং, মাগুর, কৈ’সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করেন। একেকটি মাছ শিকারের সাথে সাথে চিৎকার করে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করেন শিকারীরা। শিকারীদের ওই আনন্দের সাথে সাথে তাল মেলান বিলের তীরে অপেক্ষমান গ্রামের মুরব্বী, মহিলা ও শিশুরা। দূর থেকে আসা অনেকের আত্বীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বিলের পাড়ে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কয়েক শতাধিক লোক পলো বাওয়া উৎসবে অংশগ্রহন করেন। বিল থেকে গত বছরের তুলনায় মাছ শিকার হয়েছে বেশী।

এই উৎসবকে কেন্দ্র করে গোয়াহরি গ্রামে গত কয়েকদিন ধরে উৎসবের আমেজ রিবাজ করছিল। এই উৎসব ১৫ মাঘ পর্যন্ত চলবে। গোয়াহরি গ্রামের পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে এই পনের দিন বিলে মাছ ধরায় আটল (নিষেধাজ্ঞা) জারি করা হয়েছে। তবে গ্রামবাসীর ঐতিহ্য অনুযায়ী আগামী ১৫ মাঘ ২য় ধাপে পলো বাওয়া হবে। এই পনের দিনের ভিতরে প্রতি রবিবার ও বৃহস্পতিবার বিলে হাত দিয়ে মাছ ধরা হবে এবং কেউ চাইলে পেলান জান (হাতা জাল) দিয়ে মাছ ধরতে পারবেন।

গ্রামের প্রবীণ মুরব্বী হাজী তৈমুছ আলী বলেন, ‘পলো বাওয়া উৎসব আমাদের গ্রামের একটি ঐতিহ্য। আমাদের গ্রামবাসী পূর্বপুরুষের আমল থেকে এই উৎসব পালন করে আসছেন। বয়সের কারণে এখন আর পলো বাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারি না। তবে জীবনে ওই বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ শিকার করেছি।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য গোলাম হোসেন বলেন, ‘পলো বাওয়া’ উৎসব আমাদের পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য। দীর্ঘকাল ধরে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় আমরা গ্রামবাসী একসাথে প্রতি বাংলা বছরের ১লা মাঘ বার্ষিক পলো বাওয়া উৎসব পালন করে থাকি। এই উৎসবের আনন্দ অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে পাওয়া যাবে না।

যুক্তরাজ্য প্রবাসী রহমত উল্লাহ আব্দুল্লা বলেন, ‘দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর ধরে প্রবাসে বসবাস করে আসছি। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্যস্ততার কারণে কখনও পলো বাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। এবার তা পূরণ হয়েছে।

পলো বাওয়া উৎসবে অংশ নেওয়া উপজেলার কালীগঞ্জের এম এ রব ও চৌধুরীগাঁও গ্রামের তাহিরান আলী বলেন, গ্রামে আত্মীয়-স্বজন থাকার কারণে অন্যান্য বছরের মতো এবারও বার্ষিক পলো বাওয়া উৎসবে অংশগ্রহণ করে মাছ শিকার করেছি। অন্য গ্রামের বাসিন্দা হওয়ার পরও গোয়াহরি গ্রামবাসী তাদের আনন্দের এই উৎসবে শরিক হওয়ার সুয়োগ দেওয়ায় আমরা আনন্দিত।

প্রবাসী মুজিবুর রহমান, ময়নুল হক, ওয়াহিদুর রহমান জানান, এই মাছ ধরায় অংশ নিতে পেরে তাদের খুব আনন্দ লাগছে। তারা পলো বাওয়ায় অংশগ্রহন করতে প্রবাস থেকে দেশে এসেছেন। পলো দিয়ে মাছ শিকার তাদের কাছে একটি মজার বিষয়।

এবারের পলো বাওয়া উৎসবে তজম্মুল আলী ২টি বোয়াল ও ১টি কার্পু, জাহাঙ্গীর আলম কয়েছে ২টি বোয়াল ও ১টি শোল, আব্দুল আহাদ ২টি বোয়াল, মিজানুল করিম ৩টি বোয়াল ও ১টি ঘাসকার্প, তোফায়েল আহমদ ২টি বাউশ, সিরাজুল ইসলাম ১টি বোয়াল, আতাউর রহমান ১টি শোল, লিমন মিয়া ২টি রুই, মাহফুজুর রহমান সুজন ১টি বোয়াল ও ২টি কাতলা মাছ শিকার করেছেন।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..