সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাটে রয়েছে পাথর কোয়ারি। সিলেটের পাথর ভালো মানের হওয়ায় দেশের সবখানেই এর কদর বেশি। ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে সড়কের ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহূত পাথরের বেশিরভাগ আসে সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে। কিছু ভারত থেকে এলেও এর দাম বেশি হওয়ায় সিলেটের পাথরই প্রধান ভরসা। কোয়ারির মালিক বা কোয়ারি পরিচালনাকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় অবৈধ উপায়ে করা হয় পাথর উত্তোলন।
এ সময় নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে ‘উপর মহলের’ ফোনে এ-সংক্রান্ত মামলার কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।
জানা যায়, কয়েক দিন ধরেই সিলেটের কোয়ারিগুলোতে চলছে অবৈধ উপায়ে পাথর উত্তোলনের ধুম। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারপরও পাথর উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। বেশিরভাগ কোয়ারিতে ব্যবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ বোমা মেশিন। ভূগর্ভ থেকে পুরো পাথর তুলে আনতেই এটা ব্যবহার করা হয়। অনেকগুলোতে টিলা কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। এসব সুড়ঙ্গ দিয়ে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে প্রয়ই ঘটছে হতাহতের ঘটনা। যখন কোনো ঘটনা ঘটে, তখন টনক নড়ে প্রশাসনের। তারা একটু সতর্ক হয়। অভিযান চালায় কোয়ারিগুলোতে। আর শক্তিশালী অভিযান শুরু হলেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাঠে নামে পাথরখেকোরা। সড়ক অবরোধ করে তারা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকলে অচিরেই এর ভয়াবহ নমুনা দেখা যাবে প্রকৃতিতে। পরিবেশের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেক বেশি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, কয়েক দিন অভিযান চললেও সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, ভোলাগঞ্জ, গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি, জাফলং ও কানাইঘাটের লোভাছড়ায় বন্ধ হয়নি পাথর উত্তোলন। রাতে বোমা মেশিনের শব্দে ঘুমাতে পারছে না নদীপাড়ের বাসিন্দারা। কোম্পানীগঞ্জের পারুয়া গ্রামের বাসিন্দা আবু হানিফ জানান, কাজের জন্য সিলেটে থাকি। প্রতি সপ্তাহে মা-বাবাকে দেখার জন্য বাড়িতে যাই। সেখানে যাওয়ার পর মনে হয় বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে ভোলাগঞ্জ এলাকা। রাতে মা-বাবা ঘুমোতে পারেন না বোমা মেশিনের বিকট শব্দে। এলাকাবাসীর প্রতিবাদেও কাজ হয়নি। তিনি আরও জানান, যারা কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন করে তারা অনেক প্রভাবশালী। তাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উপায়ে পাথর উত্তোলন করলেও প্রশাসন বন্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে পাথরখেকোদের সুসম্পর্কও রয়েছে।
জাফলংয়ের বল্লাঘাট এলাকার বাসিন্দা আবছার হোসেন রানা বলেন, তার বাড়ির পাশেই পিয়াইন নদী। রাতে ঘুমাতে গেলে কানে তালা দিতে হয়। মাঝে হাতেগোনা কয়েক দিন পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। প্রশাসনের নজরদারি ছিল। এখন সে অবস্থা নেই। আবার বোমা মেশিনের সাহায্যে পাথর উত্তোলন অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা না থাকায় এবং তাদের সঙ্গে পাথরখেকোদের ‘সুসম্পর্ক’ থাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না।
গত ৭ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাটে টিলা ধসে মারা যায় পাঁচ শিশুসহ ছয়জন। এ ঘটনার পর সিলেটের কোয়ারিগুলোতে অভিযান জোরদার করে প্রশাসন। গত ৮ নভেম্বর কোম্পানীগঞ্জের কোয়ারিতে ৩১টি বোমামেশিন জব্দ করে প্রশাসন। মামলা করে পাথরখেকো শামীম আহমদের বিরুদ্ধে। ওই মামলার পরপরই তার লোকজন সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে।
বোমা মেশিন ব্যবহারের ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি শফিকুর রহমান খান সমকালকে বলেন, বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর দেখছে। তারা তদন্তও করছে। আমরা তাদের সহযোগিতা করছি। এলাকায় এখন কোনো বোমা মেশিন চলছে না বলেও দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ মণ্ডল বলেন, বোমা মেশিনের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু হলে শিগগির এসব বন্ধ হবে।
সিলেটের পাথর রাজ্যে পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম বাড়তে থাকায় সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন সাত সংগঠনের নেতারা। তারা বলেছেন, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত অবস্থা এবং জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে শাহ আরেফিন টিলা, জাফলং, বিছনাকান্দি, লোভাছড়া ও বাংলাটিলায় এ বছরের ২৩ জানুয়ারি থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত মারা গেছেন ২৮ পাথর শ্রমিক। ১১ পাথর শ্রমিক আহত হন। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সিলেটে প্রকৃতির বারোটা বেজে যাবে।
বিবৃতিদাতারা হলেন- সিলেটে বেলার বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার, সুজন সিলেট জেলা কমিটির সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম, ব্লাস্টের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মো. ইরফানুজ্জামান চৌধুরী, সনাক সিলেটের সভাপতি আজিজ আহমেদ সেলিম, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দা শিরীন আক্তার ও বাপার সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম।