সিলেট ১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৪ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ২:৪০ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৮
নিজস্ব প্রতিবেদক : সিলেটে আদালত প্রাঙ্গনে দুই সাংবাদিককে নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত রাজাকারপুত্র, আওয়ামীলীগ নেতা, পাথর খেকো ও হত্যা মামলার আসামি লিয়াকত আলীসহ তার তিন সহযোগীকে বাদ দিয়ে চার্জশীট দাখিল হয়েছে। বাদির বক্তব্য না নিয়ে যথাযথ তদন্ত ছাড়াই গোপনে দফারফার মাধ্যমে এই চার্জশীট দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এমন অভিযোগ বাদিপক্ষের। গতকাল বুধবার সিলেটের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সাইফুজ্জামান হিরোর আদালতে চার্জশীটটি দাখিল হয়। আদালত আগামি ২০ ফেব্রুয়ারি চার্জশীটের শুনানীর দিন ধার্য়্য করেন। চার্জশীট নং ৫০/১৮।
এদিকে চার্জশীট দাখিলের খবরে বিস্মিত নির্যাতিত সাংবাদিক ও মামলার বাদি যমুনা টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন নিরানন্দ পাল। তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা বাদির সাথে কোন কথা না বলেই তদন্তকারী কর্মকর্তা চার্জশীট জমা দিয়ে দিয়েছেন। কোন রকম তদন্ত ছাড়াই এই ‘ফরমায়েশী চার্জশীট’ তৈরি করা হয়েছে। চার্জশীট প্রত্যাখান করে তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত বিধায় আমি ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা জানাবো। পাশপাশি জোটবদ্ধ আন্দোলনে থাকা ৫ সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। পাশপাশি তারা ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।
মামলার বাদির আইনজীবী অ্যাডভোকেট মঈনুল হক বুলবুল বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা যে মনগড়া চার্জশীট দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে আদালতে আমরা নারাজি দেব। আগামি ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আদালত সময় দিয়েছেন। পাশাপাশি বাদিকে না জানিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে চার্জশীট দাখিল করেছেন। এটা গুরুতর অপরাধ। এব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাদি আদালতে আবেদন করেছেন। এব্যাপারে পরবর্তীতে আদেশ দেবেন আদালত। তিনি বলেন, এই মামলার আসামি লিয়াকত ও শামীম আহমদকে জামিন দিয়েছেন আদালত।
সিলেটের একজন বিজ্ঞ আইনজীবী বলেন, বাদিকে অবগত না করে চার্জশীট দাখিলের ব্যাপারে নারাজি দেয়া জরুরি। এতে তদন্তকারীর ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, অবৈধভাবে পাথর লুটে কোটি কোটি টাকার কালো টাকা আয়ের পর পাথরখেকোরা বেপরোয়া। তারা বরাবর ধরাকে সরাজ্ঞান করে চলে। এরই ধারবাহিকতায় তারা আদালত প্রাঙ্গনেও হামলার সাহস পেয়েছে। এসব অপকর্মে তাদের কিছুই হবেনা এটা নিশ্চিত হয়েই তারা একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে। চার্জশীট থেকে বাদ পড়া, জামিন পাওয়া সবকিছুই তাদের জন্য সম্ভব। শ্রমের টাকায় কিছু করা না গেলেও কালো টাকায় অনেক কিছুই হয়।
এব্যাপারে কথা বলতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব ইন্সপেক্টর হাদিউল ইসলামের নাম্বারে বারবার ফোন করলেও মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
সিলেট কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি গৌছুল হোসেন জানান, সাংবাদিক নির্যাতনের মামলায় ভিডিও ফুটেজ দেখে ১৩ আসামিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এজাহারে উল্লেখিত ৪ জন অভিযুক্তকে বাদ দেয়া হয়েছে। ভিডিও ফুটেছে তাদের শনাক্ত করতে না পারায় তাদেরকে চার্জশীট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
চার্জশীট থেকে বাদ পড়া ৪ অভিযুক্ত হচ্ছেন জৈন্তাপুরের মল্লিফৌদ গ্রামের ওয়াজিদ আলী টেনাইয়ের পুত্র লিয়াকত আলী, নয়াখেল গ্রামের মতিউর রহমানের পুত্র ফয়েজ আহমদ বাবর, আদর্শ গ্রামের জালাল মিয়ার পুত্র শামীম আহমদ ও খারুবিল গ্রামের আলী আহমদের পুত্র মো: হোসাইন আহমদ।
চার্জশীটে অভিযুক্তরা হচ্ছে, জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত গ্রামের খাতির আলীর পুত্র নজরুল ইসলাম, হরিপুর গ্রামের লাল মিয়ার পুত্র জুয়েল আরমান, চাল্লাইন গ্রামের সাইফ উদ্দিনের পুত্র নুরুদ্দিন মড়া, ঘাটেরছটি গ্রামের লুৎফুর রহমান কালার পুত্র এম জেড জাহাঙ্গীর, শফিকুর রহমানের পুত্র তোফায়েল আহমদ, আলু বাগান গ্রামের মোস্তফা মিয়ার পুত্র সৈয়দ রাজু, বাউরবাগ মল্লিফৌদ গ্রামের মোহাম্মদ আলী মড়ার পুত্র ফারুক আহমদ, হাটিরগাঁও গ্রামের হোসেন মিয়ার পুত্র শাব্বির আহমদ, আদর্শ গ্রামের আইয়ুব আলীর পুত্র মনির মিয়া, লক্ষীপুর পূর্ব গ্রামের মনির মিয়ার পুত্র তাজ উদ্দিন, সরুফৌদ গ্রামের সিদ্দিক আলীর পুত্র হোসেন আহমদ উরফে টাটা হোসেন, সরুখেল পশ্চিম গ্রামের আবুল হোসেনের পুত্র সুলতান আহমেদ ও বাউরবাগ গ্রামের আব্দুল হান্নানের পুত্র নুরুল ইসলাম। জব্দ করা ভিডিও ফুটেজ দেখে এই ১৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে চার্জশীটে উল্লেখ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এদিকে, অভিযোগ ওঠেছে বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে লিয়াকতের বশে আসে পুলিশ। মামলা দায়েরের পর প্রধান আসামি লিয়াকতকে শ্যোন অ্যারেস্ট, দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করে। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওয়া গেছে বলেও সাংবাদিকদের জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার সাব ইন্সপেক্টর হাদিউল ইসলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বাদী ও সাক্ষীদের না জানিয়েই আসামিদের রক্ষায় ‘ফরমায়েশি চার্জশীট’ দাখিল করে পুলিশ।
মামলার এজাহার নামীয় আসামী এবং সিসি টিভি ফুটেজ দেখে হামলাকারী হিসেবে যাদের সনাক্ত করা হয় তাদের গ্রেফতারেও কোন ভূমিকা নেই পুলিশের। অথচ আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছবি তুলে তা ফেসবুকেও শেয়ার করছেন কেউ কেউ।
অপরদিকে চার্জশীট থেকে জৈন্তাপুর আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক পাথর খেকো লিয়াকত আলীকে বাদ দেয়ায় নানা কানাঘুষা চলছে খোদ জৈন্তাপুর উপজেলাতেই। কেউ বলছেন তাকে বাদ দিতে লিয়াকতের পরিবারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কোতোয়ালী থানার ওসি গৌসুল হোসেন। এছাড়া লিয়াকত আলীর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে থাকা স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রতিনিয়ত তদবির করেছেন পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্তাদের। এমন অভিযোগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জৈন্তাপুর আওয়ামীলীগের এক নেতার। তবে কোতোয়ালী থানার ওসি গৌছুল হোসেন অবৈধ সুবিধা গ্রহণ ও চাপের মুখে চার্জশীট দাখিলের কথা অস্বীকার করেন।
সিলেটের পাথর খেকো লিয়াকত আলী ও ফয়েজ আহমদ বাবরের নির্দেশে তাদের ক্যাডার বাহিনী সিলেটের আদালত প্রাঙ্গনে গত ২৫ জানুয়ারি দুই সাংবাদিকের উপর হামলা চালায়। আক্রান্তরা হচ্ছেন যমুনা টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন নিরানন্দ পাল ও যুগান্তরের চিত্রগ্রাহক মামুন হাসান। এঘটনায় নিরানন্দ পাল বাদী হয়ে লিয়াকত আলী ও ফয়েজ আহমদ বাবরকে প্রধান অভিযুক্ত করে আরও ১৫/১৬ জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হন সাব ইন্সপেক্টর হাদিউল ইসলাম। তিনি নির্ধারিত সময়ে তদন্ত কাজ শেষ করতে না পেরে আদালতের কাছে সময় প্রার্থনা করলে আদালত ৭ দিনের সময় বেঁধে দেন। গতকাল বুধবার ছিল বর্ধিত সময়ের শেষ দিন। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় সিলেটের সাংবাদিকসমাজসহ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ঘটনার পর সিলেটে কর্মরত সাংবাদিকদের ৫ সংগঠন লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন। হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে পালিত হয় মানববন্ধন, কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান কর্মসুচি।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd