টাকা শেষ হয়ে গেলে ঘরের যেকোন আসবাব পত্র চুরি করে বিক্রয় করে টাকা দিয়ে খেলতে হচ্ছে সেই শিলং তীর খেলা। শুধু তাই নয় ইতিমধ্যে তীর খেলার নিয়ে অনেক পরিবার আজ পথে বেসেছে।
আবার তীরের এজেন্টরা হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকার মালিক। অনেকেই ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন বাড়ি-গাড়ি’সহ অনেক সম্পত্তি। এমনি কিছু মানুষরে সন্ধান মিলেছে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা ও উত্তর সুরমায়। তারা প্রতিনিয়ত আছে ছক্কা আর ছক্কার মাঝে।
কিন্তু আমাদের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। এখন সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? কোথায় পাবে এর প্রতিকার? এমন প্রশ্ন ভূক্তভুগীদের। বিভিন্ন সূত্র জানায়, শুরুতে সীমান্তবর্তী এলাকায় শিলং তীরের প্রভাব থাকলেও ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যা ভিত্তিক এই জুয়া ধীরে ধীরে তা সীমান্তবর্তী এলাকা পেরিয়ে নগরীর পাড়া-মহল্লায় এর বিস্তার লাভ করেছে।
ভাগ্যের খেলায় দিনমজুর, স্কুল-কলেজের ছাত্র, রিকশাচালক, যানবাহনের চালক-শ্রমিকসহ বেকার যুবকরা অংশ নিচ্ছেন। বিশেষ করে এই ডিজিটাল জুয়ার প্রভাব পড়েছে তরুণ-যুবকদের মধ্যে। বাড়ছে দিন-দুপুরে যেখানে-সেখানে চুরি, ছিনতাইসহ আরো বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা।
এ খেলা সিলেটে দিন দিন বেড়ে চললেও প্রশাসন ‘শিলং তীর’ চক্রকে ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ‘শিলং তীর’ জুয়ার আসর সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানায়, মূলত এটি একটি কৌশলগত খেলা। খুবই অল্প সময়ে মানুষজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিরাট ফাঁদ এটি।
এ জুয়ার আসর থেকে সাধারণ মানুষ যাতে মুখ ফিরিয়ে না নেন, সেজন্য প্রতি ৩-৪ দিনের মাথায় একজনকে জুয়ার বাজিতে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বাজিতে প্রাপ্ত টাকার অংক কম হলে সাথে সাথেই পরিশোধ করা হয়। টাকার অংক বেশি হলে পরদিন তা পরিশোধ করা হয়। নগরীর এমন কোনো এলাকা নেই যে, যেখানে তীর শিলংয়ের জুয়া খেলা হচ্ছে না।
আর এসব আসরে কিছু কিছু পুলিশ সদস্যদের অবাধে যাতায়াত রয়েছে। জানা যায়, বর্তমানে সিলেট নগরীর কাজিরবাজার, শেখঘাট , করিম উল্লাহ মার্কেট, সোবহানীঘাট কাঁচাবাজার, উপশহর পয়েন্ট, তেররতন, শিবগঞ্জ, বালুচর, বড়বাজার, বন্দরবাজার, রিকাবিবাজার, তালতলা, মদিনা মার্কেট, তেমুখী, টুকেরবাজার, ঘাসিটুলা, কানিশাইল, ওসমানী মেডিকেল, কুয়ারপাড়া (চানাচুর শামীমের বাসা), লালবাজার, লালদিঘীরপাড়, হকার্স মার্কেট, সিটি মার্কেট, শাহী ঈদগাহ, আম্বরখানা, খাসদবীর, চৌখিদেখি, মালনীছড়া চা বাগান, লামাবাজার, কুয়ারপাড়, শাহী ঈদগাহ, টিভি গেইট, রায়নগর, টিলাগড়, খাদিম, দক্ষিণ সুরমার কদমতলিস্থ বালুর মাঠ, চাঁদনিঘাট, ঝালোপাড়া, খেয়াঘাট, আলমপুর, গোটাটিকর, ভার্থখলা কুমিল্লা পট্রি, পুরাতন রেলস্টেশনের সাধুর বাজার, বাবনা পয়েন্ট, খোজারখলা, কামালবাজার, তেতলীসহ শতাধিক স্পটে প্রতিদিন বসে ‘শিলং তীরের জুয়ার আসর।
সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রকাশ্যে নগরীর বিভিন্ন রাস্তাঘাট, বিভিন্ন সরকারি অফিসের পেছনের সাইট, বিভিন্ন কলোনি, রেস্টুরেন্ট, চা-দোকানসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান অবস্থায় এই খেলার নম্বর টোকেন বিক্রি হয়। পুলিশ সূত্র মতে, গত ৬ মাসে সিলেটে অন্তত শতাধিক জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এই জুয়ার আসর থেকে গ্রেপ্তারকৃত জুয়ারিদের আদালতে পাঠানো হয়।
কিন্তু আদালতের নির্দেশানুযায়ী জেল ও জরিমানা প্রদান করে বের হয়ে আবারো জুয়ায় মগ্ন হয়ে উঠে জুয়াড়িরা। বিভিন্ন জুয়ার আসরের অভিযানে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা প্রশংসার দাবিদার। এ ব্যাপারে সিলেট কোতোয়ালী থানার ওসি গৌছুল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, গত তিন মাসের মধ্যে ৫৫-৬০ জনের মতো শিলং তীরের জুয়াড়িদের আটক করে আদালতের মাধ্যমে তাদের সাজা প্রদান করা হয়।
সিলেট শাহপরাণ থানার ওসি আখতার হোসেন জানান, গত তিন মাসের মধ্যে ১০-১২ মতো শিলং তীরের জুয়াড়িকে আটক করা হয়। আটককৃত জুয়াড়িদের আদালতের মাধ্যমে ২০০ টাকা জরিমানা ও ১ দিনের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। শাহপরাণ থানার পক্ষ থেকে বেশিরভাগই আটককৃত জুয়ারিদের জুয়া খেলা থেকে বিরত থাকার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
শাহপরাণ থানাধীন এলাকায় শিলং তীরের বোর্ডের খবর পাওয়া মাত্রই পুলিশি অভিযান দেওয়া হয়। শিলং তীরের জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সিলেট দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি খায়রুল ফজল বলেন, শিলং তীরের জুয়া বন্ধের অভিযান অব্যাহত আছে।
দক্ষিণ সুরমা থানাধীন যে-কোনো এলাকায় খবর পাওয়া মাত্র পুলিশ সদস্যরা অভিযান দেন এবং জুয়াড়িদের আটক করেন। সিলেট মোগলাবাজার থানার ওসি আনোয়ারুল ইসলাম জানান, গত তিন মাসের মধ্যে ২০-২২ জনের মতো আটক করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
মোগলাবাজার থানার বিভিন্নস্থানে জুয়ারবোর্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এ খেলা অনলাইন ভিত্তিক হওয়ায় জুয়াড়িরা অনেক তৎপর। শুধু মোগলাবাজার না শিলং তীরের জুয়াড়িদের বিরুদ্ধে সবসময় পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সিলেট জালালাবাদ থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, খবর পাওয়া মাত্র জালালাবাদ থানাধীন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়।
গত তিন মাসের মধ্যে ১০০ জনের উপরে শিলং তীরের জুয়াড়িদের আটক করা হয়। জালালাবাদ থানাধীন এলাকায় শিলং তীর সহ সবধরণের অপরাধের বিষয়ে সবসময় পুলিশের তদারকি রয়েছে। সিলেট বিমানবন্দর থানার ওসি মোশাররফ হোসেন জানান, জুয়া খেলায় বেশিরভাগই তরুণরা জড়িত রয়েছে।
গত তিন মাসে বিমানবন্দর থানাধীন ৩৫-৪০ জনের উপরে শিলং তীরের জুয়াড়ি আটক হয়েছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ ও স্কুল পড়ুয়া। অনলাইন ভিত্তিক এই শিলং তীরের জুয়ার বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) আব্দুল ওয়াহাব বলেন, তীর শিলং খেলার বিরুদ্ধে প্রশাসন সবসময় কঠোর।
তীর শিলংয়ে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে। যারা এই জুয়ার সাথে জড়িত এবং যারা এর নেতৃত্ব দেন তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে খেলে। এই ডিজিটাল জুয়াখেলা সিলেটে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। ‘শিলং তীর নামক জুয়া মূলত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চলে।
এই খেলায় মানুষ এতোই আসক্ত হয়েছে যে, একই পরিবারের বাবা-মা ও ছেলে মিলে জুয়ায় বাজি ধরছে। মানুষ সচেতন হলেই এই খেলা বন্ধ হবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে (বিটিআরসি)-তে দুইবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে ওয়েবসাইটগুলো এখনও বন্ধ হয়নি।’ এই ওয়েবসাইটগুলো আদৌও বন্ধ হবে কি না তা বলা যাচ্ছে না।
এই ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ হলে এই তীর শিলংয়ের জুয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, এ জুয়া অনলাইন ভিত্তিক হওয়ায় এবং জুয়াড়িরা মোবাইলের মাধ্যমে পরস্পর যোগাযোগ রাখায় পুলিশ এদের রুখতে পারছে না। ফলে মাঝে মধ্যে চিহ্নিত জুয়ার স্পটে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন জুয়াড়িকে আটক করার মধ্যে সীমাবদ্ধ পুলিশের তৎপরতা।