সিলেট ১৬ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৭ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১:৩৭ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১১, ২০১৮
ওয়েছ খছরু, সিলেট : আজাদ-রঞ্জিত। দুই বন্ধু। আবার শত্রু হিসেবে দু’জন ভয়ঙ্কর। খুনোখুনির ঘটনা তাদের কাছে নস্যি। রক্তের হোলিখেলায় তারা মেতে উঠলে কেঁপে উঠে টিলাগড়। রক্তে লাল হয় রাজপথ।
তাদের দাপট ও ক্ষমতার কাছে অসহায় সিলেটের প্রশাসনও। আর তাদের কাজে বিব্রত আওয়ামী লীগ। টিলাগড়ের মানুষের কাছে এই দুটি নাম আতঙ্কের। দুই জনের কাছে জিম্মি এমসি ও সরকারি কলেজ। একের পর এক লাশের হোলিখেলার কারণে এই দু’টি নাম এখন সিলেটজুড়ে আলোচনায়। আজাদুর রহমান আজাদ সিলেট ছাত্রলীগের এক পরিচিত নাম। তিনি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক। ২০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তিনি। নগরীর টিলাগড়ে ‘আজাদ গ্রুপ’ নামের ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রক তিনি। আর রঞ্জিত সরকার হচ্ছেন আজাদুর রহমান আজাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তার মূল বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে। সেই ছাত্র জমানা থেকে বসবাস করেন টিলাগড়ে। ওখানের ছাত্রলীগের রঞ্জিত গ্রুপের নিয়ন্ত্রক তিনি। টিলাগড়ের পাশের গোপালটিলায় তার অবস্থান। ছাত্রলীগ থেকে একসঙ্গে রাজনীতি করছেন আজাদুর রহমান আজাদ ও রঞ্জিত সরকার। দু’জনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় টিলাগড় এলাকা। ওই এলাকা কেন্দ্রিক রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখার পর তারা সিলেটের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে উঠেন। ছাত্রলীগের কমিটি গঠন হলে এমসি ও সরকারি কলেজ ছাড়াও তারা দু’জন জেলা ও মহানগরের কমিটিতে নিজের কর্মীর অবস্থান সূদৃঢ় করেন। তাদের বলয়ের হয়ে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন পংকজ পুরকায়স্থ, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিরন মাহমুদ নিপু, কার্যক্রম স্থগিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক রায়হান আহমদ। এছাড়া মহানগর কমিটিতেও তাদের দুই জনের আধিক্য ছিল। বিগত সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। এতে করে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর সমাগম ঘটে এই বলয়ে। একই সঙ্গে সুযোগ-সুবিধা নিয়েও আজাদ-রঞ্জিতের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ কারণে দুই বলয়ের সৃষ্টি হয় টিলাগড়ের ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। এক বলয়ের নেতৃত্বে দেন আজাদ ও অন্য বলয়ের নেতৃত্বে থাকে রঞ্জিত সরকার। কর্মীরাও হয়ে পড়ে বিভক্ত। বর্তমান সরকারের শাসনামলে এমসি ও সরকারি কলেজে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ১০ বার মুখোমুখি হয় আজাদ ও রঞ্জিত গ্রুপের নেতারা। ক্যাম্পাস দখলকে কেন্দ্র করে অস্ত্রের মহড়া, পাল্টা মহড়ায় মেতে উঠে তারা। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আর প্রকাশ্য আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়ায় গোটা দেশজুড়ে আলোচনায় আসে এমসি কলেজের ছাত্রলীগ। ২০১২ সালে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে আগুন দেয়ার ঘটনার পর থেকে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। এমসির ছাত্রাবাসে আগুন দেয়ার মূল নেপথ্যে ছিল আজাদ বলয়ের নেতারা। রঞ্জিত বলয়ের কিছু নেতাকর্মী ওই অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পরে তাদের গ্রুপ থেকে বের করে দেয়া হয়। শেষে গ্রুপ ত্যাগী ওই নেতাকর্মীদের ঠাঁই হয় আজাদ গ্রুপে। গ্রুপিং দ্বন্দ্বের কারণে কয়েক মাস আগে এমসি কলেজের ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের পর থেকে আজাদের অনুসারীরা ক্যাম্পাস ছাড়া রয়েছে। আর দুটি ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করছে রঞ্জিত সরকারের কর্মীরা। ফলে এমসির আধিপত্য নেয়া আজাদ গ্রুপের জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এদিকে- সম্প্রতি আজাদ ও রঞ্জিত গ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরে ৪ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে আজাদ গ্রুপের হাতেই খুনের সংখ্যা বেশি। এ কারণে বর্তমানে বাড়ি ছাড়া রয়েছে আজাদ গ্রুপের নেতারা। নিহতরা হচ্ছে- ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মুহাম্মদ মাসুম, ওমর মিয়াদ এবং তানিম খান। এর মধ্যে ওমর মিয়াদ ও তানিম খান রঞ্জিত গ্রুপের অনুসারী। আর জাকারিয়া মাসুম যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামানের অনুসারী। এছাড়াও ২০১৬ সালের ১৬ই আগস্ট আজাদ গ্রুপের অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সোলেমান হোসাইনের নেতৃত্বে একদল যুবক জিন্দাবাজারের এ্যালিগ্যান্ট শপিং সেন্টারের ব্যবসায়ী করিম বকস মামুনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। ছুরিকাঘাত করে সোলেমান। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন নিহতের পিতা মো. আনোয়ার বখত। মামলায় কানাইঘাটের দর্পনগর পূর্ব গ্রামের নূর উদ্দিনের পুত্র সোলেমান হোসেন (২৮) ও জকিগঞ্জের কামালপুর গ্রামের মঈন উদ্দিনের পুত্র জাবেদ আহমদসহ অজ্ঞাতনামা আরো ৪-৫ জনকে আসামি করে মামলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই ২০১০ সালে টিলাগড়ে ছাত্রলীগের কোন্দলে খুন হন এমসি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এরপর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠে টিলাগড়ের ছাত্রলীগ। এমসি কলেজের হল পোড়ানো, হল ভাঙচুর, অস্ত্রবাজি, খুন- সব অপকর্মেই এগিয়ে তারা। এর আগে ২০১২ সালের ৮ই জুলাই রাতে শিবির তাড়ানোর নামে মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসের ৩টি ব্লকের ৪২টি কক্ষ পুড়িয়ে দেয় ছাত্রলীগ। গত বৃহস্পতিবার সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন করে রঞ্জিত গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা কলেজের ভেতরে শোডাউন। খবর পেয়ে কলেজে অবস্থান নেয়ার প্রস্তুতি নেয় আজাদ গ্রুপের কর্মীরা। একপর্যায়ে আজাদ গ্রুপের কর্মীরা মিছিল নিয়ে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলে তাদের ধাওয়া করে রঞ্জিত গ্রুপ। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেই ঘটনার জের ধরেই রোববার টিলাগড়ে আজাদ গ্রুপের অনুসারীদের হামলায় নিহত হন সিলেট সরকারি কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তানিম খান। পরিকল্পিতভাবে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর আগে গত বছরের ১৬ই অক্টোবর টিলাগড়ে আজাদ গ্রুপের অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রায়হান চৌধুরীর অনুসারীদের হাতে খুন হন রঞ্জিত গ্রুপের অনুসারী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিরণ মাহমুদ নিপু গ্রুপের কর্মী ওমর মিয়াদ। নিহত মিয়াদ সিলেট এমসি কলেজে বিএসএস এবং লিডিং ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ের ছাত্র ছিলেন। মিয়াদ হত্যাকাণ্ডের জেরেই বাতিল করা হয় সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটিও। এছাড়াও গত বছরের ১৩ই সেপ্টেম্বর শিবগঞ্জ এলাকায় প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ছাত্রলীগের কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম। পূর্ব বিরোধের জের ধরে মাসুমকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। সিলেট আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন- আজাদ ও রঞ্জিতের কর্মকাণ্ডে তারা বিব্রত। তাদের বিরোধে একের পর এক খুনের ঘটনায় দলের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। এখনই এই মৃত্যুর মিছিল না থামালে দলীয় শাস্তির খড়গ নামবে আজাদ ও রঞ্জিতের ওপর।সূত্র-মানবজমিন
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd