হারানো সূর্যসন্তানদের স্মরণ করল জাতি

প্রকাশিত: ১২:২৮ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৭

ডেস্ক নিউজ : জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করতে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে এসে অসাম্প্রদায়িক ও শোষণহীন সমাজ গড়ার শপথ নিল নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। ছবি : মঞ্জুরুল করিম
বাংলাদেশের বিজয়ের উষালগ্নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নিহত জাতির সূর্যসন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করল দেশবাসী। গতকাল বৃহস্পতিবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে লাখো মানুষের ঢল নামে শহীদদের মর্মস্পর্শী স্মৃতিবিজড়িত মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে।
কুয়াশামাখা সকালে বুকে কালো ব্যাজ, হাতে ফুল ও ব্যানার নিয়ে নানা বয়সের মানুষ ছুটে যায় শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। তারা শপথ নেয় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ারও। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সকালে মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, বিবি, পিএসসি ফুল দিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের নেতারা ছাড়াও সর্বস্তরের মানুষ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
দিবসের কর্মসূচির মধ্যে ছিল আলোচনা অনুষ্ঠানও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) এ আলোচনাসভার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বক্তারা সাম্প্রতিক কয়েক বছরে টার্গেট কিলিংয়ে লেখক, অধ্যাপকসহ মুক্তমনাদের হত্যার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, মুক্তবুদ্ধির চর্চা আটকাতে একাত্তরের পরেও থেমে নেই বুদ্ধিজীবী হত্যা।
গতকাল সকাল ৭টা ৫ মিনিটে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি।
এরপর রাষ্ট্রপতি সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের খোঁজখবর নেন। এর আগে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ স্মৃতিসৌধে পৌঁছলে মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্য, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা তাঁকে স্বাগত জানান।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, চিফ হুইপ এ এস এম ফিরোজ, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, তিন বাহিনীর প্রধানরা এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের পৃথকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত বিদেশে পলাতক আসামিদের যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সরকারের প্রক্রিয়া চলছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘জামায়াতের পরিকল্পনায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়েছিল। জামায়াত নিষিদ্ধের আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ’
আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পদচারণে সকাল থেকেই মুখর হয়ে ওঠে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্ব্বে কেন্দ্রীয় ১৪ দলের পক্ষ থেকেও মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় ইনু বলেন, দেশকে শান্তির পথে নিতে হলে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ‘১৯৭১ সালে যে চেতনা ধারণ করে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। জনগণের আত্মমুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। ’
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ঢাকার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান প্রমুখ নেতাসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত ছিল। এর আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি, স্বপ্ন দেখেছি, সেই গণতন্ত্র আজ অনুপস্থিত। ’
রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে সকালের আলো ফোটার পরপরই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষের ঢল নামে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল বেশি। মোহাম্মদপুর থেকে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আসা সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আবির আহমদ প্রথমবারের মতো স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানায়। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে, বাবার মুখে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গল্প শুনে সে এখানে এসেছে। চার বন্ধু একসঙ্গে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করছিল সকালে। তাদের একজন রঞ্জন বড়ুয়া জানায়, প্রথমবার এখানে এসে তার অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সারা দিনই সৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হয়।
টিএসসিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনাসভায় উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা যে জঙ্গিবাদের কথা বলি, সে জঙ্গিবাদকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল ওই বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ। ’
একাত্তরের পরেও ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা’ থেমে নেই মন্তব্য করে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর আক্রমণ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যাসহ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুক্তমনাদের কুপিয়ে হত্যার প্রসঙ্গ টানেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল।
যথাযোগ্য মর্যাদায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত, কালো পতাকা উত্তোলন ও কালো ব্যাজ ধারণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়েছে। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, কর্মকর্তা সমিতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের সামনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী ও তাদের দোসররা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিশিষ্টজনদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। জাতিকে মেধাশূন্য করতে তারা টার্গেট করেছিল দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, দার্শনিকসহ সমাজের নানা পেশার মানুষকে।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

December 2017
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  

সর্বশেষ খবর

………………………..