সিলেট ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
প্রকাশিত: ২:৪২ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৭, ২০১৭
কুলসুম বেগম (৪৫)। গলাচিপার পানপট্টি ইউনিয়নের গুপ্তেরহাওলা গ্রামের বাসিন্দা।
স্বামী দিনমজুর। এক মাস আগে বাঁ হাতের বাহুতে একটি ফোড়া হয়। গ্রাম্য চিকিৎসকদের পরামর্শে অপারেশন করাতে গলাচিপা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার মো. ইমাম সিকদারের কাছে যান। চিকিৎসক তাঁকে ভর্তি করে জরুরি বিভাগেই অপারেশনের কাজ সারেন। এরপর ওষুধ লিখে দেন। পরামর্শ দেন ড্রেসিং করার। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সবই করেন কুলসুম।
কিন্তু অপারেশনের দুই সপ্তাহ পার হলেও কুলসুমের ঘা শুকায়নি। বরং অপারেশনের জায়গায় সাদা দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
বেড়েছে চুলকানি। ক্ষতস্থানের চারপাশে কয়েক ইঞ্চি ফোসকা উঠে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সার্বক্ষণিক ব্যথায় ছটফট করছেন তিনি। গত পাঁচ দিনে তাঁর অবস্থার আরো অবনতি হয়। বাঁ হাতের বাহু অনেক ফুলে উঠেছে। মঙ্গলবার চিকিৎসক ইমাম সিকদার তাঁকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
এমনটা কেন হয়েছে—প্রশ্নের জবাবে ওই চিকিৎসক বলেন, ‘কিছু বুঝতে পারছি না। দেড় মাস ধরে এ অবস্থা চলছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। হয়তো অজানা কোনো জীবাণু এ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ আক্রমণ করেছে। জরুরি বিভাগে কাটা-ছেঁড়া বা সেলাইয়ের কোনো কাজ করলেই অজানা জীবাণুতে আক্রমণ করে। রোগীরা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ জন্য আমরা একবার জীবাণুমুক্ত করতে জরুরি বিভাগ ওয়াশ করেছি। কিন্তু ফল শূন্য। এখন জরুরি বিভাগের সব কাজ বারান্দায় বসে করা হয়। বিষয়টি নিয়ে কর্মরত স্টাফসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ’
শুধু কুলসুম বেগমেরই এ অবস্থা নয়। এমনকি ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরতরাও ভুগছেন অজানা জীবাণুর আক্রমণে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট রেডিওলজি মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘আমার প্রায় দেড় মাস আগে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের নখে ব্যথা শুরু হয়। তারপর ওখানে অজানা জীবাণুর সংক্রমণে ক্ষত হয়। চিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে ওষুধ খেয়েও এখন পর্যন্ত সুস্থ হতে পারিনি। মূলত জরুরি বিভাগটি জীবাণু সংক্রমিত। প্রতিদিন কাজের তাগিদে জরুরি বিভাগ আসা-যাওয়া করতে হয়। এখানে কর্মরত সবাই আমরা আতঙ্কে রয়েছি। অন্যত্র বদলি হয়ে যেতে পারলে বেঁচে যেতাম। জানি না কখন শরীরিক কী সমস্যায় আবার পড়ে যাই। ’ ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ডবয় আব্দুল মোতালেবের বাঁ হাতে অ্যালার্জিজনিত সমস্যা দেখা দেয়। জীবাণু সংক্রমণের কারণে তাঁর ওই হাতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এতে সারা শরীরে ব্যথা থাকে সব সময়। বর্তমানে মোতালেবের ওই হাত নাড়াতে ভীষণ কষ্ট হয়। ওই সমস্যার কারণে তিনি বুকের খাঁচার মধ্যে ব্যথা অনুভব করছেন খুব বেশি। বুধবার শরীরের ওই সমস্যা সমাধানের জন্য ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। এ ছাড়া উপজেলার মুরাদনগরের সুমন, পৌরসভার মুসলিমপাড়ার তোফায়েল, চিকিৎসক সহকারী মমতাজ বেগমের ছেলে রাফি, কলেজপাড়ার যুবলীগ কর্মী রুবেল, আনন্দপাড়ার ঝন্টু দেবনাথ, কলেজ রোড সাহা বাড়ির নেপাল সাহার ছেলে রাজেনসহ এলাকার অনেকেই জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে ওই অজানা জীবাণুতে আক্রান্ত।
গলাচিপা উপজেলায় প্রায় চার লাখ লোকের বাস। সবাই প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এটি এখন সবার জন্য আতঙ্ক। অসুস্থ হলে রোগীরা ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন আর চিকিৎসা নিতে আসেন না। যাঁরা বিষয়টি জানেন না তাঁরা কেবল ওখানে আসেন। আর এর মধ্যে থেকে অনেকই ওই জীবাণুতে সংক্রমিত হচ্ছেন। দেড় মাস ধরে চলছে এ অবস্থা। ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি নিয়ে জানাজানি হওয়ায় অনেক লোকজনই ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দেড় মাস আগেও বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১৩০ থেকে ১৫০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসত। কিন্তু মঙ্গলবার এ সংখ্যা ছিল অর্ধেক এবং বুধবার রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৫। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পটুয়াখালী সিভিল সার্জনকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন মঙ্গলবার।
এ ব্যাপারে গলাচিপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইমাম সিকদার বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে গেলে আমরাও ভয়ে আছি। দেড় মাস ধরে এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ হচ্ছে না। আমি নিজেই এ ধরনের ১৫ জন রোগী নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। তাঁদের ঢাকা পাঠিয়েছি। কিন্তু তাঁরা সুস্থ হয়েছেন কি না জানতে পারিনি। ’ তিনি আরো বলেন, ‘মঙ্গলবার পটুয়াখালী সিভিল সার্জন ও আইইডিসিআর কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’ পটুয়াখালী সিভিল সার্জন ডা. শাহ্ মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তার চিঠি পেয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ ইনস্টিটিউট অব ইপিডিমোলজি ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্স (আইইডিসিআর) কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক। আশা করি, তাদের একটি টিম দ্রুত গলাচিপায় গিয়ে গবেষণা করে জীবাণু শনাক্তসহ ধ্বংস করার ব্যবস্থা নেবেন।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd