‘থার্টি ফার্স্ট’ বাংলা সংস্কৃতির এক কালো ছায়া

প্রকাশিত: ৩:৫২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৭

Manual4 Ad Code

 

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : নতুনের আবাহন শাশ্বত। সময় ও কালের চিরায়ত নিয়মানুযায়ী পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে সূচনা হয় নতুনের। ঠিক সেই নিয়ম অনুসারেই পরিবর্তন এসেছে আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারের শিরোনামে। ২০১৭-কে বিদায় জানিয়ে নতুন করে পদযাত্রা শুরু হবে ২০১৮ সালের। ‘১ জানিুয়ারী’-কে বলা হয় ইংরেজি নববর্ষের প্রথমদিন। খ্রিষ্টীয় নববর্ষ হিসেবে ‘১ জানুয়ারি’ উৎযাপন শুরু হয় কয়েকশ’ বছর আগে। সর্বপ্রথম নববর্ষ উৎযাপন শুরু হয় খ্রিষ্টের জন্মের দু’হাজার বছর আগে। আর সে সময় ‘১ মার্চ’-কে বলা হতো নববর্ষের প্রথম দিন। কারণ রোমান দিন পঞ্জিকা অনুসারে মার্চ থেকে ডিসেম্বর এই দশ মাসে বছর গণনা হতো।১ জানুয়ারি নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে গণনা শুরু হয় খ্রিষ্টের জন্মের ১৫৩ বছর আগ থেকে। সে সময় জুলিয়াস সিজার প্রাচীন রোমান দিন পঞ্জিকায় ১ জানুয়ারিকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে অন্তুর্ভুক্ত করেন।

মধ্যযুগীয় সময়ের ৫৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি চালু হয়। তবে ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ন দিন পঞ্জিকা অনুযায়ী ১ জানুয়ারি বছরের প্রথম দিন হিসেবে চালু করা হয়। আর বৃটিশরা তাদের পার্লামেন্ট গ্রেগরিয়নদের ক্যালেন্ডারকে নিজেদের ক্যালেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করে (দৈনিক সমকাল, ১ জানু, ২০১৩)। যাই হোক সময় ও কালের বিবর্তনে মানুষ ১ জানুয়ারিকেই ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে গ্রহণ করেছে।বিশ্বায়নের সুবাদে সারা বিশ্ব আজ এক সমীকরণে মিলিত হয়েছে । আন্তর্জাতিক কারণে এর মৃদু বাতাস সংস্কৃতিতেও বইছে। বিগত প্রায় বিশ ববছর ধরে বাংলাদেশে ঘটা করে এ উৎসব পালন করা হচ্ছে।কিন্তু এই উৎসবকে ঘিরে বাঙালি যে স্বপ্নিল আয়োজন করে চলছে তার লাভ বা স্বার্থকতা কতটুকু তা বিবেচনার বিষয়। কারণ এটি বাঙালির যাবতীয় উৎসবের সাথে বেমানান।

উৎসব আনে জীবনের ছন্দপতন, প্রতিদিনের তুচ্ছতার যবনিকা উত্তোলন, আত্মার দিগন্ত প্রসারণের চলন্তিকা।উৎসব মিলন, শান্তি ও মৈত্রীর ত্রিবেণী বন্ধন। সর্বজনীন কল্যাণের মহান ব্রতই উৎসবের মূল প্রেরণা।সমাজ সচল,জীবন চলিঞ্চু।কাল ও মহাকালের রূপান্তরে উৎসবের রূপান্তর ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে একটি জাতির জাতীয় চরিত্রে সংগুপ্ত প্রাণশক্তিকে বিসর্জন দিয়ে পরগাছার মতো বিদেশি সংস্কৃতিকে লালন করে উৎসব করার কোনো মানে নেই।অর্থ অপচয় এবংব্যভিচারসহ হেন কোনো কাজ নেই যা থার্টি ফার্স্ট নাইট নামক তথাকথিত উৎসবকে কেন্দ্র করে হয় না। আর এ সবকিছুই চালানো হচ্ছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না সংস্কৃতি আসলে কী। ফলে আমরা না জেনেই সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির ফেরি করে বেড়াচ্ছি।

Manual2 Ad Code

তাই আমাদেরকে আগে সংস্কৃতি কী তা ভালোভাবে বুঝতে হবে। সংস্করণ,সংস্কারকরণ, বিশুদ্ধিকরণ,অনুশশীলনলব্দ দেহ-মন-হৃদয় ও আত্মার উৎকর্ষ সাধনই সংস্কৃতির উপাচার। সংস্কৃতি হলো মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে টিকে থাকার কৌশল, যা নির্ভর করে ভৌগোলিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর। সংস্কৃতির মূল উদ্দেশ্য সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের প্রচেষ্টা।

সমাজের সব অসত্য, অন্যায়-অনাচার এবং কুসংস্কার দূর করে সত্য ও সুন্দরের চর্চা করাই সংস্কৃতির আশ্রয়। সুস্থ সংস্কৃতি জাতির প্রাণপ্রবাহকে পুষ্ট করে।তাই সমাজ জীবনে সংস্কৃতির গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু সংস্কৃতির নামে এই ‘থার্টিফার্স্ট নাইট’ বা ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ উদযাপন এমনই একটি অপসংস্কৃতির নাম, যা কোনো রুচিশীল মানুষেরই সমর্থন করা উচিত নয়। তাই আমাদের নিজস্বতাকে পাশ কাটিয়ে পাশ্চাত্যরীতির এই অপসংস্কৃতিকে বরণ করা মানে অন্ধকারে নিজেকে ঠেলে দেওয়া; যা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। কিন্তু অতীব দুঃখের কথা , বাংলাদেশ বাঙালি সংস্কৃতির বদলে বংশবিস্তার হয়েছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির। আর এর মূলে রয়েছে পশ্চিমাদের কিছু দালালগোষ্ঠী আর ভোগবিলাশি পুঁজিবাদীরা।

যারা নিজেদের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে এসব অপসংস্কৃতির বিষবৃক্ষকে নিরন্তর রোপণ করে যাচ্ছে।আবার এমন কিছু সেক্যুলার লেখক-প্রকাশকও আছে যারা পবিত্র কলমকে নষ্টামি চর্চায় ব্যবহার করে এদেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে। এই অভিশপ্ত পথের পথিক কিন্তু বড়রাও কম নয়। যারা জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেদারছে তা গ্রাস করছে আবার নিজেদেরকে খাঁটি বাঙালি বলেও পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু তারা এটা বুঝতে চেষ্টা করছে না যে, এই অপসংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে যাচ্ছে কি-না তা ভাবার বিষয় । অথচ এসব কাজের দ্বারাই কিন্তু তারা বাঙালি সংস্কৃতি থেকে অনেক দূরে ছিঁটকে পড়ছে। অপসংস্কৃতি চিত্তকে কলুষিত করে,জীবনবোধকে বিকৃত করে এবং মূল্যবোধকে বিপন্ন করে।

Manual2 Ad Code

থার্টিফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে রাতভর চলে অশালীন ও বেহায়পনার মহোৎসব। যুবতীরা আটঁসার্ট, অশালীন ও অর্ধনগ্ন পোশাক পরিধান করে অবাধে চলাফেরা করে। থার্টি ফার্স্ট রাতে আয়োজিত হয় বিভিন্ন কনসার্ট। যেখানে নারী-পুরুষের একসঙ্গে গান-বাজনা, অশ্লীল নৃত্য আবশ্যকীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।এ রাতে আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করার জন্য মধ্যরাত থেকে শুরু হয় আতশবাজি ও পটকাবাজি। যা জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করে। এর দ্বারা অগ্নিসংযোগেরও আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া এসব কর্মকাণ্ডে জনসাধারণকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয়।

থার্টি ফার্স্ট রাত্রিতে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, সমুদ্র সৈকত, নাইট ক্লাবগুলোতে যুবক-যুবতীরা অবাধে মেলামেশা ও অপকর্মে লিপ্ত হয়। যা ইসলামের পরিভাষায় ব্যভিচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এখন কেউ যদি বলে আমরা খারাপ কিছু করব না শুধুমাত্র উৎসব উদযাপন করব তাহলে বুঝতে হবে এরাই ধোঁকাবাজ। এরা হয়তো আমাদের ধোঁকা দিচ্ছে, নয়তো তারা নিজেরাই ধোঁকায় পড়ে আছে।সুতরাং কোনো বাঙালির জন্য শুভনীয় নয় এসব অসভ্য ও বর্বরোচিত কালচার গ্রহণ করা। আমাদের খুব ভালো করে মনে রাখতে হবে যে, উৎসব হচ্ছে একটি জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধ। থার্টিফার্স্ট নাইট বা হ্যাপি নিউ ইয়ারের নামে সকল প্রকার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, হৈ-হুলোড় এবং নগ্নতার প্রদর্শনকে এড়িয়ে চলা।তাই আসুন! অন্যদের সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতিতে প্রবেশ না করিয়ে বরং নিজেদের সংস্কৃতিকে লালন করে বুকে ধারণ করি।

Manual8 Ad Code

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে একবার চিন্তা করুন,ফিলিস্তীন, ইরাক,আফগানিস্তান ও মিয়ানমারসহ সারা বিশ্বের লক্ষ-কোটি মুসলমান যেখানে খাদ্যাভাবে ক্ষুধার তাড়নায় না খেয়ে মরছে, যাদের আর্তচীৎকার ও নির্মম আহাজারিতে ভারি হচ্ছে আকাশ বাতাস, লুন্ঠিত হচ্ছে হাজারো মুসলিম মা-বোনের ইজ্যত, সে সময় মিলিয়ন মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে কিসের নেশায় মত্ত হয়েছে? দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ সকল আয়োজনে উন্নত ও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে পিছিয়ে পড়ে নেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত আমাদের এই বাংলাদেশ। রাজধানী রূপালি বাংলা পাঁচতারা হোটেলগুলোসহ দেশের সবগুলো জেলার নামিদামি হোটেলগুলোতেও আয়োজন করা হয় বর্ষ বরণের বিভিন্ন স্বপ্নিল অনুষ্ঠানের। বিভিন্ন জায়গায় আয়োজন করা হয় বড় বড় কনসার্টের।

Manual3 Ad Code

আর সে সকল কনসার্টের মঞ্চ কাঁপাতে দেশের বড় বড় শিল্পীও শিল্পগোষ্টীকে অনেক আগে থেকেই সিরিয়াল দিয়ে নিয়ে আসা হয় একটু বেশি দামে। অনেক আগে থেকেই বুকিং চলে ডেকোরেশন ও কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে। আর এসকল আয়োজনের মধ্যদিয়ে সন্ধ্যা থেকে নেচে গেয়ে যখনই রাত ১২টা বাজে সবাই মিলে হৈচৈ করে আতশবাজি ও পটকা ফুটিয়ে আর বাহারি স্বাধের খাবার খাওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে। আর এক শ্রেণীর মানুষ (?) মদ, আফিম, ফেনসিডিল ভক্ষণ করে মেতে উঠে জঙ্গলের হিংস্র হায়নার মত উন্মাদ হয়ে মহাযজ্ঞের সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক কর্ম নারী ভোগের মরণ নেশায়। এই একটি রাতকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের লক্ষ-কোটি নারীর সতিত্বের শুভ্র আবরণে কলঙ্কের কালিমা লেপন করে রাতের নিকোশ কালো আধার কাটিয়ে ভোরের সোনালি সূর্যের উদয় ঘটে।

এখান থেকেও পিছিয়ে পড়ে নেই সোনার বাংলার সোনার ছেলে মেয়েরা। অথচ মানবতার কল্যাণে নিহিত সবকিছুই রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতিতে । তাই অন্যের সংস্কৃতি ফেরি করা কিংবা চর্চার কোনো প্রয়োজন নেই। নতুন বছরে আমাদের সবার সংকল্প হোক- আগামী দিনগুলোতে একমাত্র বাঙালি সংস্কৃতিই হোক আমাদের নিত্যকার সঙ্গী।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

December 2017
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  

সর্বশেষ খবর

………………………..