স্থানীয় ক্ষমতার দাপটে বেসামাল ছাত্রলীগ

প্রকাশিত: ১:৩৮ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৩

স্থানীয় ক্ষমতার দাপটে বেসামাল ছাত্রলীগ

Manual4 Ad Code

ডেস্ক রিপোর্ট: শিক্ষা, শান্তি আর প্রগতি স্লোগানের সংগঠন ছাত্রলীগ এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থী নির্যাতন, অপহরণ, ছিনতাই, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সংঘর্ষ এবং সিট বাণিজ্যসহ নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে একশ্রেণির নেতাকর্মী বিতর্কিত করছেন সংগঠনকে। তারা স্থানীয় ক্ষমতার দাপটে বেসামাল হয়ে পড়েছেন।

Manual6 Ad Code

 

অথচ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুবই সামান্য। কখনো তৃণমূলের এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলে নামমাত্র সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিছুদিন পার হলেই এদের অনেককে দায়মুক্তি দিয়ে ফের সংগঠনে নিয়মিত করা হয়। গ্রুপিংয়ের রাজনীতি এবং স্থানীয় ক্ষমতার প্রভাব অপরাধীদের সংগঠনে ভেড়ানোর এ পরিবেশ তৈরি করেছে। ফলে ছাত্রলীগকে সুনামের ধারায় ফেরাতে বহুমুখী উদ্যোগ নিলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ছে।

 

গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২৩টি আলোচিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তবে এসব ঘটনার দায় একা নিতে নারাজ ছাত্রলীগ। তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

 

Manual1 Ad Code

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, এখনো আমাদের ক্যাম্পাসগুলোতে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে, সে কারণেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। আসলে আমাদের ক্যাম্পাস সংস্কৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন দরকার। ‘এন্টি র‌্যাগিং মুভমেন্ট’ খুব জোরালোভাবে প্রয়োজন। এর পাশাপাশি নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে ইতিবাচক ছাত্র রাজনীতির ধারা তৈরি হবে।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুন নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট, ক্যান্টিনের খাবারের মানোন্নয়নসহ বেশ কিছু ইতিবাচক কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। নিয়মিত ইতিবাচক কাজের নির্দেশনা ও বক্তব্যও দিয়ে যাচ্ছেন। তবে তৃণমূলের চিত্র সম্পূর্ণ উলটো। তাদের অধিকাংশই কেন্দ্রের নির্দেশনা না মেনে শিক্ষার্থীবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ক্যাম্পাসগুলোতে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছেন।

 

আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ব্যবহার হচ্ছেন ক্ষমতার লাঠিয়াল হিসাবে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সামগ্রিক কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করছেন। আওয়ামী লীগের গ্রুপিংয়ের প্রভাব পড়ছে ছাত্র সংগঠনটির ওপরও। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহীসহ বড় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে ছাত্রলীগের ওপর প্রভাব বিস্তারের সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশি। ফলে স্বাধীনভাবে কাজ করে স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারছে না ছাত্রলীগ।

 

গত তিন কমিটির চার নেতা সংগঠন পরিচালনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, কোনো ইউনিটের কমিটি গঠন করতে গলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা হস্তক্ষেপ করেন। তাদের পছন্দের বাইরে গিয়ে কমিটি দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ওইসব নেতার পছন্দের লোক কমিটিতে নেওয়ায় তারা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কথা সেভাবে মানতে চায় না। স্থানীয় নেতাদের মতকে প্রাধান্য দিয়েই তারা সিদ্ধান্ত নিতে চায়। সেই কমিটির নেতারা যখন কোনো অপকর্মে জড়ায় তার দায় এসে পড়ে ছাত্রলীগের ওপর। স্থানীয় নেতারা এর দায় নিতে চান না। অনেক সময় অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও তারা উলটো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।

 

সম্প্রতি ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে সঙ্গে কথা হয় ১৯৭০-১৯৭২ সালে সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্বে থাকা নূরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি বলেন, যদি সংগঠনের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে কলেবর বৃদ্ধি করে কোনো লাভ নেই। এতে অনাসৃষ্টি বাড়ে। অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সংঘাত, সংশয় সৃষ্টি হয়। আমাদের সময়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সংগঠনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখেই আমরা সব করেছি। কিন্তু ছাত্রলীগ স্বাধীন-সার্বভৌমভাবেই আন্দোলনগুলো সংগঠিত করেছে, রূপরেখা তৈরি করেছে। তখন বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও আমাদের স্বকীয়তা ছিল। আমাদের কর্মসূচি আমরাই গ্রহণ করতাম এবং বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করতাম। আমাদের সময় সংগঠন ছিল সবার ওপরে। বঙ্গবন্ধু চেতনার প্রতীক ছিলেন। কিন্তু তখনকার ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছিল না। এখনকার আর তখনকার মূল পার্থক্যটা এখানেই। এখন ছাত্রলীগ অঘোষিত অঙ্গসংগঠন হয়ে গেছে। তখন ছাত্রলীগ সম্পূর্ণভাবে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম স্বকীয় সত্তায় উজ্জীবিত ছিল।

 

গত এক মাসের মধ্যে ছাত্রলীগের সবচেয়ে আলোচিত বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে এক নবীন ছাত্রীকে রাতভর নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রীর অভিযোগ, ‘হলের গণরুমে ডেকে নিয়ে সারে চার ঘণ্টা তাকে নির্যাতন করা হয়। বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়।

 

একপর্যায়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে নির্যাতন করা হয়। একটি ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করান নেত্রীরা। এ ঘটনা কাউকে জানালে তাকে জীবননাশ ও ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেওয়া হয়।’ ঘটনার পরদিন ভয়ে ক্যাম্পাসছাড়া হন ভুক্তভোগী ছাত্রী।

 

কেবল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বিভিন্ন ক্যাম্পাসেই হরহামেশা ঘটছে এমন ঘটনা। গত বুধবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) ছাত্রলীগ দুই শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করে। পরে ছাত্রাবাস থেকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে তাদের হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। গত ৩০ দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচিত পাঁচটি ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ।

 

Manual7 Ad Code

এর মধ্যে রয়েছে-হল নেতার বঙ্গবাজার এলাকায় চাঁদাবাজি, এফএইচ হলে রুম দখল নিয়ে রাতভর সংঘর্ষে ১১ জন আহত, টিএসসিতে সংগীতশিল্পীর ওপর হামলা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিনতাই এবং সর্বশেষ শুক্রবার ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা।

Manual2 Ad Code

 

এছাড়া এই ক্যাম্পাসের রোকেয়া হলসহ কয়েকটি হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচিত তিনটি ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। এর মধ্যে রয়েছে-হিন্দু শিক্ষার্থীকে শিবির আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকি ও নির্যাতন, ছাত্রলীগ নেতার সিট দখল এবং নবীনবরণ অনুষ্ঠানে হামলার ঘটনা।

 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাকি না দেওয়ায় ক্যান্টিনকর্মীকে মারধর করেছে ছাত্রলীগ নেতা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত চারটি ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারবার নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে নেতাকর্মীরা। ৩০ জানুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করেছে তারা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেছে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা। ১৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের মীরসরাই কলেজে ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ১০ জন।

 

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষার পরিবেশের প্রধান শর্তই হলো নিরাপত্তা থাকবে। শিক্ষার্থীর যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে তো পরিবেশ তৈরি হলো না। আর এই পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের।

 

ক্যাম্পাসগুলোতে অরাজক পরিস্থিতির জন্য আরেকটি কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। ফলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। এজন্য কোনো জবাবদিহিতাও নেই, সহনশীলতার পরিবেশ নেই। যারা সরকারি দলের সমর্থক তারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। এর বিপরীতে কোনো শক্তি না থাকায় তারা যেমন খুশি তেমন করে। ছাত্র সংসদ থাকলে তারা প্রশাসনকে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় এক ধরনের চাপ দিতে পারত।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

February 2023
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728  

সর্বশেষ খবর

………………………..