স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও শাবি প্রতিষ্ঠার অজানা কাহিনী

প্রকাশিত: ১২:২৫ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১১, ২০২০

স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও শাবি প্রতিষ্ঠার অজানা কাহিনী

মুকতাবিস-উন নূর :: একজন সফল কূটনীতিক, সফল মন্ত্রী ও সফল স্পিকার সর্বোপরি একজন নিখাদ সিলেটি ছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। আজ ১০ জুলাই তাঁর ১৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর রূপকার। সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অর্ধ শতাব্দীর দাবি তাঁর হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি শাবি’র এই রূপকারকে শাবিই ভুলে গেছে।

শীর্ষ আমলাসহ রাস্ট্রীয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা এই মহৎপ্রাণ মানুষটি ছিলেন একজন সত্যিকার ভদ্রলোক। রাজনীতির খেলোয়াড় না হয়েও স্পিকারের আসনে তিনি ছিলেন সফল। তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ইতিহাস হয়ে আছে। একজন নিরহংকার, সৎ ও সাদামনের মানুষ ছিলেন তিনি। স্বাধীনতা উত্তরকালে সিলেটের উন্নয়নে যে ৩/৪ জনের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়, তাদের অন্যতম মরহুম হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী।

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী রশীদ পরিবারের এই সুসন্তান সিলেটের উন্নয়ন নিয়ে সবসময় ভাবতেন। সিলেটের দৃষ্টিনন্দন রেল স্টেশনসহ অনেক পরিকল্পনা তাঁর ছিল। যদিও রাজনীতির ঠেলাধাক্কায় তাঁর সব আকাঙ্ক্ষা বাস্তব রূপ লাভ করেনি। সিলেটের উন্নয়নের বরপুত্র সাইফুর রহমান সাহেবকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন। অথচ সাইফুর রহমান ছিলেন রাজনীতির মাঠে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী।

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেবের সাথে আমার পরিচয় নাটকীয়ভাবে। সিলেটের সাংবাদিকতার অন্যতম প্রাণপুরুষ সিলেটের প্রাচীনতম পত্রিকা সাপ্তাহিক যুগভেরী সম্পাদক আমীনূর রশীদ চৌধুরী সাহেব ছিলেন তাঁর বড় ভাই। আমীনূর রশীদ চৌধুরী সাহেব যখন সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি (১৯৮৩-৮৪) তখন আমি প্রেসক্লাবের কোষাধ্যক্ষ। সেই হিসাবে হুমায়ুন রশীদ সাহেবকে চিনতাম, ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন।

১৯৮৬ সালে হুমায়ূন রশীদ সাহেব এরশাদ সাহেবের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা পদে যোগ দিলেন। সেই সময় তাঁর সম্মানে সিলেট পৌরসভায় আয়োজন হলো নাগরিক সংবর্ধনার। সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান তখন আ ফ ম কামাল। আমি তখন সিলেট প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। নাগরিক সংবর্ধনায় চলছে বিরামহীন বক্তৃতা। আমি মধ্যম সারিতে বসা। আমার পাশে উপবিষ্ট সিলেটের বিদগ্ধজন মুসলিম চৌধুরী। বক্তাদের তেল ও স্তুতিবাজীতে ত্যক্ত বিরক্ত মুসলিম চৌধুরী আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ নবী বানাইদের বা, তোমারে তো ডাকবো, দেখিও’।

পদাধিকার বলে আমার ডাক পড়লো ক্ষাণিক পরই। আমি প্রথমে রশীদ পরিবারের ঐতিহ্য তুলে দু’চার কথা বলার পরই বললাম, সিলেট থেকে আগে অনেকে মন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু কালের গর্ভে তাঁরা হারিয়ে গেছেন। একইভাবে আজকের সংবর্ধিত ব্যক্তিও ‘ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে’ নিক্ষিপ্ত হবেন, যদি না তিনি সিলেটের জন্য স্থায়ী কিছু করে যেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টি অগ্রগণ্য।

আমার বক্তব্য দর্শকদের বিপুল করতালি পেলো। সভাপতির চেয়ারে বসা আ ফ ম কামালকে বিমর্ষ মনে হলো। তিনি আমার কাছ থেকে এতটা কড়া বক্তব্য হয়তো আশা করেন নি। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম তাঁর চেহারা লাল হয়ে গেছে। এমনিতেই তিনি উজ্জ্বল গৌরবর্ণের অধিকারী ছিলেন।

আমার বক্তব্যে স্তাবক শ্রেণির কেউ কেউ আমাকে বেয়াদবও ঠাওরালেন। স্বস্থানে ফিরে আসার পর মুসলিম চৌধুরী বললেন, দোয়া করি তুমি অনেক বড় হও। আমার বক্তব্যের পর পরিবেশ পাল্টে গেলো। স্তাবকতা তেমন আর নেই।

এক পর্যায়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বক্তব্য দিতে ডায়াসে এলেন। তাঁর বক্তব্যের অধিকাংশ কথাই আমাকে কোট করে। নাতিদীর্ঘ বক্তব্যের শেষ কথা ছিলো, দেখি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারি কী না। আপনারা দোয়া করবেন যেনো ‘ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত না হই’। হুমায়ুন রশীদ সাহেবের বক্তৃতায় বুঝলাম আমার কথায় তিনি কষ্ট পেয়েছেন। তবে সভাশেষে দর্শকদের অনেকেই আমার সাথে হাত মিলিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। শুধু পৌর চেয়ারম্যান আ ফ ম কামাল বললেন, নূর সাহেব এত কড়া করে না বললেও পারতেন।

রাতেই ডাক পড়লো সার্কিট হাউসে। হুমায়ুন রশীদ সাহেবের কাছে বসা আ ফ ম কামাল। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দাঁড়িয়ে হাত মেলালেন। হেসে বললেন, আপনার বক্তব্যে প্রথমে কষ্ট পেয়েছিলাম, ভেবে দেখলাম আপনার কথা সত্য। আমি বললাম, আপনাকে আঘাত দেওয়ার জন্য নয়, কর্মস্পৃহা বাড়ানোর জন্য এমনটি বলেছি। সেই সাথে অনুরোধ করলাম, আমাকে তুমি সম্বোধনের। বললাম আপনার বয়স আমার দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু অতিশয় ভদ্রলোক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বললেন, না না, আপনি আমার বড় ভাইয়ের কলিগ।

চা পান শেষে ওঠার সময় আবারো দাড়িয়ে গেলেন তিনি। এরপর যা বললেন, তাতে আমি বিস্ময়ে বিমুঢ়। বললেন, ইনশাআল্লাহ, সিলেটে ইউনিভার্সিটি হবে। না পারলে এ পদ ছেড়ে দেবো। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাঁটার পর বললাম, ইনশাআল্লাহ আপনি সফল হবেন। হুমায়ুন রশীদ তাঁর কথা রেখেছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে তিনি এরশাদ সাহেবের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এ কাহিনী যেমন চমকপ্রদ, তেমনি হুমায়ুন রশীদ সাহেবের নিখাদ সিলেট প্রেমের এক উজ্জ্বল নজীর।

হুমায়ুন রশীদ সাহেব প্রেসিডন্ট এরশাদকে খোশমেজাজে দেখে একদিন বললেন, আপনার কাছে সিলেটের একটি দাবি আছে, কথা দিন সেটা করে দেবেন। এরশাদ জানতে চাইলেন কী দাবি। ঝানু কুটনীতিক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বললেন, সময়মতো বলবো, আপনি কথা দিন করে দিবেন। এরশাদ হেসে বললেন, আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে করবো। হুমায়ুন রশীদ খুশি হয়ে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে এলেন।

এর কয়েক মাস পরই এরশাদ সাহেবের সৌদীতে রাষ্ট্রীয় সফর। ওমরাহ পালনের জন্য প্রেসিডেন্ট এরশাদ ক্বাবায় গেলেন, সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। প্রেসিডেন্ট এরশাদের সম্মানে ক্বাবা ঘর খুলে দেওয়া হলো। ক্বাবা ঘরে ঢুকে ২ রাকাত নামাজ আদায়ের পর হুমায়ুন রশীদ সাহেব এরশাদকে বললেন, সিলেটের একটি দাবির কথা বলেছিলাম, আপনি করে দেওয়ার ওয়াদা করেছিলেন। কথা দিন দেশে ফিরে প্রথম এ কাজটি করবেন। এহরাম পরিহিত এরশাদ সাহেব বিস্ময়ের সুরে বললেন, এটা কী এসব আলোচনার জায়গা? নাছোড়বান্দা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বললেন, এখানে কথা দিন দেশে ফিরেই সিলেটে ইউনিভার্সিটি স্হাপনের কাজ শুরু করবেন। এরশাদ সাহেব কথা না বাড়িয়ে বললেন, তাই হবে। হুমায়ুন রশীদ সাহেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। দেশে ফেরার সময় ফ্লাইটে এরশাদ সাহেব হুমায়ুন রশীদ সাহেব কে বললেন, ক্বাবা ঘরের ভিতরে কেন আমাকে ওয়াদা করালেন? হুমায়ুন রশীদ সাহেব জবাব দিলেন, নানামুখি চাপে আপনি পিছিয়ে পড়তে পারেন এই ভয়ে। এরশাদ সাহেব মুচকী হেসে বললেন, আপনি দেশে গিয়েই সাইট সিলেকশনের কাজে লেগে যান। আমি নিজে যাব সাইট ভিজিটে।

এরপর দেশে ফেরার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সাইট ভিজিটে এলেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। আমাকে এয়ারপোর্টে থাকার জন্য বলেছিলেন হুমায়ুন রশীদ সাহেব, যদিও আমি যাই নি। সে আরেক ইতিহাস। সময় সুযোগে অন্য কোথাও তা তুলে ধরা হবে।

একজন মানুষ কতটা আন্তরিক হলে, কতটা নাড়ির টান থাকলে এমনটি করতে পারেন? এরশাদ সাহেবের সর্বাধিক বিরোধিতা সিলেটে হয়েছিলো, এ কারণে সারাদেশে নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড হলেও সিলেট বঞ্চিত ছিলো। এরশাদ সাহেবের মান ভাঙ্গাতে সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধিদল প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। উদ্দেশ্য, সিলেট যেনো উন্নয়ন বঞ্চিত না হয়। এই সাক্ষাতের খবর টিভিতে প্রচারের পরদিন সিলেটে গণ দুশমনদের ২০ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে সিলেট আওয়ামী লীগ। যার প্রথম নাম ছিলো হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী’র। মজার ব্যাপার হলো আওয়ামী লীগের তালিকাভুক্ত ১ নম্বর গণদুশমনই পরবর্তীতে সিলেট -১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন।

হুমায়ুন রশীদ সাহেব যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে তখন অনেকে ব্যঙ্গ করে ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিলেট প্রাইভেট লিমিটেড’ বলতেন। কারণ তেমন কিছুই ছিলো না, শুধু সিলেটের জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ যে কোনো সময় তাঁর সাথে দেখা করতে পারতেন। এমনকী স্পিকার হওয়ার পরও সিলেটের মানুষের কাছে তাঁর দরজা ছিলো উন্মুক্ত। হুমায়ুন রশীদ সাহেবের এই গুণ পরবর্তীকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমদ চৌধুরী’র মধ্যেও পরিস্ফুট ছিলো।

হুমায়ুন রশীদ সাহেব স্পিকার থাকতে বার কয়েক জাতীয় সংসদ ভবনে গিয়েছি। তাঁর একান্ত সচিব হিসাবে ছিলেন সি কিউ এম মুশতাক ( পরবতীতে স্বরাষ্ট্র সচিব) ও নজিবুর রহমান (পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব)। এই দুই সিলেটি কর্মকর্তাও ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক মানুষ। তাঁরা সবাইকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতেন। পিএস সাহেবের সাথে গল্পগুজব শেষে ফিরতে চাইলে নজিবুর রহমান সাহেব বলতেন, স্যার শুনলে রাগ করবেন, দেখা করে যান। স্পিকারের চেম্বারে ঢোকামাত্র দরাজ গলায় বলতেন, নূর সাব, আউকা, আউকা। সে ডাক ছিলো আন্তরিকতাপূর্ণ। পিএস সাহেবের ওখানে চা খেয়ে এসেছি বলার পরও চা না খাইয়ে ছাড়তেন না। মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন, কী নূর সাব ইতিহাসে জায়গা পাবো তো? আমি সলজ্জ কন্ঠে জবাব দিতাম নিশ্চয়ই।

আজ তিনি পৃথিবীতে নেই, কিন্তু তাঁর অবিনাশি কীর্তি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একটি সেরা বিদ্যাপীঠ হিসাবে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যে মানুষটি এর রূপকার তাঁর নাম গন্ধ শাবি’র কোথাও নেই। এর চেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে? বলা হয় যে দেশে গুণীর ক্বদর নেই সেখানে গুণী জন্মায় না। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী’র মতো গুণীজনকে কেন শাবি সম্মান দিতে পারছে না, এর অন্তর্নিহিত কোনো কারণ আছে কী না আমার জানা নেই। আজ শুধু বলতে চাই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাঁর কীর্তির জন্য যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন সিলেটবাসির হৃদয়ের মণিকোঠায়।

লেখক: মুকতাবিস উন নূর, সম্পাদক- দৈনিক জালালাবাদ

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..