ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : লেখক শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবালের উপর হামলাকারী ফয়জুল হাসানের বাবা আতিকুর রহমান ১৬ বছর আগে সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে দিরাইয়ের কলিয়ার কাপনের বাড়ি তালাবদ্ধ করে সিলেটে চলে গেলেও ফয়জুর প্রায়ই লুঙ্গি-কাপড় বিক্রির অজুহাতে কলিয়ার কাপনে আসতো। স্থানীয়রা বলেছেন তাঁর চলাফেরা সন্দেহভাজন ছিল। তার পরিবারকে নিয়েও এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। গ্রামবাসী যেভাবে নামাজ পড়েন তারা ঐভাবে নামাজ আদায় না করে অন্য নিয়মে নামাজ আদায় করতো। ড. জাফর ইকবালের মতো গুণী মানুষকে আক্রমণের অপরাধে ফয়জুলের বিচার চান কলিয়ারকাপনবাসীও। এদিকে, ড. জাফর ইকবালের উপর হামলার ঘটনায় সুনামগঞ্জ জেলা শহরসহ পুরো জেলায় মানববন্ধন বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।
ফয়জুলের বাবা হাফিজ আতিকুর রহমান ১৬ বছর আগে দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের তারাপাশা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। এক বছর পর ঐ মাদ্রাসা ছেড়ে চলে আসেন দিরাই আলিয়া মাদ্রাসায়। ওখানে বছর খানেক শিক্ষকতা করার পর তিনি চলে যান সিলেটে। বাবার সঙ্গে সিলেটে চলে যায় ফয়জুরও। ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তৃতীয় সন্তান ফয়জুর সিলেট শহর থেকেই মাঝে-মধ্যে কলিয়ারকাপনে আসতো। লুঙ্গি-শাড়ি বিক্রি করতো কলিয়ারকাপন বাজারে। সে নামাজ পড়তো ভিন্ন নিয়মে। এজন্য ২ বছর আগে কলিয়ারকাপন মসজিদের মুসল্লিরা তাঁকে ঐ মসজিদে নামাজ আদায় করতে নিষেধ করেন। সর্বশেষ ৪ মাস আগে কিছু শাড়ি ও লুঙ্গি নিয়ে কলিয়ারকাপনে বিক্রি করতে আসে সে। এরপর আর তাকে কলিয়ারকাপন এলাকায় দেখা যায়নি বলে জানালেন স্থানীয়রা।
কলিয়ারকাপনে গিয়ে জানা যায়, ফয়জুলদের বাড়ীতে কেউ থাকেন না। তাদের বসতঘর তালাবদ্ধ। তার দুই চাচার পরিবারের লোকজন আত্মগোপনে চলে গেছেন।
স্থানীয় লোকজন জানান ফয়জুলের বাবা হাফিজ আতিকুর রহমান কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও আহলে সুন্নাতওয়াল জামায়াতের অনুসারী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পরিবার নিয়ে সিলেটে বসবাস ও সেখানে একটি মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। আতিকুর রহমানের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তিন নম্বর ফয়জুল। তার বড় দুই ভাই ও ছোট দুই বোন রয়েছে। হামলাকারী ফয়জুল হাসান (১৯) উপজেলার ধল দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করে। জন্ম সনদ অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৯৯ সালের ৫ জুলাই। বড় ভাই এনামুল হাসান ঢাকার একটি গার্মেন্টেসে চাকুরী করছে। মেঝো ভাই আবুল হাসান ৬ মাস হয় কুয়েত প্রবাসী।
এলাকাবাসী জানান, ফয়জুলের দুই চাচা আবদুল জাহার ও আবদুল সাদিক দীর্ঘদিন ধরে কুয়েত প্রবাসী। তারা সেখান থেকে আহলে হাদিস (লাÑমাযহাবি) এর দীক্ষায় দীক্ষিত হন। আব্দুল জাহারের ঢাকায়ও বাসাবাড়ী রয়েছে, নিয়মিত তিনি ঢাকায় আসা যাওয়া করেন। দেশে আহলে হাদিসের মতবাদ প্রচার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে তাদের। এলাকায় সেই মতবাদ প্রচার করতে চাইলে গ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সাথে তাদের বিরোধ দেখা দেয়। এলাকাবাসীর বাধায় তাঁরা কলিয়ারকাপন এলাকায় আর এই মতবাদ প্রচারের চেষ্টা করেননি।
তবে তাদের এক ভাই আব্দুল কাহার ও হামলাকারী ভাতিজা ফয়জুল হাসান আহলে হাদিসের অনুসারী হয়ে যান। চাচাদের মতাদর্শে আহলে হাদিসের অনুসারী হয়েই হামলাকারী ফয়জুল হাসান বাবার মতাদর্শের কওমী মাদ্রসা ছেড়ে ২০১১ সালে ধল সরকারি দাখিল মাদ্রসায় অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ধল গ্রামের এক বাড়িতে লজিংয়ে থেকে সেখান থেকে ২০১৪ সালে দাখিল পাশ করে সে। এরপর থেকে সে সিলেট থাকতো বলেই জানতো এলকাবাসী। মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়ীতে তার চাচা আহলে হাদিসের অনুসারী আব্দুল কাহার লুলই মিয়ার বাড়ীতে এসে দুয়েকদিন থেকে আবার চলে যেত। সর্বশেষ ৪ মাস আগে ফেরিওয়ালা হয়ে এলকায় এসে লুঙ্গি গামছা বিক্রি করেছে সে।
কলিয়ারকাপন গ্রামের দিল আমিন বলেন, হামলাকারী ফয়জুলের দুই চাচা বিদেশে থাকে, দেশে এলে তারা ভিন্নভাবে নামাজ পড়তো, এজন্য গ্রামবাসী তাদের উপর ক্ষুব্ধ হয়। তিন চার বছর হয় তার চাচারা দেশে আসলেও এলাকায় আসে নি। শুনেছি তারা ঢাকায় আসে আবার সেখান থেকে চলে যায়। ফয়জুল কিছু দিন পরপর বাড়িতে আসে।’
সাবেক ইউপি সদস্য ও গ্রাম পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি আব্দুস শীষ বলেন, ‘ফয়জুল হাসানের দাদা তার সন্তানদেরকে আহলে সুন্নাতওয়াল জামায়াতের মতাদর্শে লেখাপড়া করিয়েছেন। এরপর থেকে তারা গ্রামের মানুষের সঙ্গে বেশি মিশতে পারতো না।’
কলিয়ারকাপন গ্রামের মসজিদের ইমাম হাফেজ মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘দুই তিন বছর আগে মসজিদে নামাজ আদায় নিয়ে ফয়জুল এবং তার চাচা আব্দুল কাহার ও প্রবাসী দুই চাচার সঙ্গে গ্রামের মুসুল্লিদের বিরোধ দেখা দেয়। এরপর আর তারা এই মসজিদে আসেন নি।
ধল দাখিল মাদ্রাসার সুপার ফারুক আহমেদ জানান, ধল দাখিল মাদ্রসায় ফয়জুল হাসানের জন্ম তারিখ লিখা রয়েছে ৫ জুলাই ১৯৯৯, সে ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। ২০১৪ সালে মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে। পরে কোথায় লেখাপড়া করেছে তা তিনি জানেন না।
জগদল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন,‘ফয়জুল এলাকায় আসলেও এলাকার অন্য তরুণদের মতো স্বাভাবিক ছিল না সে। কারো সঙ্গে মিশতো না। কোন তরুণের সঙ্গে ভাব ছিল না তার। সে তার মতো আলগা চলতো। ড. জাফর ইকবালের মতো একজন গুণী মানুষের উপর আক্রমণ করায় পুরো এলাকাবাসীর ঘৃণা জন্মেছে তার উপর, আমরা এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’
ফয়জুলের চাচী রেহেনা আক্তার বলেন,‘বাড়ি থেকে চলে যাবার পর ফয়জুর তাদের বাড়িতে খুব একটা আসতো না।’ তিনি জানান, ড. জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাতের ঘটনা তারা এলাকার মানুষের কাছ থেকে শুনেছেন। এই ঘটনার বিচার চান তারাও।
দিরাই থানার ওসি তদন্ত এবিএম দেলোয়ার বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে জানা গেছে ১৫ বছর যাবৎ এলাকায় বসবাস করে না ফয়জুলের পরিবার পরিজন। ফয়জুলের বাবা সিলেটে থাকেন, কুমারগাঁও বাসস্টেশনের পাশে তাদের নিজেদের বাড়ি রয়েছে। ্ওখানে তারা স্বপরিবারে থাকতো। সে মাঝে মধ্যে এলাকায় এসে ফেরিওয়ালার বেশে গামছা লুঙ্গি বিক্রি করতো।’ তিনি জানান, র্যাব সুনামগঞ্জ ক্যাম্পের সদস্যরা তার চাচা আবুল কাহার লুলই কে আটক করেছে।
ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুল হাসানের মামা ফজলুর রহমানকে সিলেটের কুমারগাঁও বাসা থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব আটক করেছে। ফজলুর রহমানের স্বজনরাও ফয়জুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। রোববার বেলা দেড়টার দিকে ফয়জুলের মামার বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর পৌর এলাকার শেরপুর গ্রামে গেলে পরিবারের সদস্যরা ফজলুকে নিরপরাধ দাবি করে তাকে ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িতে ফজলুর বৃদ্ধা মা ছাড়া কোন পুরুষ মানুষ নেই।
ফজলুর রহমানের মা রায়েবা খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলেরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। তারা উগ্রবাদী নয়।’
ফজলুর প্রতিবেশী বকুল গোপ বলেন, ‘ফজলু পরোপকারী, তাকে প্রগতিশীল লোক হিসাবেই জানি আমরা। পৌর যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। বর্তমানে সে সুনামগঞ্জ কৃষক লীগের যুগ্ম আহবায়ক হিসেবে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছে।’
ফজলুর চাচাতো ভাই জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সাবেক পৌর কাউন্সিলর লুৎফুর রহমান জানান, আমরা অস্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। আমাদের পূর্ব পুরুষ থেকে আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ফজলুও কৃষক লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।’ তিনি দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবারের উপর হামলার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। পৌরএলাকার শেরপুর গ্রামের বাসিন্দা আরফান উল্লাহর প্রথম স্ত্রীর ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর এক ছেলে রয়েছে। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তানরা হলেন, শিব্বির আহমদ, বজুলর রশিদ, ফজুলর রহমান ফজলু ও জাবেদ আহমদ। বড় ছেলে শিব্বির ও ছোট ছেলে জাবেদ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে ববসাস করেছেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর এক সন্তান বাবুল মিয়া। সে জগন্নাথপুর ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছে।
বজলুর রশিদ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য এবং ফজলুর রহমান জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম আহবায়ক।
আরফান উল্লার প্রথম পক্ষের ৪ মেয়েরা হলেন, রুসনারা বেগম, মিনারা বেগম, রেহেনা বেগম ও মিনা বেগম। মিনারা বেগমকে দিরাই উপজেলার কলিয়ারকাপন গ্রামের হাফিজ মাওলানা আতিকুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে আতিকুর রহমান সিলেট শহরের কুমারগাঁও এলাকায় পরিবার পরিজন দিয়ে বসবাস করে আসছেন।
তিনি সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পার্শ্ববর্তী টুকেরবাজার এলাকার একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।