সিলেটে মাছের প্রলোভন দেখিয়ে সাহেরাকে অপহরণ

প্রকাশিত: ৮:০৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২, ২০২০

সিলেটে মাছের প্রলোভন দেখিয়ে সাহেরাকে অপহরণ

Manual2 Ad Code

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : আমিন আল শহীদ চৌধুরী (৪০)। পরিচিতি তার সুমন নামে। সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ (প্রস্তাবিত শান্তিগঞ্জ) উপজেলার বীরগাঁও ইউনিয়নের হাঁসকুঁড়ি গ্রামের মৃত আফসর চৌধুরী বুলবুলের ছেলে তিনি। পৈত্রিক কৃষিজমি ও ফিশারি দেখাশুনা করেই দিনাতিপাত করছিলেন সুমন। জমিজমা নিয়ে একই গ্রামের মৃত আব্দুর রউফের ছেলে, বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুর রহমান শহীদের সাথে সুমনের বিরোধ পুরোনো। সুমনের দায়ের করা উত্তরাধীকার সনদ জালিয়াতির মামলায় ২০১৯ সালে ৪ মাস জেলও খেটেছেন শহীদ। এর প্রতিশোধ নিতে ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন সাবেক ওই চেয়ারম্যান। শহীদের চক্রান্তেই মিথ্যা নারী নির্যাতনের মামলায় ‘নিরপরাধ’ সুমন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন, এমন দাবী সুমনের স্বজনদের।

জানা গেছে, অক্টোবর মাসের শুরুতে আমিন আল শহীদ চৌধুরী সুমনের মোবাইলে এক অচেনা নারীর কল আসে। ওই নারী নিজেকে সিলেটের জোনাল স্যাটেলমেন্ট অফিসের কর্মচারী সাহেরা বেগম পরিচয় দেন এবং জোনাল অফিসে সুমনের জমিসংক্রান্ত একটি মামলা আছে বলে জানান। সেই মামলা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তার হাতে রয়েছে এবং জোনাল স্যাটেলমেন্ট অফিসের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন একটি কাগজ সুমনকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। সে সময় সুমন তার ভাতিজা শাইরুল ইসলাম চৌধুরীকে বলেন সেই কাগজটি ওই নারীর কাছ থেকে বুঝে নিতে। কিন্তু শাইরুলের কাছে কাগজটি দিতে সাফ অসম্মতি প্রকাশ করেন সাহেরা। তিনি বলেন, ‘কাগজ শুধুমাত্র আমিন আল শহীদ চৌধুরী সুমনের হাতেই দেওয়ার জন্য সারের নির্দেশ রয়েছে।’ সাহেরার কথামতো কাগজ নিতে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক বিকেলে নগরীর সুবিদবাজারের মৌরসী রেস্টুরেন্টে আসেন সুমন ও তার ভাতিজা শাইরুল। মাস্ক পরিধান করে সাহেরাও আসেন রেস্টুরেন্টে। মিনিট বিশেকের আলাপচারিতায় একবারের জন্যও নিজের মুখ থেকে মাস্ক সরাননি চল্লিশোর্ধ সাহেরা বেগম। এমনকি রেস্টুরেন্টে দই অর্ডার দেওয়া হলে, তিনি দই খান না বলে জানান। একপর্যায়ে সুমনের হাতে বিরোধপূর্ণ ওই জমি সংশ্লিষ্ট একটি কাগজ তুলে দেন তিনি। সুমন খুশি হয়ে তাকে ৫‘শ টাকা দেন। সেদিনের সাক্ষাতের পর মাঝেমধ্যে সুমনের মোবাইলে কল দিয়ে জমি সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতেন সাহেরা।

২৭ অক্টোবর আমিন আল শহীদ চৌধুরী সুমনের মোবাইলে কল দিয়ে সাহেরা জানান, ‘জমিসংক্রান্ত বিষয়ে জোনাল অফিসের বড়কর্তা আপনাকে আমার সাথে উনার বাসায় যেতে বলেছেন।’ সাহেরার কথামতো সুমন বিকেলে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট নগরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌছান আমিন আল শহীদ চৌধুরী সুমন। এসময় ভাতিজা শাইরুলকে ফোন দিয়ে দেখা করতে বলেন তিনি। এরপর সুমন তার এলাকার পরিচিত এক সিএনজি অটোরিকশা চালককে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সামনে আসতে বলেন। এখানে গাড়িতে উঠে চালককে গাড়িটি একটু সামনে নিতে বলেন সুমন। সামনেই সিএনজি ফিলিং স্টেশনের বিপরীত পাশে সুপারক্রীট সিমেন্ট বহনকারী ট্রাক রাখার স্ট্যান্ডের কোণে এসে থামে সিএনজি অটোরিকশাটি। সেখান পেছন দিক থেকে হেটে হেটে এসে ওই সিএনজি অটোরিকশায় উঠেন জোনাল স্যাটেলমেন্ট অফিসের কর্মচারী পরিচয় দানকারী সাহেরা বেগম। গাড়ি যাত্রা শুরু করে দক্ষিণ সুরমার আলমপুর এলাকায় জোনাল স্যাটেলমেন্ট অফিসের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা তখন প্রায় ৭টা।

Manual8 Ad Code

নগরীর আখালিয়া মাছ বাজার (মাউন্ট এডোরা হাসপাতাল সংলগ্ন) এলাকায় আসার পর স্পীডব্রেকারে গাড়ির গতি কমান চালক। এমন সময় হঠাৎ সামনে এবং পেছনে থেকে একদল যুবক হামলা চালায় সুমনকে বহনকারী সিএনজি অটোরিকশায়। চালককে মারতে মারতে বের করা হয় গাড়ি থেকে। সিএনজি অটোরিকশার ভেতরেই শুরু হয় আমিন আল শহীদ চৌধুরী সুমনকে মারধর। মারের চোটে দৌড়ে এক দোকানে আশ্রয় নেন সিএনজি অটোরিকশা চালক। ওই দোকানের সামনে দাঁড়ানো ছিলেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জের বীরগাঁও ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও সুমনের প্রতিপক্ষ শহীদুর রহমান শহীদ। তিনি বর্তমানে আখালিয়া এলাকার ওই গলিতেই বসবাস করেন।

এদিকে, মারধরের একপর্যায়ে প্রাণ রক্ষার্থে সুমনও দৌড় দিয়ে একটি দোকানে প্রবেশ করেন। এসময় সামনেই ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুর রহমান শহীদ। তিনি জালালাবাদ থানায় ফোন দিলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় পুলিশ। শহীদ নিজেই সুমনকে তুলে দেন পুলিশের হাতে। সাহেরা বেগম বাদী হয়ে পরদিন ২৮ অক্টোবর দুপুরে জালালাবাদ থানায় আমিন আল শহীদ চৌধুরী সুমনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও অপহরণের অভিযোগ দাখিল করেন। এজাহারটি মামলা হিসেবে গণ্য করে ওই দিনই আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয় সুমনকে।

Manual3 Ad Code

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটের জোনাল স্যাটেলমেন্ট অফিসে সাহেরা বেগম নামের কোনো কর্মচারী নেই। এই সাহেরা বেগম আর কেউ নন, সুমনের প্রতিপক্ষ বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুর রহমান শহীদের আপন মামাতো ভাই রাহিনুর মিয়ার স্ত্রী। সিলেটের জোনাল স্যাটেলমেন্ট অফিসে নয়, সাহেরা বেগম কাজ করেন আখালিয়ার মাউন্ড এডোরা হাসপাতালে। তিনি ওই হাসপাতালের একজন আয়া। সাহেরার মূল বাড়িও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার বীরগাঁও গ্রামে। তবে বর্তমানে তিনি নগরীর আখালিয়া এলাকায় শাবিপ্রবি গেইট সংলগ্ন শাহজাহান মিয়ার কলোনীতে বসবাস করছেন।

Manual8 Ad Code

সুমনের ভাতিজা শাহিরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ‘শহীদুর রহমান শহীদের নির্দেশেই স্যাটেলমেন্ট অফিসের কর্মচারী সেজে প্রতারণার ফাঁদ পাতে ধূর্ত সাহেরা। বিশ^াস স্থাপনের জন্য শহীদের কাছ থেকে জমির একটি কাগজ এনে সুমনকে দেয় সে। ফলে সাহেরাকে স্যাটেলমেন্ট অফিসের কর্মচারী ভেবে সহজেই বিশ^াস করেন সুমন। পূর্বপরিকল্পিতভাবে সুমনকে ডেকে এনে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে মারধর এবং আপন মামাতো ভাইয়ের স্ত্রীকে দিয়ে নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পাঠিয়েছেন শহীদ। ঘটনাস্থলে শহীদের উপস্থিতিই এর প্রমাণ।’

কথা হয় পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুর রহমান শহীদের সাথে। তিনি জানান, ‘আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় জগিং করতে বের হই। ২৭ অক্টোবর প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে দেখি আমার বাসার গলির সামনে হট্টগোল। এগিয়ে যেতেই সুমন আমাকে এসে বললো, শহীদ ভাই আমাকে বাঁচাও। তখন আমি উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করি এবং স্থানীয় কাউন্সিলরের সাথে আলাপ করে পুলিশে খবর দেই এবং তাকে জালালাবাদ থানায় সোপর্দ করি।’ সাহেরা বেগমকে চেনেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে শুরু করেন শহীদ। একপর্যায়ে স্বীকার করেন সাহেরার স্বামী রাহীনুর তার সম্পর্কীয় মামাতো ভাই। তবে এই ঘটনার সাথে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও জানান শহীদ। তিনি এটাও বলেন, সাহেরার সাথে সুমনের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে।

Manual8 Ad Code

এ ব্যাপারে সাহেরা বেগমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, মাস দুয়েক আগে বাসের মধ্যে তার সাথে সুমনের পরিচয় হয়। সেখানে সুমন নিজে সাহেরার মোবাইল থেকে নাম্বার নেন এবং বিভিন্ন সময় ফোন দিয়ে সাহেরাকে বোন বলে সম্বোধন করতেন। সাহেরা আরো জানান, একদিন ভাতিজা শাহিরুলের মাধ্যমে ৫‘শ টাকাও সাহেরার বাসায় পাঠান সুমন। ঘটনার দিন সুমন মাছ নিয়ে তার বাসায় আসছিলেন বলেও জানান তিনি। মৌরসী রেস্টুরেন্ট বসার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন সাহেরা। অথচ, পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দীতে সাহেরা স্বীকার করেছেন, তিনি সুমন ও শাহিরুলের সাথে অক্টোবরের ১২ বা ১৩ তারিখ আছরের নামাজের পর থেকে মাগরিবের নামাজের পর পর্যন্ত মৌরসী রেস্টুরেন্টে অবস্থান করছিলেন। পুলিশের এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। শহীদ চেয়ারম্যানকেও সাহেরা চেনেন না বলে প্রতিবেদকে জানালেও, সাহেরার মেয়েকে শহীদের ভাগ্নের সাথে বিয়ে দিয়েছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। সেই হিসেবে শহীদ ও সাহেরা সম্পর্কে বেয়াই বেয়াইন হন।

পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান নূর কালাম বলেন, আমার জানামতে সুমন লোক হিসেবে অত্যন্ত ভালো এবং সহজ সরল। তার সাথে জমিজমা নিয়ে সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শহীদুর রহমান শহীদের বিরোধ চলছিলো। শহীদ চেয়ারম্যান থাকাকালে সুমনের পরিবারের উত্তরাধীকার সনদ জালিয়াতি করেন। এ ঘটনায় সুমন বাদী হয়ে ২০১৭ সালে আদালতে মামলা দায়ের করলে মামলার রায় সুমনের পক্ষে যায়। ২০১৯ সালে ওই জালিয়াতির মামলায় ৪ মাস জেল খাটেন শহীদ। আমার ৯৯% ধারণা, ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই সুমনকে এই ঘটনায় ফাঁসিয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান শহীদ।

জালালাবাদ থানার ওসি অকিল উদ্দিন আহমদকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উল্টো প্রশ্ন করেন, কেন এবং কিসের জন্য এসব ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে। শহীদের সাথে আঁতাত করেই এই ‘সাজানো’ মামলা নিয়েছেন ওসি অকিল, সুমন পরিবারের এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, আসামিরা এসব বলবেই। তারা তাদের অপরাধ ঢাকার জন্য অনেক কিছু বলবে, পারলে প্রমাণ করতে বলেন। ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্তের জন্য কিছুই বলা যাচ্ছেনা।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

November 2020
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930  

সর্বশেষ খবর

………………………..