সুনামগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য : সীমাহীন ভোগান্তি

প্রকাশিত: ৬:৩৬ অপরাহ্ণ, জুন ১৯, ২০২১

সুনামগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য : সীমাহীন ভোগান্তি

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সুনামগঞ্জের দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার বীরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা আমান উদ্দিন সৌদি আরবে কাজ করেন। ছুটি কাটাতে দেশে আসার পর তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পরে তিনি চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ২১ তারিখে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে জমা দিয়ে সাধারণ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। পাসপোর্ট অফিস থেকে পাওয়া ডেলিভারি স্লিপ অনুযায়ী গত ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তার পাসপোর্ট বুঝে পাওয়ার কথা। তার সাধারণ পাসপোর্ট পাওয়ার ২১ দিনের সময়সীমা শেষ হয়েছে ৫ মাস আগে। এখন তার প্রশ্ন- কাঙ্ক্ষিত পাসপোর্ট কবে হাতে পাবেন তিনি?

আমান উদ্দিন বলেন, পাসপোর্টের জন্য প্রথমে উজ্জ্বলের কাছে দিয়েছি সাড়ে ৫ হাজার টাকা। কয়েকমাস পরে পাসপোর্ট অফিসে আসার পর অফিসের স্যার বলেন আমার পাসপোর্ট এখনও প্রিন্ট হয়নি। পরে উজ্জ্বলকে জানানোর পর সে বলে, আরও ৫ হাজার টাকা দিলে এক সপ্তাহের ভেতরে পাসপোর্ট চলে আসবে। ১৫ দিন আগে আবারও ৫ হাজার টাকা উজ্জ্বলকে দিয়েছি। গতকাল (গত বুধবার) সে ফোন করে জানিয়েছে আজ (গত বৃহস্পতিবার) পাসপোর্ট অফিসে আসার জন্য। তাই আজ এসেছি।

পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা যায়, ৪৮ পৃষ্টার ৫ বছর মেয়াদী সাধারণ পাসপোর্টের ফি ৪ হাজার ২৫ টাকা, জরুরি পাসপোর্টের ফি ৬ হাজার ৩২৫ টাকা ও অতীব জরুরি পাসপোর্টের ফি ৮ হাজার ৬২৫ টাকা। ৪৮ পৃষ্টার ১০ বছর মেয়াদী সাধারণ পাসপোর্টের ফি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, জরুরি পাসপোর্টের ফি ৮ হাজার ৫০ টাকা ও অতীব জরুরি পাসপোর্টের ফি ১০ হাজার ৩৫০ টাকা। ৬৪ পৃষ্টার ৫ বছর মেয়াদী সাধারণ পাসপোর্টের ফি ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, জরুরি পাসপোর্টের ফি ৮ হাজার ৬২৫ টাকা ও অতীব জরুরি পাসপোর্টের ফি ১২ হাজার ৭৫ টাকা। একই সংখ্যক পৃষ্টার ১০ বছর মেয়াদী সাধারণ পাসপোর্টের ফি ৮ হাজার ৫০ টাকা, জরুরি পাসপোর্টের ফি ১০ হাজার ৩৫০ টাকা ও অতীব জরুরি ১৩ হাজার ৮০০ টাকা ফিস। এই পাসপোর্ট দিতে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স থাকা সাপেক্ষে সাধারণের ক্ষেত্রে ১৫ দিন, জরুরি ক্ষেত্রে ৭ দিন ও অতীব জরুরি ক্ষেত্রে ২ দিন সময় লাগবে বলে উল্লেখ করা রয়েছে।

ছাতক উপজেলার বাসিন্দা সৈয়দ মিসবাউল হকও দালাল ধরে পাসপোর্ট করছেন। এজন্য তাকে গুনতে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার টাকা। দালালকে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পাসপোর্ট অফিসে শক্ত একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। আপনি দালাল ধরে না করলে সময় বেশি যাবে, তবে পাসপোর্ট আর পাবেন না। অনেকে মনে করেন এটা আমার দেশ। আমার দেশে কেন অতিরিক্ত টাকা দেব? তারা এটা বোঝেন না যে আমাদের দেশ দুর্নীতির জন্য এক নম্বর। আমি এত ঝামেলায় যেতে চাই না। কিছু টাকা গেলেও পাসপোর্ট আসুক তাড়াতাড়ি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সৈয়দ মিসবাউল হক লিয়াকত আলী নামের একজনের কাছে টাকা দিয়েছেন। এই লিয়াকত আলীর ট্রাভেলসের ব্যবসা কোর্টের সামনে। তার ট্রাভেলসের নাম ‘মায়ের দোয়া’। লিয়াকত আলী নিজেই স্বীকার করলেন তার ব্যবসার কোনো বৈধতা নেই। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন আছে। পুলিশকেও টাকা দিতে হয়। তাই সাধারণ পাসপোর্টের জন্য ৭ হাজার ১০০ টাকা নিই আমরা।

তাহিরপুর উপজেলার পুরান বড়দল গ্রামের বাসিন্দা শিপন। তিনি নিজে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে গেল বছরের নভেম্বরে ৮ তারিখ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন সুনামগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে। এ বছরের ১৫ জুন পর্যন্ত পাসপোর্ট পাননি তিনি।

শিপন বলেন, যখনই অফিসে আসি বলে ১ মাস পরে আসেন। ১ মাস পরে এলে বলে ১৫ দিন পরে, ১৫ দিন পরে এলে বলে ১০ দিন পরে আসেন। আজ বললো আরও ৫ দিন পরে আসার জন্য। দালাল ছাড়া নিজে পাসপোর্ট করার জন্য এ ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।

দোয়ারাবাজার উপজেলার বাসিন্দা এমরান হোসেন বলেন, আমি পড়াশোনা করেছি। দালাল ধরব কেন? তাই আমার নিজের ল্যাপটপে অনলাইনে ফরম পূরণ করে ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা দিয়েছি। এখন এমন ভোগান্তিতে পড়েছি যে দালাল না ধরে উপায় নেই। পরে এক দালালকে ফোন দিয়েছি। সে বললো তুমি ফরমের পেছনে ‘আই’ লিখে দাও, তাহলে জমা নেবে। অবশ্য এই টেকনিক ব্যবহার করার আগেই ফরম জমা হয়ে গেছে আমার।

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, পাসপোর্ট করার জন্য কোনো এজেন্সি আছে কি না সেটা আমার জানা নেই। কারণ এটা করে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এটা আমাদের কাজ নয়। তবে পাসপোর্ট অধিদপ্তর যখন নাম-ঠিকানা আমাদের কাছে পাঠায়, আমরা সেগুলো যাচাই করে দেখি সত্য না মিথ্যা। পাসপোর্ট অধিদপ্তর কার কাছ থেকে কাগজপত্র নেবে বা নেবে না সেটা আমাদের কাছে তারা বলতে বাধ্য না। আমরা জিজ্ঞেসও করি না। যারা বলছে পুলিশকে টাকা দেয়, তাদের সম্পর্কে তথ্য দেন। তারা যেই হোক তাদের বিরুদ্ধে আমি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

আর সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম খাঁন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কোনো দালাল থাকলে আপনারা বের করে দেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। একজন মানুষের পাসপোর্ট আবেদন থেকে শুরু করে তা হাতে পাওয়া পর্যন্ত যাচাই-বাছাইয়ের কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গে করি আমরা।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..