সিলেট ৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১১ই জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৯:২৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০২০
কানাইঘাট প্রতিনিধি :: সিলেটের লোভাছড়া কোয়ারির দুই তীরে ব্যবসায়ীদের ক্রয়কৃত পাথর অপসারণে উচ্চ আদালতের আদেশ নিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নাটকীয়তার তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, প্রশাসন আদেশ বাস্তবায়ন না করে কালক্ষেপন করছেন। এতে করে আদালতের বেঁধে দেয়া সময় শেষের পাশাপাশি নদীর পানিও শুকিয়ে যাচ্ছে। আর পানি শুকিয়ে গেলে তাদের মজুদকৃত প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার পাথর অপসারণ করার সুযোগ থাকবে না। এতে করে তারা চরম আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। তবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বক্তব্য, ব্যবসায়ীরা আদেশের সঙ্গে তাদের পাথর ক্রয়ের প্রমাণাদী দাখিল করেননি।
এছাড়া এই আদেশের বিরুদ্ধে তারা আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু তা মিথ্যে দাবি করে ব্যবসায়ী পক্ষের আইনজীবি বলেছেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা রহস্যজন কারণে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সকল প্রকার কাগজ দাখিলের পরও তারা পাথর অপসারণে বাধা দিয়ে উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করছেন। এমনকি আজ শুক্রবার বিকেলে ব্যবসায়ীরা কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনে আইনি প্রতিকার পাওয়ার জন্য গেলে তিনি গেট খুলেননি। আর পাথর নিয়ে যখন ব্যবসায়ী, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যে রশি টানাটানি তখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে পুলিশ।
পাথর অপসারণে উচ্চ আদালতের আদেশ দেয়ার পরও কেন বাধা দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল হক বলেন, ‘হাইকোর্ট বলেছেন আদেশের সঙ্গে পাথর ক্রয়ের কাগজপত্রও দাখিল করতে হবে। আমি শুনেছি তারা পরিবেশ অধিদপ্তরে আদেশ জমা দিলেও প্রমাণাদী দাখিল করেননি। এসব দাখিলের পরে তা যাচাই বাছাই করার পরই পাথর নিতে পারবে। তাই সেখানে টাস্কফোর্সের অভিযান হয়েছে’।
তিনি আরো বলেন, ‘সবকিছু জমার দেয়ার পর যদি পরিবেশের পরিচালক সাহেব বাধা দেন তাহেল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ রয়েছে’। কিন্তু ব্যবসায়ীরা পরিবেশে সব কাগজ জমা দেয়ার দাবি করেছেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এখানে অনেক বিষয় আছে যা পরিস্কার না করেই তারা পাথর নিতে চাচ্ছেন। এছাড়া পরিবেশের পরিচালক সাহেব আদেশ স্থগিত করে আপিলের জন্য চিঠি লিখেছেন। আপিলের বিষয়টি এরকম: কোনো আদেশের পর যখন আপিলের জন্য লিখা হয় তাহলে মূল মামলা চলমান আছে বলে ধরে নিতে হয়’।
জেলা প্রশাসকের এই বক্তব্য প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী পক্ষের আইনজীবি অ্যাডভোকেট মঈনুল হক বুলবুল বলেন, ‘গত ১৮ ও ১৯ আগস্ট আমি নিজে গিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে দু’টি প্রতিষ্ঠানের ১৪ লক্ষ ও ৮ লক্ষ ঘনফুট পাথরের মালিকানার অর্থাৎ চৌতা, মেমো, ভ্যাটের কাগজ, জায়গার কাগজসহ সবকিছু দাখিল করেছি। তিনি তা রিসিভও করেছেন। আমাকে আদেশের সার্টিফাইড কপি দেয়ার জন্য বলা হলে তাও দাখিল করেছি; কিন্তু পাথর অপসারণের কোনো অনুমতি দেননি’।
জেলা প্রশাসকের বক্তব্য মিথ্যে দাবি করে এই আইনজীবি বলেন, ‘মূলত প্রতিহিংসা থেকে তারা ব্যবসায়ীদের এই ক্ষতি করছেন। এই আদেশের পরে তাদের (অভিযানকারী) কোয়ারি এলাকায় যাওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। ব্যবসায়ীরা কেন তাদের কাছে গিয়ে ধর্না দেননি এই আক্রোশ থেকে তারা পাথর অপসারণে বাধা দিচ্ছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনী’। অপর এ প্রশেনর জবাবে তিনি বলেন, ‘মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ দেয়ার পরে যতক্ষন পর্যন্ত তা স্থগেতর আদেশ আসবে ততোক্ষন পূর্বের আদেশ বলবৎ থাকে। যেকারণে বিবাদী সবাই আদালতের আদেশ পালনে বাধ্য।’
এদিকে, ব্যবসায়ী, পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের মধ্যে পাথর অপসারণ নিয়ে যখন এই নাটকীয়তা তখন বিপাকে পড়েছে পুলিশ। উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করছেন কি-না জানতে চাইলে সিলেট জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন পিপিএম বলেন, ‘পুলিশ কখনো আদালতের আদেশ অমান্য করে না। আমাদেরকে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে লিখিত চিঠি দিয়ে তাদের সহযোগিতা করতে বলেছে। যেহেতু আমরা সমন্বয় হয়ে কাজ করি; সেহেতু জেলা প্রশাসনের নির্দেশনার বাইরে যেতে পারিনা। পাথর কোয়ারি এলাকায় পুলিশের কোনো ভুমিকা নেই। জেলা প্রশাসক যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা সেই আলোকেই কাজ করবো’। এ বিষয়টি নিয়ে পুলিশ অনেকটা বিব্রত; যা দ্রুত সুরহা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন পুলিশ সুপার।
অন্যদিকে জেলা প্রশাসক আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের আপিলের সিদ্ধান্তের কথা বললেও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মোহাম্মদ এমরান আহমদ বৃহস্পতিবার এই তথ্য দেননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, ব্যবসায়ীরা আদেশের সার্টিফাইড কপি দাখিল না করায় পাথর অপসারণে বাধা দেয়া হচ্ছে। যদিও তার এই বক্তব্য মিথ্যে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ী পক্ষের আইনজীবি।
এদিকে, আইনী প্রতিকার পেতে শুক্রবার বিকেলে পাথর ব্যবসায়ীরা কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বারিউল করিম খানের বাসায় যান। কিন্তু তিনি সাক্ষাৎ দেননি। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পরও বাসার গেট না খোলায় তারা ফিরে আসেন।
প্রসঙ্গত, লোভাছড়া কোয়ারি থেকে শুষ্ক মৌসুমে পাথর উত্তোলন করা হয়। কিন্তু ওই সময় সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় তা সরবরাহ বা অপসারণের একমাত্র উপায় বর্ষা মৌসুম। কিন্তু এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে নৌ যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীরা তাদের পাথর অপসারণ করতে পারেননি। ফলে নদীর দুই তীরে তা মজুদ রাখা হয়। এরইমধ্যে গত ১৩ এপ্রিল কোয়ারির ইজারার মেয়াদ শেষ হলে গত ১৫ ও ১৬ জুলাই অভিযান চালিয়ে নদীর তীরে অবৈধভাবে সংরক্ষণের অভিযোগে মজুদ করে রাখা সেই পাথর জব্দ করে নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। সর্বশেষ ৬ জন ব্যবসায়ী ২৮ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের এ পদক্ষেপেরে বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন। আদালত ভিন্ন ভিন্ন তারিখে প্রতিটি আদেশে ৩০ দিনের মধ্যে লোভছড়া তীর থেকে ব্যবসায়ীদের পাথর অপসারণের নির্দেশ দেন। সেইসঙ্গে ব্যবসায়ীদের দাবিকৃত পাথর সংশ্লিষ্টদের সমজিয়ে দিতে বলেন।
এছাড়াও উচ্চ আদালত ব্যবসায়ীদের পক্ষে আদেশ দেয়ার পর খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের উদ্দেশ্যে এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়, লোভাছড়া নদীর তীরে জমাকৃত পাথর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালককৃত জব্দ ও নিলামের সিদ্ধান্ত এখতিয়ার বহির্ভূত। গত ১৩ আগস্ট বিএমডি-এর মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো: জাফর উল্লাহ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উচ্চ আদালতের আদেশ অনুসরণ করার কথাও বলা হয়।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd