একজন পুলিশ সুপারের মানবিকতা

প্রকাশিত: ২:২৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২০

একজন পুলিশ সুপারের মানবিকতা

Manual1 Ad Code

সাইফুল আলম : পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, সিলেট। ‘মানুষ মানুষের জন্যে জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না’ বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ভূপেন হাজারিকার গানের কথাগুলো অনেকের মত আমারও খুব প্রিয়। বাস্তবিক ক্ষেত্রে কথাগুলোর প্রয়োগ ঘটানো গেলে সমাজের চিত্র পাল্টে যেত বলে আমার বিশ্বাস। আমি হয়তো এর সিকিভাগও পারি না। তবে সমাজে এরকম অনেক মানুষ আছে যারা ভূপেন হাজারিকার এই গানের কথাগুলো বাস্তব ক্ষেত্রে সিংহভাগ প্রয়োগ করে থাকেন। আর একারণেই পৃথীবী এখনো অনেক সুন্দর। এরকম একজন মানুষ নিয়ে দুটি কথা লিখতে চাই। তিনি হলেন সিলেট জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন পিপিএম স্যার। আমি স্যারের অধীনে কর্মরত কনিষ্ট এক কর্মকর্তা। স্যারের অফিসেই আমার অফিস থাকার সুবাধে স্যারের কিছু মানবিক কাজের উদাহরণগুলো সহজেই আমার দৃষ্টিগোচর হয়। বিভাগীয় একটি জেলা শহরের পুলিশ সুপারের দপ্তরিক কাজের চাপ মোকাবিলা করে নিয়মিত সাধারণ মানুষদের অভিযোগ শোনা কিংবা তাদের নিকট থেকে দ্রুত সেবা প্রাপ্তির প্রত্যাশা শুনে তড়িৎ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা অনেকটা দুস্কর হয়ে উঠে।তবে পুলিশ সুপার শত ব্যস্ততার মাঝেও সাধারন মানুষদের সাক্ষাতকারের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। সাধারণত সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের প্রধানগণ রুটিন কাজের সুবিধার্থে দর্শানার্থিদের সাক্ষাতকারের জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় বেধে দেন। তবে গতানুগতিক এরকম সিস্টেম থেকে বের হয়ে পুলিশ সুপার সিলেট মহোদয়ের মত অফিসে থাকা অবস্থায় (সকাল ১০ টা কিংবা সন্ধা ৭টা হউক) হাসিমুখে দর্শানার্থিদের কথা শুনে তড়িৎ পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হরহামেশা দেখা যায় না।

যেই পয়েন্ট অব ভিউ থেকে আমার লেখার উদ্দেশ্য সেটি হল গতকাল (৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধা ৭ টায়) সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানায় কর্মরত এক কনস্টেবল ( প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে মানসিক স্ট্রেসে আক্রান্ত হয়ে) নিজের নামে ইস্যু করা রাইফেল দিয়ে বুকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বিষয়টি ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা আইনানুগ দৃষ্টিকোন থেকে অত্যন্ত ঘৃনিত এবং শাস্তিমূলক অপরাধ। জেলা পুলিশের অভিভাবক হিসেবে এরকম সংবাদ পাওয়া নিশ্চয়ই অত্যন্ত কষ্টকর এবং বিব্রতকরও বটে। কারণ একজন আইন শৃংখল বাহিনীর কোন সদস্যের দ্বারা এরকম ঘৃনিত কাজ করা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। এরকম সংবাদ শুনার সাথে সাথে কয়েকজন সিনিয়র অফিসারসহ আমি এবং সংশ্লিষ্টদের দ্রুত এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভিকটিম হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই চিকিৎসার পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিলেন। সেই অনুযায়ী আমরা হাসপাতালে গিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকি। খানিক্ষণের মধ্যেই গুরতর আহত অবস্থায় ভিকটিমকে হাসপাতালে নিয়ে আসলে আমরা তাকে অপরেশন থিয়েটারে নিয়ে যাই এবং তাৎক্ষণিক কয়েক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করি। মিনিট পাঁচেক বাদেই দেখি পুলিশ সুপার মহোদয় কাউকে কিছু না বলেই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে চলে আসেন। এসেই তিনি ডাক্তারের সাথে কথা বলেন ভিকটিম মুমূর্ষু কনস্টেবলকে দেখেন। ডাক্তারদের সক্ষমতা অনুযায়ী সর্বোচ্ছ চিকিৎসা প্রদান করার অনুরোধ করেন। এমনকি উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন হলে ঢাকায় পাঠানোর জন্যও তিনি প্রস্তুত বলে ডাক্তারদের অবহিত করেন। ডাক্তারগণ প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিৎসা করতে থাকেন। কিন্তু পুলিশ সুপার মহোদয় নিজে থেকেই ভিকটিমকে ঢাকায় প্রেরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। যেভাবেই হউক তাকে বাঁচাতে হবে; এরকম দৃষ্টিকোন থেকে রাতের বেলার সীমাবদ্ধতার কারণে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কিংবা হেলিকপ্টার ব্যবস্থা করতে না পারার আক্ষেপ করতে থাকেন। স্যারের পাশে আমিসহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) লুৎফর স্যার ছিলাম। আমাদেরকে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করতে বলেন পাশাপাশি নিজেই পরিচিত বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে ডাক্তারগণ বলার আগেই আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজসহ এক এক করে ঢাকায় পাঠানোর সমস্ত ব্যবস্থা করতে থাকলেন।

Manual7 Ad Code

আনুমানিক আধা ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যেই হাসপাতালে আসলেন সিলেট রেঞ্জের সুযোগ্য ডিআইজি কামরুল আহসান এবং অতিরিক্ত ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র। স্যাররা এসপি স্যারসহ চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তারদের সাথে কথা বলে সামগ্রিক পরিস্থিতি অবহিত হলেন। তাৎক্ষণিক ডিআইজি স্যার উন্নত চিকিৎসার জন্য ভিকটিমকে ঢাকায় প্রেরণের জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এসপি স্যারকে পরামর্শ্য দিলেন এবং স্যার নিজেও ঢাকায় পৌঁছেই যেন দ্রুত চিকিৎসা পাওয়া যায় তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা করতে পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র স্যারদের সাথে কথা বলেন। এমনকি ভিকটিমের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স রাস্তায় যেন কোন ট্রাফিকে পরতে না হয় সেজন্য আশপাশের জেলার পুলিশ অফিসারদের সাথে কথা বলতে বলেন এবং একটি ডাবল কেবিন পিকাপ স্কর্ট দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সকে ঢাকায় নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। একজন সহকর্মী কনস্টেবলকে বাঁচাতে ডিআইজি স্যার, অতিরিক্ত ডিআইজি স্যার এবং এসপি স্যারদের যে আন্তরিকতা কিংবা মহানুভবতা পাশ থেকে দেখলাম তাতে মনে হল ভূপেন হাজারিকার সেই ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানের কথাগুলোর বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটানোর মত লোকগুলোই যে আমার শ্রদ্ধেয় অভিভাবকগণ! এ কথা ভাবতেই গর্বে বুকটা ভরে উঠল। পাশাপাশি নিজেও যেন স্যারদের মানবিক গুণাবলীর সিকিভাগ হলেও অর্জন করতে পারি তার প্রয়াস চালানো দরকার বলে মনে হল। যাইহোক ভিকটিমের উন্নত চিকিৎসার সার্বিক প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা শেষে পুলিশ সুপার মহোদয়ের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে রাত আনুমানিক ১১ ঘটিকার সময় ডিআইজি স্যার এবং অতিরিক্ত ডিআইজি স্যারগণ হাসপাতাল ত্যাগ করেন।

Manual4 Ad Code

এরমধ্যে আইসিইউ অ্যাম্বলেন্স হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে প্রস্তুত হতে থাকল। ভিকটিমকে ঢাকায় প্রেরণের প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত। এসপি স্যার আমাকে ৫০,০০০/- টাকা বের করে অ্যাম্বুলেন্সের মালিকের সাথে কথা বলে ভাড়া পরিশোধ করে আসতে বললেন। পাশাপাশি চিকিৎসার কাজে সহায়তায় যাওয়া অফিসারের নিকট ঢাকায় চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা দিয়ে দিলেন। একজন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কেউ তার সহকর্মীকে বাঁচাতে অপরেশন থিয়েটারের সামনে সাধারন দর্শনার্থীদের মত প্রায় চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত আয়োজন করতে পারে আমার জানা ছিল না। এমনকি অ্যাম্বুলেন্সে নিজে ভিকটিমকে তুলে দিয়ে তার সাথে যাওয়া অফিসারকে বারবার বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিতে দেখে আমি অনেকটা আবেগ আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবতে ভালো লাগছিল আমি এরকম মানবিক গুণাবলীর অফিসারের অধীনে কাজ করতে পেরেছি বলে। যাইহোক সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ভিকটিম কনস্টেবল ঢাকায় বক্ষ্য ব্যাধি হাসপাতালে কিছুটা ভাল অবস্থায় আছে বলে জানতে পেরেছি। আমরা আশা করি সে সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবে আর তাতেই ডিআইজি স্যার, অতিরিক্ত ডিআইজি স্যার এবং এসপি স্যারগণ তাদের সহকর্মীকে বাঁচাতে নেওয়া পদক্ষেপগুলো স্বার্থক হবে।

আমরা যে যেই লেভেলেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করি না কেন সব কিছুর মূলে রয়েছে মানব কল্যাণ। যথাযথভাবে মানব কল্যাণ করাটাই মূল দায়িত্ব, সেই দৃষ্টিকোন থেকেই হয়তো পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন স্যারের প্রতিটি কাজে কর্মে এরকম চিত্র ফুটে উঠছে। মানব কল্যাণে স্যারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো সিলেট জেলা পুলিশের সকল সদস্যসহ সমাজের অনেকেই অনুকরণ করবে বলে আশা রাখছি।

Manual6 Ad Code

লেখক: অফিসার ইনচার্জ

জেলা গোয়েন্দা শাখা (উত্তর) সিলেট।

Manual4 Ad Code

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

February 2020
S S M T W T F
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
29  

সর্বশেষ খবর

………………………..