বিশেষ প্রতিনিধি :: এবার হাওররক্ষার নামে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ দিয়ে কোটি কোটি টাকার লুটপাট হচ্ছে। এসব বাঁধ হাওরের কোন কাজে আসবে না, আবার জন চলাচলেও কাজে লাগবে না। কোন কোন বাঁধে জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি করবে। পাউবো কর্তৃপক্ষ বলেছেন,‘যেসব উপ-সহকারী প্রকৌশলী এসব স্থান নির্বাচন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য পত্র পাঠানো হয়েছে।’
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের পুটিয়া হাওরে সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে বোরো চাষাবাদ হয়। হাওর তলিয়ে যাবার কোন ঝুঁকি এই হাওরে নেই বললেই চলে। এই হাওরের ফসল রক্ষার নামে ৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে (পিআইসিকে) বাঁধের কাজ দেওয়া হয়েছে।
পিআইসি নম্বর ২৭’এ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২১ লাখ ৪৭ হাজার ১৬৯ টাকা, এই পিআইসির সভাপতি লোকমান মিয়া। পিআইসি নম্বর ৪৩’এ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৬ লাখ ২২ হাজার ৮২৬ টাকা, এই পিআইসি’র সভাপতি মো. আব্দুর রাজ্জাক। পিআইসি নম্বর ২৮’এ ২৩ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩৪ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এই পিআইসির সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান। পিআইসি নম্বর ৪২’এ ২৩ লাখ ২৩২ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এই পিআইসির সভাপতি মুক্তার উদ্দিন।
এই হাওরপাড়ের একাধিক কৃষক বলেছেন,‘পুটিয়ার হাওরে সেচ প্রকল্পের আওতায় চাষাবাদ হয়ে থাকে। এই হাওরে যে টাকা বরাদ্দ হয়েছে, এর চার
ভাগের এক ভাগ টাকা হলে হাওররক্ষা বাঁধের কাজ হতো। অপ্রয়োজনীয় এসব বাঁধ হাওরের কোন কাজে আসবে না, বরঞ্চ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে বাঁধের ভেতরে।’
জামালগঞ্জ উপজেলার পাগনার হাওর উপ-প্রকল্পের আওতায় ভীমখালী ইউনিয়নে ডুবন্তবাঁধ পুনরাকৃতিকরণ কাজে ৪টি পিআইসির মাধ্যমে কাজ হচ্ছে।
এই চার প্রকল্পের প্রাক্কলনে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে দুই দফায়। চার নম্বর পিআইসিতে প্রাথমিকভাবে ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।
পাঁচ নম্বর পিআইসিতে ১৪ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ২০ লাখ ৯১ হাজার টাকা। ছয় নম্বর পিআইসিতে ১৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ লাখ ৩৯ হাজার টাকা এবং ৫০ নম্বর পিআইসিতে ১২ লাখ টাকা বরাদ্দের স্থলে ২১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা করা হয়েছে। অথচ. এসব স্থানে বিগত সময়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে বহুবার প্রকল্প দিয়ে উন্নয়ন করা হয়েছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলায় ফসলরক্ষা বাঁধের নামে ৪৮ লাখ টাকার অপচয় হচ্ছে। বোর ফসলের বদলে সরিষা খেতে (রবি শস্যের জমিতে) দেওয়া হচ্ছে ৪৮ লক্ষ টাকার বাঁধ। উপজেলার নাইন্দার হাওরে সরকারী বরাদ্দের এমন অপচয় হচ্ছে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার বড়বন্দ থেকে নাইকো সেতু পর্যন্ত (১৫ ও ২৭ নম্বর পিআইসি) প্রায় সোয়া দুই কিলোমিটার এলাকা নিয়ে নাইন্দার হাওরে দেওয়া হয়েছে মাটির বাঁধ। এটি এখানকার কিছু রবি শস্যের জন্য দেওয়া বাঁধ। অথচ. রবি শস্যের মৌসুম ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এখানকার কোন জমিতে এখন আর কোন সবজী কিংবা শস্য নেই। এই অংশের জমিতে বোর’র চাষাবাদ হয় না। এই বাঁধটি যেদিকে নেওয়া হয়েছে, সেদিকে না নিয়ে দোয়ারাবাজার সদর ইউনিয়নের বড়বন্দ থেকে গুচ্ছগ্রাম হয়ে নাইকো সেতুতে গেলে হাওরের কাজে লাগতো। এখন যেভাবে বাঁধ হয়েছে, হাওরের কোন কাজে লাগবে না। কেবল টাকার অপচয় হবে।
শরীফপুর গ্রামের সরিষা চাষী রেনু মিয়া ও বড়বন্দ গ্রামের হারুন মিয়া বললেন, ‘নদীর পাড়ে কিছু মরিচ খেত করেছিলাম। সব মরিচ খেত বাঁধ দেবার নামে নষ্ট করা হয়েছে। অথচ. এই বাঁধ মানুষের কোন কাজে আসবে না।’
সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বৃহৎ দেখার হাওরের সামান্য কিছু বোরো জমি রক্ষায় কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই হাওরের সদর উপজেলা অংশের দরিয়াবাজ গ্রামের একপ্রান্ত থেকে মিয়ারটেকা ভায়া দরিয়াবাজ গ্রামের অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত একটি অপ্রয়োজনীয় বাঁধ হচ্ছে বলে এলাকাবাসী গত ৮ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেছেন। ২৪৪৪ মিটার দীর্ঘ এই অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯১ লাখ টাকা।
দক্ষিণ সুনামগঞ্জের আস্তমা গ্রামের কৃষক হাসান মাহমুদ ও বল্লভপুর গ্রামের মাওলানা নজরুল ইসলাম বলেন,‘দেখার হাওরের বোরো ফসল রক্ষাবাঁধ হচ্ছে মহাসিং নদীর মাঝে উথারিয়া খালে ও নদীর দুই তীরে, ঐ বাঁধগুলো যত ভাল হবে, উঁচু হবে, হাওরের উপকারে আসবে। দরিয়াবাজ গ্রামের একপ্রান্ত থেকে মিয়ারটেকা ভায়া দরিয়াবাজ বাঁধ হাওরের কী কাজে আসবে, আমাদের জানা নেই।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া বলেন,‘যেদিক দিয়ে হাওরে পানি ঢুকে, সেখানে বাঁধ হবার কথা, কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে যেদিকে পানি ঢুকে না সেখানেও বাঁধ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে, এগুলো যাচাই করা হচ্ছে, অভিযোগ সঠিক হলে যারা বাঁধের স্থান নির্বাচন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইতিমধ্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।