আমার পেট কেটে সন্তান বের করে হত্যা করেছে তারা

প্রকাশিত: ১০:৫৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৭

ক্রাইম ডেস্ক : ৯ মাসের গর্ভবতী ছিলেন রোহিঙ্গা নারী সায়েদা বেগম। বাড়িতে তার প্রসব বেদনা শুরু হয়; কিন্তু সেখানে ঘোর জটিলতা দেখা দেয়ায় বেদনা নিয়েই বাড়ির পাশের হাসপাতালের পথ ধরেন তিনি। সন্তান জন্মদানের সময় সহায়তার আশায় হাসপাতালে পাড়ি জমালেও সেখানে গিয়ে ভয়াবহ নৃশংসতার মুখোমুখি হন তিনি। সায়েদা বেগম এখনো সেই দুঃস্মৃতি স্মরণ করে আঁতকে উঠেন। তিনি বলেন, সেদিন চিকিৎসকরা তার পেট কেটে সন্তান বের করে আনেন এবং হত্যা করেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম কসমোপলিটনের ড্যানিয়েল ভিলাসানাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সায়েদা বেগম এসব কথা বলেন। ড্যানিয়েল ভিলাসানা বলেন, ‘যখন তিনি আমাকে এসব কথা বলছিলেন তখন তার মুখ ফ্যাঁকাশে হয়ে যায়। ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, আমি পরিষ্কারভাবে মনে করতে পারছি, আমার একটা সন্তান ছিল। সে কান্না করছে; কিন্তু আমি জানতে পারি নাই সে ছেলে না কি মেয়ে ছিল।’
কয়েক মিনিট পরে কেউ একজন এসে তাকে বলেন, আমরা তোমার সন্তানকে হত্যা করেছি। একথা শুনেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সায়েদা বেগম; কয়েকদিন ধরে পড়ে থাকেন মেঝেতে। এসময় হাসপাতালের চিকিৎসক এবং নার্সরা হাঁটার সময় মেঝেতে পড়ে থাকা সায়েদাকে লাথি মারেন। তবে একজন নার্স রোহিঙ্গা এই নারীকে গোপনে ওষুধ দেন।
‘হাসপাতালে তারা আমাকে পশুর মতো মনে করে। তারা আমার সন্তানকে হত্যা করে। আমি দেখেছি, আমার মতো আরো অনেক রোহিঙ্গা সেখানে নির্যাতিত হয়েছেন।’
সায়েদা বেগম একজন রোহিঙ্গা নারী। রোহিঙ্গারা হচ্ছেন মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী; যারা দশকের পর দশক ধরে মিয়ানমারে পরিকল্পিত বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার। দেশটিতে তাদের নাগরিকত্ব নেই।
গত আগস্টের শেষের দিকে রাখাইনের নিরাপত্তাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) গুটি কয়েক সদস্যের হামলায় ১২ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়। পরে বৌদ্ধ মিলিশিয়া ও স্থানীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা বিরোধী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে। তারা রোহিঙ্গাদের শত শত গ্রাম পুড়িয়ে দেয়, গণহত্যা, গণধর্ষণ ও স্কুল ধ্বংস করে।
গত চারমাসে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। রুয়ান্ডার গণহত্যার পর এটিই অল্প সময়ে ব্যাপকহারে দেশত্যাগের ঘটনা। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার জেইদ রা’দ আল হুসেইন বলেছেন, রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের পরিচালিত অভিযান জাতিগত নিধনে পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণের শামিল।
মিয়ানমারের হাসপাতালে সায়েদা বেগম দেখেছেন, রোহিঙ্গা নারীরা ইঞ্জেকশন নেয়ার পর পরই কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা গেছেন। পরে হাসপাতালের পেছনের দরজা দিয়ে অন্য এক নারীর সঙ্গে তিনি পালিয়ে যান।
এ ঘট্নার এক মাসের কম সময়ের মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সায়েদা বেগমের গ্রামে হামলা চালায়। তার স্বামী ও মা’সহ পরিবারের ছয় সদস্যকে হত্যা করে তারা। তখনও ব্যথায় কাতড় সায়েদা বেগম দিশাহীন হয়ে বাংলাদেশের পথ ধরেন। পরে অন্য গ্রামবাসীদের সহায়তায় কক্সবাজারে পাড়ি জমাতে সক্ষম হন তিনি।
বাংলাদেশে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সায়েদা বেগম বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আমাকে বাঁচিয়েছেন।’ মিয়ানমারের হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর তার শরীরিক সমস্যা বাড়তে থাকায় বর্তমানে বাংলাদেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সহায়তা দরকার। বিশ্ব যদি সহায়তায় এগিয়ে আসে তবেই আমরা মিয়ানমারে ফিরতে পারবো। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তাও দরকার। এটা আমার মাতৃভূমি, আমার বাবার কবরস্থান। আমাদের সবকিছুই সেখানে।’
আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটি ও রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের যৌথ এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের প্রায় ৬০ শতাংশই নারী এবং শিশু। এই নারীদের ৮৭ হাজারই গর্ভবতী। কিন্তু এদের অর্ধেকই স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত। এছাড়া ৭০ শতাংশ নারীই জানেন না কোথায় তারা স্বাস্থ্যসেবা পাবেন।
উৎস : কসমোপলিটন।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

December 2017
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031  

সর্বশেষ খবর

………………………..