হয়রানির ওপরনাম সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস!

প্রকাশিত: ১০:০৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২২, ২০২২

হয়রানির ওপরনাম সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস!

Manual7 Ad Code

জোরপূর্বক নারীর স্বাক্ষর নিলেন মাজহারুল

মোঃ রায়হান হোসেন:
জোরপূর্বক নারীর স্বাক্ষর নেওয়াতে ঘুরেফিরে ফের আলোচনায় আসলেন সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম। পাসপোর্ট অফিসে নারীকে হয়রানি ও তাঁর কাছ থেকে জোরপূর্বক একটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম এমন গুরুতর অভিযোগ এনে নিকটস্থ থানায় সাধারণ ডায়রী (জিডি) করেছেন এক ভুক্তভোগী নারী আর এই ঘটনায় ফের তুলকালাম সৃষ্টি হয়েছে সিলেটে।

Manual4 Ad Code

জানা গেছে- পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন তিনি। কয়েক দফা ভোগান্তির পর আঙুলের ছাপ (ফিঙারপ্রিন্ট) দিতে পারলেও পরিচালকের কক্ষে তাকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে বানোয়াট অভিযোগ লিখে নেওয়া হয়েছে। গত বুধবার সিলেট মহানগরের মোগলাবাজার থানায় এ জিডি করেন সাহারা খানম (৫৩) নামের এক নারী। সোমবার সন্ধ্যায় বিষয়টি জানাজানি হয়। সাহারা খানম সিলেটের মোগলাবাজার থানার গোটাটিকর পাঠানপাড়া এলাকা বাসিন্দা।

জিডির বর্ণনা অনুযায়ী, ১০ নভেম্বর বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয়ে পাসপোর্টের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন জমা দেন সাহারা খানম। দায়িত্বরত কর্মকর্তা এরপর তাকে কার্যালয়ের ২০৭ নম্বর কক্ষে (১৩ নভেম্বর) এসে আঙুলের ছাপ দিতে বলেন। নির্দিষ্ট দিনে ওই কক্ষে গেলে সেখানকার কর্মকর্তা তাকে জানান- আবেদন অনলাইনে জমা হয়নি। তাই পরদিন তাকে পুনরায় আসতে হবে। ২০৭ নম্বর কক্ষ থেকে বেরোনোর সময় এক ব্যক্তি ওই নারীকে বলেন- আবেদনে ‘মার্কা’ (দালাল ধরার বিশেষ চিহ্ন) না থাকায় সেটি অনলাইনে জমা হয়নি। ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে ওই নারী পরদিন (১৪ নভেম্বর) সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের কাছে গিয়ে সহায়তা চান। পাসপোর্ট কার্যালয়ের পাশেই বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়। তখন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ওই নারীকে সেই কক্ষে গিয়ে তার (অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার) কথা বলতে বলেন। সাহারা খানম এরপর পাসপোর্ট কার্যালয়ে গিয়ে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের কথা বলতেই ২০৭ নম্বর কক্ষের দায়িত্বরত ব্যক্তিটি দুর্ব্যবহার করেন। এতে ব্যথিত হয়ে তিনি পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক অতিরিক্ত মহাপরিচালকের সঙ্গে মুঠোফোনে বিষয়টি জানান। তখন ওই অতিরিক্ত মহাপরিচালক তাকে বিভাগীয় আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলামের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

জিডিতে অভিযোগ করা হয়েছে- অতিরিক্ত মহাপরিচালকের পরামর্শ অনুযায়ী সাহারা খানম পরিচালকের কক্ষের সামনে যান এবং দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর সাক্ষাতের সময় পান। দেখা হওয়ার পর তিনি পুরো বিষয় জানান। তখন মাজহারুল ইসলাম তাকে জানান- পাসপোর্টের জন্য ছয়েফ খান নামের এক ব্যক্তিকে আট হাজার টাকা দিতে হয়েছে বলে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। অভিযোগ দিলে আঙুলের ছাপ নেওয়া হবে বলে জানান। কিন্তু তিনি এমন মিথ্যা অভিযোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

সাহারা খানমের ভাষ্য অনুযায়ী- এরপর মাজহারুল ইসলাম ভয়ভীতি দেখানো শুরু করেন। একপর্যায়ে কার্যালয়টির আরও দুজন কর্মকর্তাকে এনে ওই কক্ষের দরজা বন্ধ করে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার জন্য হুমকি দেন। এ অভিযোগ না করলে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা ও হত্যার হুমকিও তারা দেন। পরে প্রাণ ভয়ে তিনি একটা সাদা কাগজে ‘ছয়েফ খানকে আমার পাসপোর্টের জন্য ৮ হাজার টাকা দিয়েছি’ বাক্যটি লিখে দেন। এরপর পাসপোর্ট কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সাহারা খানমের আঙুলের ছাপ নেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিভাগীয় আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেন নি।

জিডির বিষয়টি নিশ্চিত করে মোগলাবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শামসুদ্দোহা গণমাধ্যমকে বলেন- থানায় যেকোনো জিডি হলে তা আদালতে অবহিত করতে হয়। এ জিডির বিষয়ও আদালতের নজরে আনা হলে বাদীর উপস্থিতিতে রোববার শুনানি হয়। পরে আদালত জিডির বিষয়টি তদন্তের আদেশ দেন। তারা ওই নারীর অভিযোগ তদন্ত করছেন।

Manual4 Ad Code

উল্লেখ্য- অদৃশ্য এক মায়ার টানে বারবার সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে ঘুরেফিরে আসেন এ কে এম মাজহারুল ইসলাম। কী সেই মায়া যার জন্য সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে চতুর্থ বারের মতো দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বর্তমানেও তিনি পরিচালক পদে রয়েছেন।

Manual1 Ad Code

জানা গেছে- এ কে এম মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন প্রকাশ হল্ওে আমলে নিচ্ছেন না দায়িত্বশীলরা। বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড.এ কে আব্দুল মোমেন এমপি’র নজরে পড়লে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন- সিলেট পাসপোর্ট অফিসে কোন দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবেনা। তিনি অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন।

সিলেট পাসপোর্ট অফিসের বর্তমান পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম এর আগে আরো তিন বার সিলেট পাসপোর্ট অফিসে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিবারই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে। তিনি ১৯৯১-১৯৯২ সালে শেখঘাটস্থ সিলেট পাসপোর্ট অফিসে প্রথম কাজ করেন। ২০১১ সালে নগরীর উপশহরে এম.আর.পি পাসপোর্ট চালু হলে তিনি আবার সিলেট আসেন। এ সময় তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তিন মাসের মধ্যে তাকে সিলেট থেকে বদলী করা হয়। কিন্তু তিনি এ বদলী মেনে নিতে পারেন নি। ব্যাপক তদবীর এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দিয়ে লবিং করে ২০১৭ সালে আবার সিলেট চলে আসেন। তবে দুর্নীর্তির জন্য বেশিদিন টিকতে পারেন নি। এসময় তৎকালীন পরিচালক সেলিনা বানুকে প্রধান করে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাকে আবার ঢাকায় বদলী করা হয়। এতো কিছুর পরও তিনি ২০১৯ সালের সেপটেম্বর মাসে চতুর্থ বারের মতো সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এ বিষয়টি শুরু থেকে মেনে নিতে পারেনি সিলেটের সাধারণ মানুষ।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে- সিলেটে ই-পাসপোর্ট চালু করার উদ্যোগ নেয়ার পর একজন অভিজ্ঞ পরিচালক নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। এ খবরে তৎপর হয়ে উঠেন এ কে এম মাজহারুল ইসলাম। শুরু করেন ব্যাপক তদবির। এ সময় তিনি ঢাকায় ই-পাসপোর্ট কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রাপ্ত সরকারের একজনকে দিয়ে তার লবিং শুরু।

Manual8 Ad Code

সূত্র বলছে- কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দায়িত্ব প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকায় তিনি এ লবিং করেন। অন্যদিকে সিলেট বিভাগের একজন মন্ত্রীর এন.আর.বি উপদেষ্টাকেও কাজে লাগান এ কে এম মাজহারুল ইসলাম। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ঐ এন.আর.বি উপদেষ্টা মন্ত্রীকে জানান সিলেটে ই-পাসপোর্ট চালু করতে হলে এ কে এম মাজহারুল ইসলাম এর বিকল্প নেই। তিনি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। এ কে এম মাজহারুল ইসলাম অত্যন্ত সৎ এবং দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবেও মন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনা করে একটি ডিও লেটারও সংগ্রহ করে এই চক্র। তারপর যা হবার তাই হলো। বার বার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সেই এ কে এম মাজহারুল ইসলাম সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক হয়েছে চতুর্থ বারের মতো সিলেট এলেন এবং শুরু করলেন তাঁর পুরোনো কার্যক্রম। পূনরায় হয়ে উটেন ঘুষের রাজা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি নাকি সিলেট পাসপোর্ট অফিসে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী এক সিন্ডিকেট। যারা মানুষের কাছ থেকে আইনের নানা অজুহাত দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা। ইমিগ্রেন্ট, ভিজিট, স্টুডেন্টসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে এখান থেকে লোকজন বাইরে যাচ্ছেন। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে কর্মী ও ইউরোপ-আমেরিকায় স্টুডেন্ট ভিসায় শিক্ষার্থীদের যাওয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই পাসপোর্ট তৈরীর হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন ছয়শতাধিক পাসপোর্টের ফাইল জমা হয়।

সুত্রমতে- সিলেট পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতিমাসে যে ঘুষের টাকা সংগ্রহ করা হয় সে টাকার ভাগ নাকি প্রভাবশালী মহলও পেয়ে থাকেন। আর এ কারণে এতোসব অপকর্মের পরও বহাল তবিয়তে টিকে আছেন পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলাম।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

November 2022
S S M T W T F
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
2627282930  

সর্বশেষ খবর

………………………..