জৈন্তাপুরে সিআইডির হাতে সাজাপ্রাপ্ত ও ৪৫টি মামলার পলাতক আসামী শামীম আটক

প্রকাশিত: ৯:২৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০১৯

জৈন্তাপুরে সিআইডির হাতে সাজাপ্রাপ্ত ও ৪৫টি মামলার পলাতক আসামী শামীম আটক

জৈন্তাপুরে সন্ধান মিলল ১৩০ কোটি টাকরও বেশি আত্মসাৎ ও পাচারের দায়ে অভিযুক্ত ফারইষ্ট ইসলামী মাল্টি কো-অপারেটিভের চেয়ারম্যান শামীম কবিরের।২০১৫ সালের ৩০সেপ্টেম্বর কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তাদের দায়ের করা অন্তত ৪৫ টি মামলা হলেও শামীম কবীরের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। শামীম মালয়েশিয়া পালিয়ে গেছেন এমন কথা চাউর হলে দুদক কর্মকর্তারা তাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

তবে গত ৫ জুলাই সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট বন্দহাটি গ্রামের তার ক্রয়কৃত বিলাসবহুল বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। জানা গেছে, দীর্ঘ ৪ বছর ধরে শামীমাকে খুঁজে না পাওয়ায় অর্থ আত্মসাৎ মামলায় ধীর গতি চলে আসে। এক পর্যায়ে ১৭ হাজার ৫৯৯ জনের প্রায় ৮৫ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দায়ের করা ১৩টি মামলার তদন্ত ভার চলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে। সংস্থাটি গত ১ বছরের তদন্তে শামীম কবীরের সন্ধান পায় সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় আত্মগোপনে আছে।

আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শামীম সিআইডিকে জানিয়েছেন, সিলেটে দ্বিতীয় বিয়ে করে সেখানেই আত্মগোপনে থাকেন। তার আত্মীয় স্ব^জনদের কাছে বলেন- তিনি মালোশিয়ায় অবস্থান করেছেন। আত্মসাথের টাকা দিয়ে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জৈন্তাপুর উপজেলা সারীঘাট, নিজপাট বন্দরহাটি, নিজপাট খাসিয়াহাটি গ্রামে বিপুল পরিমান সম্পদ ও গড়েছেন বলে জানান।

সূত্র জানায় গ্রাহকের কাছে থেকে টাকা আদায়ের সময় প্রতি লাখের বিপরিতে আড়াই হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। এভাবে ৪বছরে দ্বিগুন এবং ৬বছরে তিনগুন দেওয়া সহ বিভিন্ন লোভনীয় প্রকল্প খুলে আমানতকারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেন শামীম কবীর। পরবর্তীতে আমানতকারীদের কয়েক মাস লাভ্যাংশ দেন।এভাবে কিছু দিন অফিস চালিয়ে আমানতকারীদের লাভ দেব-দিচ্ছি বলে এবং তাদের নামে বিভিন্ন স্থানে প্রকল্প খুলে জায়গা জমি প্লট, ফ্যাট কেনা হয়েছে বলে মিথ্যা তথ্য দিত।কয়েক বছর প্রলোভন দেখিয়ে সব অফিস ঘুটিয়ে শামীম কবীর আত্মগোপন করেন।

যে ভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়- তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে মোঃ শামীম কবীরের নেতৃত্বে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল। হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম, কুমিল্লার বিভিন্ন মৌজায় ক্রটিপূর্ণ ভেজাল জমি কেনা হয়। ক্রটিপূর্ণ ভেজাল জমি কম মূল্যে কিনে গ্রাহকের কাছে অধিক মূল্যের ভাউচার দেখাত।

এছাড়া বিভিন্ন ধরনের রহস্যজনক খরচ ও ভূয়া ভাউচার সৃষ্টি করে অর্থ আত্মসাৎ করে। একপর্যায় প্রতিষ্ঠানটির ২৩ কর্মকর্তা গ্রাহকের আমানতের অর্থ ফেরত না দিয়ে ১৩৫ কোটি ৬৭ লাখ ২৭ হাজার ১৩৮ টাকা ব্যক্তিগত একাউন্টে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। তদন্তের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবু সাইদ এ প্রতিবেদকে জানিয়েছেন, কয়েকটি স্থানে শামীম কাবীর বিপুল পরিমান সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। সে সব সম্পদের এবং আত্মসাতের টাকা গুলো কোথায় কোথায় গেছে সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।

সিআইডির তদন্তে থাকা মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার দাউদকান্দি শাখার ২১৯জন আমানতকারীর নিকট থেকে ৪১ লাখ ৭০ হাজার ৯৩৯ টাকা ২০১১ সাল হতে ২০১২পর্যন্ত আদায় করে। একই ভাবে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার খিরনশাল শাখার ১ হাজার ২২০ জনের কাছ হতে ৩ কোটি ৫৬ লাখ ৭৮ হাজার ১৯৭ টাকা ২০০৭ সাল হতে ২০১২ সাল পর্যন্ত আদায় করে। একই উপজেলার মুন্সিরহাট শাখার ১ হাজার ৯১৮ জনের কাছ হতে ১০ কোটি ৮০ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৯ টাকা ২০০৭ সাল হতে ২০১২ সাল পর্যন্ত আদায় করে।

কাশীনগর নামে আরেক শাখায় ১ হাজার ১৭৫ জনের কাছ হতে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ টাকা আদায় করে। চৌদ্দগ্রাম বাজার শাখায় ১ হাজার ১৭৮ জনের কাছ হতে ৩কোটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮২৯ টাকা আদায় করে। কাদৈর বাজার শাখায় হতে ২হাজার ৯৩৫ জনের কাছ হতে ১৪ কোটি ৫৩ লাখ ২৫ হাজার ৭১৬ টাকা আদায় করে। লাকসাম উপজেলা শাখায় ১হাজার ৬৫৭ জনের কাছ হতে ৮ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার ৯০৫ টাকা আদায় করে। লাঙ্গলকোট উপজেলার বাংগড্ডা শাখার ৪৯৩ জনের কাছ হতে ১ কোটি ৬২ লাখ ৬৭ হাজার ৫১১ টাকা আদায় করে।

মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথের পেটুয়া শাখার ৯৫৪ জনের কাছে হতে ২ কোটি ২৬ লাখ ৮৭ হাজার ৭৩৫ টাকা। ২০১১ সাল হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর শাখার ৩৪১ জানের কাছ হতে ৪ কোটি ৮৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা আদায় করে। ২০০৯ সাল হতে ২০১২ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা বিশ্ব রোড পদুয়া বাজার শাখায় ১ হাজার ৮৮৪ জনের কাছ হতে ১১ কোটি ২৮ লাখ ৯৯ হাজার ৬৬৬ টাকা আদায় করে। একই সময়ে সদর দক্ষিণ উপজেলার ভূশ্চি শাখার ১ হাজার ৮৮৪ জনের কাছ হতে ১০ কোটি ১৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮৭৪ টাকা আদায় করে। গৈয়ার ভাঙ্গা শাখার ১ হাজার ৬৩৩ জনের কাছ হতে ৭ কোটি ৭১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৬২ টাকা আদায় করে।

সিলেটের জৈন্তাপুরে এসে নিজেকে একজন দানশীল ও প্রভাবশালী পরিচয় দিয়ে স্থানীয় উপজেলার একটি মহলের সাথে সখ্যতা গড়ে এবং লাটিয়াল বাহিনী তৈরী করে। বাহিনীর ছত্র ছায়ায় সারীঘাট ইন্দারজু এলাকায় বাল্য বিয়ে করে ঘর সংসার করে। উপজেলার সচেতন মহল জানান শামীম কবীর বড় ধরনের ইয়াবা ও মাদক পাচারকারীদের মাধ্যমে মাদক ও ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করত।

এদিকে নিজপাট খাসিয়া হাটি এলাকায় জায়গা ক্রয় করে সরকারি ছড়ার প্রায় ২শতক জায়গা দখল করে ৪ তলা বিলাস বহুল বিল্ডিং নির্মান করে। প্রভাবশালী চক্রের ছত্র-ছায়ায় থাকার কারনে তার অপরাধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস করেনি।সে তার বাহিনীর মাধ্যমে জৈন্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট টাকা লগ্নি ব্যবসা বা দাদন ব্যবসা বা সুদ ব্যবসা পরিচালনা করত।

এদিকে শামীম কবীর গত ৪ জুলাই দিবাগত রাত ২টায় (৫জুলাই) সিআইডি অর্গানাইজ ক্রাইম ঢাকার বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক লিটন দেওয়ান, সিআইডি অর্গানাইজ ক্রাইম ঢাকার বিভাগের সিনিয়র এএসপি আবু সাইদ এবং জৈন্তাপুর মডেল থানার এএসআই রায়হান কবীরের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করে নিজপাট বন্দরহাটি গ্রামের বিলাস বহুল বাড়ী হতে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। শামীম কবীর গ্রেফতারের পর পর গা ঢাকা দিয়েছে তার গড়ে তুলা বাহিনীর সদস্যরা।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..