কি ঘটেছিল সেদিন ইউএস বাংলা বিমানের অভ্যন্তরে?

প্রকাশিত: ১১:৪৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০১৮

কি ঘটেছিল সেদিন ইউএস বাংলা বিমানের অভ্যন্তরে?

Manual2 Ad Code

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সাম্প্রতিক সময়ে নেপালে ইউএস-বাংলার ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী কামরুন্নাহার স্বর্ণা। সেদিন স্বামী মেহেদী হাসানসহ ও পরিবারের অন্য সদস্য ভাই, ভাবীসহ পাঁচজন বিমানে যাচ্ছিলেন নেপাল বেড়াতে। ভয়াবহ সেই বিমান দুর্ঘটনায় কামরুন্নাহার স্বর্ণা বেঁচে গেলেও মারা গিয়েছিলেন ফুফাতো ভাই আলোকচিত্রী এফ এইচ প্রিয়ক, তার স্ত্রী অ্যানি ও মেয়ে তামাররা প্রিয়ম্ময়ী। গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী স্বর্ণা শুক্রবার বিকেলে বারডেম হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাকলায়েন রাসেলের সঙ্গে এক ফেসবুক লাইভে সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।

আমরা পরিবারের পাঁচ সদস্য যাচ্ছিলাম নেপাল বেড়াতে। সাতদিনের ট্যুরে কাঠমান্ডু ও পোখারাতে ঘুরার প্ল্যান ছিলো আমাদের। এটা আমার জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণ ছিলো। আমরা বিমানে উঠার আগে একটা স্ট্যাটাসও দিয়েছিলাম। আমাদের সিটের সিরিয়াল ছিলো একটু পেছনে। হয়তো আল্লাহর ইচ্ছাতেই এই সিট পেয়েছিলাম বেঁচে যাবো বলে। কেননা, সেদিনের সামনের সিটের যাত্রীরা অনেকে মারা গিয়েছিলেন কারন তাদের সিট একটার সঙ্গে আরেকটা চেপে গিয়েছিলো। তাড়া হুড়োহুড়ি করে বের হতে পারেননি চাপা পড়ার কারনে। কারো গলা, কারো পেট, কারো পিঠ আটকে গিয়েছিলো, বের হতে পারছিলো না।

Manual3 Ad Code

আমরা রওনা দেবার পর বিমানের পরিবেশ খুব স্বাভাবিক ছিলো। খাবার দাবার দেয়া হচ্ছিলো। প্লেট পরিষ্কার করা হচ্ছিলো। হিমালয় ক্রস করার সময় আমরা জানালা দিয়ে ছবি তুলছিলাম। প্রিয়ম্ময়ী ঘুমাচ্ছিলো। তবে প্লেন যখন ত্রিভূবন বিমান বন্দরে এসে পরছিলো, তখন ল্যান্ডিং গিয়ার দেখা যাচ্ছিলো জানালা দিয়ে। ল্যান্ড করার সময় প্লেন যখন নিচে যাচ্ছিলো তখন প্রিয়ম্ময়ী ঘুম থেকে উঠে অনেক কান্নাকাটি করছিলো। আশপাশের মানুষগুলোও তাকাচ্ছিলো যে বেবিটা এতো কান্নাকাটি করছে কেন? ফেরেস্তা বাচ্চা, হয়তো সে কিছু টের পাচ্ছিলো যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে।

আমি জানালা দিয়ে দেখছি, প্লেনটা বারবার বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল এবং সোজা হয়ে যাবার চেষ্টা করছিলো। তবে কেন এমন হচ্ছিল বুঝছিলাম না। আবার এ নিয়ে ভেতর থেকে কোন ঘোষণা বা ডিক্লারেশনও ছিলো না। পরে জানতে পারলাম, বিমানটি নাকি কয়েকবার চক্কর দিয়েছিলো আকাশে।

Manual5 Ad Code

একটু পর অনুভব করি বিমানটি অনেক ভাইব্রেশন দিচ্ছিলো এবং বেশ বড়ো ঝাঁকি দিচ্ছিলো। তখনও বুঝতে পারছিলাম না যে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। প্রথম ঝাঁকি দেবার সময়ে আমি প্রিয়ক ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছিলাম সিটটা আকড়ে ধরে। হঠাৎ করে বড়ো একটা ধাক্কা লেগে প্লেনটি মাটিতে আছরে পড়লো।  আমি সামনের সিটটাতে জোড়ে একটা থাক্কা খেলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি অনেক ধোয়া। পুরো প্লেনটা অন্ধকার হয়ে গেলো। ভাবছি, স্বপ্ন দেখছি না তো। বুঝতে পারছিলাম না কিছুই।

আমি পায়ের নিচে আগুনের লাভার মতো কিছু একটা দেখতে পাচ্ছিলাম। ডান দিক থেকে আগুন আমাদের দিকে আসছিলো। তখন ভয়ে শীতল হয়ে যাচ্ছিলাম।

আমি তখন আমার হাজবেন্ড মেহেদী হাসানকে বলছিলাম, ‘প্লিজ, আমি আগুনে পুড়ে মরতে চাই না। আগুন আমার গায়ে লাগলে সারা শরীর পুড়বে, আমি খুব কষ্টে মারা যাবো! জাস্ট এটা ফিল করতে পারছিলাম না।’

তখন আমার হাজবেন্ড খুব ভয় পেলো। সে বুট জুতা খুলে বিমানের জানালা ভাঙ্গার চেষ্টা করতে লাগরো। কিন্তু কিছুতেই ভাঙ্গছিলো না। মেহেদী বলছে, সামনে থেকে আলো দেখা যাচ্ছে। ওদিক দিয়ে বের হতে পারবো।

মেহেদীকে দেখলাম, হামাগুড়ি দিয়ে সামনের দিক থেকে বের হবার চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে আলোর দিকে যেতে লাগলো এবং বের হবার চেষ্টা করতে লাগলো। প্রথমে উনি বের হতে পারলেন। দেখি দুই সিটের মাঝখানের রাস্তাটাও ক্লোজ হয়ে গেছে। মাঝখানের রাস্তাটা চাপ লেগে সরু সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গিয়েছিলো। মেহেদী একপর্যায়ে বের হতে পারলেন। ওরপর আমি নেই দেখে বাইরে থেকে আমাকে ডাকছেন, ‘কোথায় তুমি? বের হও..।’ আমার পেছনে পেছনে বের হও।

আমার জাস্ট হাতটা বের হয়ে গিয়েছিলো। আমি আসলে বের হতে পারছিলাম না।

Manual5 Ad Code

এক পর্যায়ে বিমানের ফাটল দিয়ে ঢুকে আমার সিট পর্যন্ত এসে আমাকে বের করে আনলেন আমার স্বামী। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ভাবীকেও বের করে আনেন। এর কিছুক্ষণ পরই বিমানটি প্রচন্ড শব্দে বার্স্ট হলো। পুরো প্লেনেই আগুন ধরে গেলো।

প্লেনে দুইটা বেবি ছিলো। পেছনের যারা ছিলো তারা মারা গেলো। সামনে হাসান ইমাম নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন তার স্ত্রী সহ। তিনি আমার সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। আমি যখন বের হয়ে আসি তখন দেখি তিন-চার জন বিমানের মানুষ বাইরে পরে আছে। একজন পুরুষ একজন মহিলাকে অবশ্য সুস্থ অবস্থায় দাড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। প্রায় ১০ জনের মতো নিজের চেষ্টায় সেদিন বের হতে পেরেছিলেন।

স্বর্ণা বলেন, ‘দূর্ঘটনার পরার পর প্রিথিলা রশিদকে দেখিনি। তবে বিমানে ওঠার আগে একবার এই রকম একজনকে দেখেছিলাম।’

স্বর্ণা বলেন, যখন প্লেনটা ক্রাস করলো তখন আমিতো জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারের অনেকেই মারা গেলেও আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন নিশ্চয় কোন ভালো উদ্দেশ্যে। এতদিন সাইকোলজিক্যাল ট্রমার মধ্যে ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ আমি এখন ভালো আছি। আমি এমবিবিএস ফাইনাল প্রফ দিয়েছি। এখন চিকিৎসক হতে যাচ্ছি। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। যাতে পেশাটাকে মহৎ কাজে লাগাতে পারি।

স্বর্ণা  বলেন, ‘আমার ইচ্ছে আছে, ভবিষ্যতে গরীব রোগীদের জন্য হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। বিশেষ করে দূর্ঘটনায় আক্রান্তদের সেবায় এগিয়ে আসবো। এসব বিষয়ে আরো অভিজ্ঞতা অর্জন করবো। যারা নিহত হয়েছে তাদের যেন বেহেস্ত নসীব হয় এই দোয়া সবাই করবেন।

Manual2 Ad Code

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..