পরিবার পরিকল্পনায় আগ্রহ বাড়ছে সিলেটে

প্রকাশিত: ৭:৫৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৫, ২০২২

পরিবার পরিকল্পনায় আগ্রহ বাড়ছে সিলেটে

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : গত ১৩ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার বামৈ ইউনিয়নের আব্দুল আউয়াল মিয়ার বাড়িতে বামৈ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে একটি উঠান বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সেখানে গর্ভকালীন সেবা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, বাল্যবিবাহর কুফল, পরিবার পরিকল্পনা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের গুরুত্ব, জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রতিটি পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে সক্ষম দম্পতিদের সঙ্গে আলোচনা হয়। পাশাপাশি ছোট পরিবারের সুবিধা এবং বড় পরিবারের অসুবিধা নিয়ে আলোচনা হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের একই পদ্ধতি দীর্ঘদিন ব্যবহার না করে পদ্ধতি পরিবর্তনর বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা দেন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক আতিকুর রহমান তালুকদার।
আতিকুর রহমান তালুকদার বলেন, পরিবার পরিকল্পনায় নারী পুরুষ সবাই এখন অনেক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ২০১২ সালে গ্রামে যখন আমরা স্যাটেলাইট ক্লিনিকে যেতাম তখন তিন থেকে চার জন নারী থাকতেন সেবা নেয়ার জন্য। কিন্তু এখন একেকটি স্যাটেলাইট ক্লিনিকে ৩০ থেকে ৪০ জন নারী আসেন সেবা নিতে।
মৌলভীবাজার জেলার আগনশি গ্রামের জান্নাতুল ফেরদৌসি বলেন, আমার দেড় বছরের একটি সন্তান আছে। আমার শাশুড়ি আরেকটি বাচ্চা নিতে বললেও আমি নিচ্ছি না। কারণ পরিবার পরিকল্পনার আপাদের কাছ থেকে আমি জেনেছি ছোট-বড় পরিবারের সুবিধা-অসুবিধা। তারা আমাকে বলেছেন, পরপর দুটি বাচ্চা নেয়ার মত শারীরিক সক্ষমতা আমার নেই। আমি আমার স্বামীকে বুঝিয়ে বলেছি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন আর বাচ্চা নেব না।
হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার পাঠানটুলা গ্রামের দুই সন্তানের জননী লাইজু আক্তার বলেন, আমার দুটি সন্তান। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অধিক বাচ্চা জন্ম দিয়ে সঠিকভাবে লালনপালন করা অনেক কষ্টকর। তাই এখন আর বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা নেই।
সিলেট বিভাগের পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত নানা তথ্য জানতে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সিলেট বিভাগের চার জেলার বিভিন্ন উপজেলা সরজমিনে পরিদর্শন করেন এই প্রতিবেদক। সেসব এলাকার শতাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের এলাকার পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের চিত্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্যমতে, সিলেট বিভাগের চার জেলার শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে সচেতনতা বেড়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ গ্রামে শহরে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও কাজ করছে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে।
চার জেলার মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বেশ কয়েকজন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুটা সহজ ছিল না। ধর্মীয় প্রভাব ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, হাওরাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে মাঠকর্মীদের। প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের বেশিরভাগ প্রবাসীই পরিবার পরিকল্পনয় আগ্রহী হন না। এতসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও গত দুই দশকে সিলেটে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার (সিপিআর) ২০.১ শতাংশ ( ১৯৯৬-৯৭) থেকে ৫৫.৪ শতাংশে (২০১৭-১৮) এ উন্নীত হয়েছে।
লাখাই উপজেলার করাব ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক সনজিত সিনহা বাপ্পী বলেন, বলেন, পরিবার পরিকল্পনার বিষয়ে এখন শহর-গ্রাামে মোটামুটি সবাই অবগত। সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। গ্রামের মানুষজনও এখন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে অনেক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
সিলেট সদর উপজেলার ফাগুইন গ্রামের রাহেনা বেগম বলেন, ‘ইখানো স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র আছে। কপারটি (আইইউডি), লাইগেশন করাইন তারা। মহিলারা খাওয়ার লাগি মাগনা (বিনামূল্যে) বড়িও (জন্মনিয়ন্ত্রণের খাবার ট্যাবলেট) দেইন।’
সিলেট পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, দম্পতিরা যেন সঠিকভাবে জেনেশুনে প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর মধ্য থেকে নিজেদের পছন্দমতো উপযুক্ত একটি পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি আমরা।
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার ৫/৬ নম্বর বাজার উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক বিশাতা কালাম হ্যাপী বলেন, অধিক বাচ্চা বা অল্প বয়েসে বাচ্চা নিলে একজন নারীর কি ধরনের শারীরিক ক্ষতি হয় তা বুঝিয়েছি, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছি। আগে আমরা তাদের কাছে বারবার যেতাম। এখন নির্দিষ্ট দিনে আমাদের ভিজিট শেষ হলেও নারীরা মোবাইলে কল দিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে খাবার বড়ি নিয়ে যান।
প্রতি চার বছর পরপর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত একটি জরিপ করে বিডিএইচএস নামক একটি সংগঠন। ২০১৭-১৮ সালের এই জরিপে দেখা যায় জাতীয়ভাবে মোট প্রজনন হার বা নারীপ্রতি সন্তান জন্ম (টিএফআর) ২ দশমিক ৩ শতাংশ। সিলেটে এই হার ২ দশমিক ৬। তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সিলেটের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন জাতীয় থেকে সিলেটের প্রজনন হার ৩ পয়েন্ট বাড়লেও সিলেট বিভাগে গত দুই দশকে প্রজনন হার ব্যাপক হারে কমেছে।
বিডিএইচএসের জরিপে দেখা যায়, সিলেটে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার (সিপিআর) ২০০৭ সালে ছিল ৩২ শতাংশ, যেখানে জাতীয়ভাবে ছিল ৫৬। ২০১৭-১৮ সালে সিলেট বিভাগে তা হয়েছে ৫৫ শতাংশ এবং জাতীয়ভাবে ৬২।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক কুতুব আহমদ বলেন, এখানকার ইতিবাচক অর্জন উল্লেখযোগ্য এবং ব্যাপক। বিডিএইচএসের জরিপ অনুযায়ী সিলেটের সিপিআর হারের দূরত্ব জাতীয় থেকে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। যে ৭ শতাংশ গ্যাপ আছে সেটাও আমরা অতিক্রম করার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার (সিপিআর) বাড়লে প্রজনন হার (টিপিআর) কমে। একই পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০০৭ সালে সিলেটে টিপিআর ছিল ছিল ৩.৭ শতাংশ আর জাতীয়ভাবে ছিল ২.৭। সেটি কমে ২০১৭-১৮ সালে সিলেটে এসেছে ২.৬ শতাংশ, আর জাতীয়ভাবে ২.৩। পয়েন্ট ৩ শতাংশ ব্যবধান কমে এসেছে। এটির সঙ্গে জনশুমারির তথ্য সমন্বয় করলে দেখা যায় ,সিলেট বিভাগে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কতটা কমেছে। ২০১১ সালে সিলেটে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.২২। বর্তমানে সিলেট বিভাগে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৯৬ শতাংশ, যেটা জাতীয় পর্যায়ে ১.১৫ শতাংশ।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

December 2022
S S M T W T F
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  

সর্বশেষ খবর

………………………..