পার্কভিউ মেডিকেলে তরুণীর মৃত্যুর পর ‘দোষ ঢাকতে’ মরদেহ আইসিইউতে নিয়ে ‘নাটক’

প্রকাশিত: ১২:৩২ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৯, ২০২০

পার্কভিউ মেডিকেলে তরুণীর মৃত্যুর পর ‘দোষ ঢাকতে’ মরদেহ আইসিইউতে নিয়ে ‘নাটক’

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক :: সিলেট পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের অবহেলায় তরুণীর মৃত্যুর পর ‘দোষ ঢাকতে’ মরদেহ আইসিইউতে ঢুকিয়ে ‘নাটক’ সাজানোর গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। হাসপাতালটির ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মৌসুমী দেব রায় (মৌটুসী মৌ)-এর অবহেলাতেই তরুণীর এমন মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে বলে স্বজনদের অভিযোগ।

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার বড়ফলিরগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মো. আবদুল জব্বারের মেয়ে নূরী বেগম (২৪) গত ১৮ অক্টোবর সিলেটের পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। স্বজনদের অভিযোগ- হাসপাতালের চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে নূরীর মৃত্যু ঘটেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি।

জানা গেছে, নূরী বেগম যেদিন মারা যান ওই দিন ডিউটিতে ছিলেন ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মৌসুমী দেব রায় (মৌটুসী মৌ) অভিযোগের তীর তার দিকেই। তারই অবহেলায় প্রাণ গিয়েছে নূরী বেগমের পরিবারের অভিযোগ। নূরী বেগম মাথা ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ৮ অক্টোবর থেকে নূরীর মাথা ব্যথা শুরু হয়েছিলো। ব্যথা বাড়ায় ১৩ অক্টোবর সিলেট নগরীর আখালিয়ায় মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. নজরুল ইসলামের চেম্বারে নূরীকে নিয়ে আসেন তার বড়বোন মরিয়ম আক্তার। ডা. নজরুল ইসলাম সিটিস্ক্যানসহ কয়েকটি টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন। রিকাবীবাজারের ইবনে সিনা ডায়গনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করানোর পর ওই রাতেই সিটিস্ক্যানের ফিল্ম হাতে পান নূরীর পরিবার। ডায়গনস্টিক সেন্টারের দায়িত্বরত একজন জানান, নূরী মাইনর স্ট্রোক করেছেন। এ কথা শুনে রাত সাড়ে ১০টায় ফিল্মটি নিয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান নূরীর বোন। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকও মাইনর স্ট্রোকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

পরদিন বিকেলে ডা. নজরুল ইসলামের পরামর্শেই নগরীর তালতলাস্থ পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় নূরীকে। হাসপাতালের ৩য় তলার ৩১৪ নম্বর কেবিনে ঠাঁই হয় নূরীর। ১৫ অক্টোবর নূরীর রক্তনালীর এমআরআই টেস্ট করানোর জন্য বলেন ডা. নজরুল। এমআরআই টেস্টের রিপোর্ট আসে ১৭ অক্টোবর। সেটা পরীক্ষা করে ডা. নজরুল জানান নূরীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে। নূরীর স্বজনদের মতে, নূরী সুস্থই ছিলেন, শুধু মাঝেমধ্যে মাথাব্যথা হতো।

১৮ অক্টোবর ভোরবেলা থেকে হঠাৎ আবার মাথাব্যাথা শুরু হয় নূরীর। শরীরের একটি অংশ অবশ হতে শুরু করে। দুপুর দেড়টায় ডা. নজরুল ইসলাম নূরীকে এসে দেখে যান। স্বজনদের জানান, চিন্তার কিছু নেই। তবে তিনি তৃতীয় মতামতের জন্য নিউরো সার্জন কল দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলেন। বেলা সাড়ে ৩টায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয় নূরীর। সাথে সাথেই বিষয়টি কর্তব্যরত নার্সকে জানালে তারা নূরীর স্বজনদের জানান, ডাক্তার ফোন ধরছেন না। ৩য় তলা থেকে নার্সরা ইন্টারকমে বারবার কল দেন ৮ম তলায় থাকা ডিউটি ডাক্তারদের কক্ষে। কিন্তু মেডিসিন বিভাগের কর্তব্যরত ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডাক্তার মৌসুমী দেব রায় (মৌটুসী মৌ) তখন ৫ম তলায় অন্য রোগী দেখছিলেন। তার সাথে ছিলেন পার্কভিউ মেডিকেলের ছাত্র ও ইন্টার্ন চিকিৎসক নিদুল রায়ও। দুপুর ২টা থেকে ইভিনিং শিফটে মেডিসিন বিভাগে ডাক্তার মৌসুমী দেব রায়ের ডিউটি থাকলেও তিনি একবারের জন্যও তৃতীয় তলায় আসেননি। অথচ মর্নিং শিফটের ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. তুর্ণা ও ডা. সুনান্তু ওইদিন বিকেল ৪টা পর্যন্ত ৮ তলায় মেডিসিন বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসকের কক্ষে ছিলেন বলে হাসপাতালের একটি সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে, ইন্টারকমে ডাক্তার মৌসুমীকে না পেয়ে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে অথবা তার সাথে থাকা হাসপাতালের বিভাগীয় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার কথা থাকলেও, ৩য় তলার দায়িত্বরত নার্স রুপালী আক্তার ও তুলি পাল তা করেননি। রোগীর স্বজনদের বার বার তারা বলছিলেন, বিষয়টি দেখছি, ডাক্তারকে কল দিচ্ছি, তিনি ধরছেন না। অথচ রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাওয়া স্বত্বেও ওই দুই নার্স বিষয়টি ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। বারবার নূরীর বোন মরিয়ম ও তার মা আমেনা বেগম ডিউটিরত নার্সদের বলেন ডাক্তারকে ডাকার জন্য। কিন্তু কোনো ডাক্তার আসেননি। বিকেল সাড়ে ৫টায় ইন্টার্নি চিকিৎসক নিদুল রায়ের মাধ্যমে নূরীর খবর পান ডাক্তার মৌসুমী। কিন্তু, তিনি নূরীর কেবিনে আসেন আরো ঘন্টা দেড়েক পর সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে।

রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, ডাক্তার আসার মিনিট দশেক আগে শ্বাসকষ্ট নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নূরী বেগম। বিষয়টি আড়াল করতে ডাক্তার মৌসুমী এসেই তড়িঘড়ি করে নূরীর মরদেহ আইসিইউতে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগী হন। এতে বাধা দেন নূরীর মা আমেনা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েটা তো মরেই গেছে, তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে, এখন আমার মেয়ের লাশ কেন আইসিইউতে নিয়ে যাচ্ছ?’ তখন ডাক্তার মৌসুমী জানান, ‘নূরী এখনো বেঁচে আছে, তাকে আইসিইউতে নিতে হবে।’

তখন নূরীকে নেওয়া হয় ৭ তলায় আইসিইউতে। মিনিট দশেক পর ডাক্তার মৌসুমী আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এসে জানান, ‘নূরী আর নেই।’ রাত ৮টায় শিফট শেষ হওয়ায় বাসায় চলে যান ডাক্তার মৌসুমী দেব রায়। এদিকে নূরীর মৃত্যুর খবর পেয়ে শুরু হয় স্বজনদের আর্তনাদ ও হট্টগোল। রাত ৯টা পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করেননি। হাসপাতালের ইভিনিং শিফটে দায়িত্বরত উপ-পরিচালক ডা. তন্ময় ভট্টাচার্য নিজ কেবিনে বসে সবকিছু দেখছিলেন। কিন্তু একবারের জন্যও বেরিয়ে এসে নূরীর স্বজনদের সাথে কথা বলেননি। পরে সেখানে সাংবাদিকরা উপস্থিত হলে বেকায়দায় পড়ে যান ডা. তন্ময় ভট্টাচার্য। রাত ১০টায় তিনি কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে রোগীর স্বজনদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চান এবং স্বীকার করেন, ডাক্তারের গাফিলতির কারণেই ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

নূরীর বোন মরিয়ম বেগম জানান, বারবার বলার পরেও কোনো ডাক্তার আসেন নি। অক্সিজেন পাইনি। আমরা অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। আমার বোনটি অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছে। সময়মতো চিকিৎসা পেলে হয়তো আমার বোনটি অকালে মারা যেতো না। আমরা তো ফ্রি চিকিৎসা নিতে আসিনি। আমরা টাকা দিয়েই ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু সময়মতো একজন ডাক্তারও পেলাম না।

নূরীর খালাতো ভাই জাকির হোসেন জানান, ডিউটি ডাক্তার মৌসুমী দেব রায়ের গাফিলতির কারণেই আমার বোনের মৃত্যু হয়েছে। যদি এভাবে বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা যায় তাহলে চিকিৎসক এবং হাসপাতালের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাবে সাধারণ মানুষের। রোগী সন্ধ্যায় মারা গেলেও রাত ১০টা পর্যন্ত কেউ কোনো খবরই নেননি।

এ ব্যাপারে বক্তব্যের জন্য অভিযুক্ত ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. মৌসুমী দেব রায়ের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. নজরুল ইসলাম জানান, বিষয়টি অনাকাঙ্খিত ও অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। ইতিমধ্যে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৭২ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা। ওই সময়ের কর্তব্যরত চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। আমি চাই তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটিত হোক। নিরীহ কেউ যেন এ অনাকাঙ্খিষত ঘটনার শিকার না হয়।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

October 2020
S S M T W T F
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  

সর্বশেষ খবর

………………………..