সুনামগঞ্জে সরকারের দেয়া গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ কাজে ধীরগতি

প্রকাশিত: ১১:২৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৪, ২০১৯

সুনামগঞ্জে সরকারের দেয়া গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ কাজে ধীরগতি

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ‘যার জমি আছে ঘর নেই, তাঁর নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ উপ-খাতের আওতায় ২৩টি গৃহ নির্মাণ ব্যয় নির্বাহের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুকূলে ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু গৃহ নির্মাণ বরাদ্দের টাকা থাকা সত্তে¡ ও বিগত প্রায় ৫ মাস যাবত ঘরের খুঁটি স্থাপনের পর আর কোনো কাজের অগ্রগতি নেই বলে জানান সুবিধাভোগীরা।

গতকাল সরেজমিনে উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের একাধিক সুবিধা বঞ্চিতরা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের যে ঘর তৈরী করে দেয়ার জন্য যে টাকা  বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, কিন্ত তা এখনও বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। আমাদের ভিটের উপর ঘরের কয়েকটি খুঁটি স্থাপন করা হলেও গত প্রায় ৫ মাস ধরে ঘরের কাজ সম্পন্ন হচ্ছেনা। এই খুঁটিগুলো ও তৈরি করা হয়েছে খুবই নি¤œমানের বালু, পাথর ও ডেমেজ সিমেন্ট দিয়ে। খুঁটি স্থাপনের সময় ভেঙে যায় কয়েকটি খুঁটি।

তাঁরা জানান, ঘর নির্মাণের কিছু কিছু মালামাল আমাদের আনতে হয়েছে নিজ খরচে। খুঁটি স্থাপনের পর ঘরের চারিদিকে ১ ফুট বা দেড় ফুট উঁচু করে যে দেয়াল দেয়া হয়েছে। তা নি¤œমানের কাজ হওয়ায় এই দেওয়াল ও ভেঙে পড়েছে বিভিন্ন ঘরের। টিনের ছাউনি ও ভেড়া দেয়া হয়েছে ছোট আকারের সাধারণ কাঠ দিয়ে। ঘরে দেয়া ভেড়ার কাঠ এখনই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ছাউনি দিয়ে বৃষ্টির পানি ঝরছে। ঘরের চারিদিকে ভিটের মাটি দেয়াল ভেঙে ঢলে পড়ছে।

সুবিধাভোগীরা আরও জানান, স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আব্দুল মোতাল্লিব ঘর নির্মাণ কাজ দেখভাল করছেন। উপজেলা থেকে এ পর্যন্ত কোনো অফিসার এসে ঘর নির্মাণ কাজের খোঁজ-খবর নেননি। ঘর নির্মাণের মালামাল আনয়ন বাবদ খরচ ও আমরা দিচ্ছি। ঘরের কাজ করতে আসা ৩-৪ জন কামলার দুই বেলা খাবার ও নাস্তা দিচ্ছি। একদিন কাজ করলে ১০-১২ দিন পর আবার এসে কাজে ধরেন কামলাগণ।

এ সময় মঙ্গলকাটা গ্রামের দরিদ্র রতন মিয়ার বৃদ্ধ মা রাবেয়া খাতুন (৮০) বলেন,‘আমার ছেলের নামে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন। ঘরের পিলার ও স্থাপন করা হয়েছে। এরপর কয়েক মাস ধরে কামলাদের কোনো খোঁজ-খবর নেই। আমি পরিবার নিয়ে অন্যের ঘরে বসবাস করছি। বর্ষাকালীন দিনে খুবই সমস্যায় আছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘরে প্রবেশ করে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করতে চাই। আমি ড. সাদিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই।’ রতন মিয়ার ঝুপড়ি ঘর ভেঙে নতুন ঘর তৈরিতে দেরি হওয়ায় পরিবার নিয়ে অন্যের ঘরে বসবাস করছেন মা রাবেয়া খাতুন। ঘর নির্মাণের ইট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় ভিটের আশপাশে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পাশের বাড়ির সালমা বেগম ও মোবারক মিয়া।

একই গ্রামের পঙ্গু আব্দুল মজিদ বলেন,‘আমি সামান্য কাজ করতে পারি। আমার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন ও ঝিয়ের কাজ করেন। ঘর বরাদ্দ পেয়ে মালামালের জন্য ছয় মাস ধরে ঘুরছি। কিছু মালামাল ও পেয়েছি। এই মালামাল আনতে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৬শত টাকা। সংসারে স্ত্রী ছেলে মেয়েসহ ৮ জন। আমার ঘরের চারিদিকে ভিটের মাটি আটকাতে দেওয়ালের যে কাজ হয়েছে, তা ভেঙে পড়েছে। অনেক বালু, পাথর ও সিমেন্ট কিনে এনেছি। আমাকে যে সিমেন্ট দিয়েছে, বস্তায় শুধু পাথর আর পাথর। কথা বলার সময় উপস্থিত ছিলেন খুর্শিদ মিয়া, হাশিম মিয়া, মুখলেছ মিয়া, দিলু মিয়া, লিটন মিয়াসহ অনেকে।

মঙ্গলকাটা গ্রামের সালেহা বেগম (৬০)। স্বামী মৃত মোস্তফা মিয়া। তিনি ঝিয়ের কাজ করেন। দুই মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি বলেন,‘আমার ঘরের কাজ ৫ মাস ধরে চলছে। একদিন আসলে ১০দিন আসে না কামলা। যেদিন আসে ৪ জনকে আমি দুই বেলা ভাত ও নাস্তা দেই। তবুও আমার ঘরের কাজ শেষ হয়নি। কাজ ও ভাল হয়নি। এখনই ভিটের দেয়াল ভেঙে যাচ্ছে। মাটি যাচ্ছে সরে। ঘরের কাজ খুবই নি¤œমানের। তিনি বলেন,‘ঘর নির্মাণের মালামাল আনতে খরচ হয়েছে আমার ৪ হাজার টাকা। আমার ঘরের মালামাল আবার কামলাগণ নিয়ে ও গেছে অনেকটা।’

খাগেরগাঁও গ্রামের রশিদ ভুইয়া বলেন,‘ঘর নির্মাণের মালামাল আনতে আমার খরচ হয়েছে ১ হাজার ৮ শত টাকা। ৭৫০ টাকা ১ গাড়ি বালু কিনেছি। ৩ শত ইট কিনেছি। ২ বস্তা সিমেন্ট ও কিনেছি। তারা যে ৮ বস্তা সিমেন্ট দিয়েছে, বস্তায় সবই পাথর। নি¤œমানের কাজ হওয়ায় ঘরের ৪টি খুঁটি ভেঙে গেছে। তারপর ও পিলার স্থাপন ছাড়া কোনো কাজ হয়নি আমার ঘরের।’

একই গ্রামের আংগুর মিয়ার ঘরের ও খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। ভিটের মাটি আটকাতে দেড় ফুট উঁচু করে যে দেওয়াল দেয়া হয়েছে, তা এখনই ভেঙে পড়ছে। এ সময় আংগুর মিয়ার স্ত্রী বলেন,‘এই যে খুঁটি স্থাপন করে প্রায় ৪ মাস আগে কামলারা গেল। আর কোনো দিন আসেনি। সংশ্লিষ্ট কোনো অফিসার ও আসেনি ঘর নির্মাণের খবর নিতে।’

এ বিষয়ে সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. মানিক মিয়া জানান,‘২০১৮-১৯ অর্থ বছরে সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে ২৩টি গৃহ নির্মাণের বরাদ্দ এসেছে। প্রতিটি গৃহের সাথে টয়লেট ও নির্মাণ করে দেয়া হবে। গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে জাহাঙ্গীনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে গৃহ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী আগষ্ট মাসের মধ্যে গৃহ নির্মাণ কাজ শেষ হবে। প্রতিটি গৃহ নির্মাণের জন্য ১ লাখ টাকা করে ব্যয় হচ্ছে।’তিনি আরও জানান,‘প্রতিটি ঘরের দৈর্ঘ্য হবে ১৬ ফুট থেকে ১৪ ফুট, প্রস্ত হবে ১০ ফুট। বারান্দা হবে ৪ ফুট। ঘরের চতুর্দিকে সুবিধামত উচ্চতা দিয়ে ইটের পাকা দেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনমত ইট, বালু ও পাথর দেয়া হচ্ছে। সেই সাথে ৮ বস্তা করে সিমেন্ট দেয়া হয়েছে। এসব মালামাল বহন করে স্বস্ব স্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ঘরের জন্য প্রায় ৮ হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে। এসব খরচ ১ লাখ টাকার ভেতরে।’

আশ্রায়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে সদর উপজেলার কুরবাননগর ইউনিয়নে ৫টি, সুরমা ইউনিয়নে ১টি, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নে ১৭টি গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে। কুরবাননগর ইউনিয়নের গোদারগাঁও গ্রামের বচন রবিদাস, ময়না রবিদাস, গুরুচরণ রবিদাস, নানকি রবিদাস, কাহারাম রবিদাসের নামে ঘর বরাদ্দ এসেছে। সুরমা ইউনিয়নের ঢালাগাঁও গ্রামের মোছা. পারভীন আক্তারের নামে ও ঘর বরাদ্দ এসেছে। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের খাগেরগাঁও গ্রামের রশিদ ভুইয়া, আব্দুর রশিদ, আব্দুর মিয়ার নামে ঘর বরাদ্দ হয়েছে। মঙ্গলকাটা গ্রামের হেলেনা বেগম, মোছা. রাজিয়া খাতুন, মোছা. সালেহা বেগম, মোছা. মমতাজ বেগম, মো. আব্দুল মজিদ, মো. আব্দুল মতিন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. রতন মিয়া, মোছা. কুলসুম আক্তার ও ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর গ্রামের মসু মিয়া, আছিয়া খাতুন, পুরাতন গোদীগাঁও গ্রামের গোলাপ মিয়া, ধলাইপাড় গ্রামের মোজাম্মেল হক, নুরুজপুর গ্রামের মো. আব্দুল কাদির এই ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন।

জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন আ.লীগ নেতা শাহ নুর বলেন,‘যার জমি আছে ঘর নেই’এই আশ্রায়ণ প্রকল্পের আওতায় আমাদের ইউনিয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাদেরকে ঘর বরাদ্দ দিয়েছেন এসব ঘর নির্মাণে যেন বিলম্ব না হয় এবং ঘর নির্মাণ কাজে যেন দুর্নীতি না হয়। সকল ঘর নির্মাণ কাজ ও যেন দ্রæততার সাথে শেষ হয়। পুরাতন ঘর ভেঙে নতুন ঘর নির্মাণ দেরি হওয়ায় এই বর্ষা মওসুমে মানুষ মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।’

সুনামগঞ্জ উত্তর সুরমা উন্নয়ন পরিষদের আহŸায়ক মো. আব্দুর রব বলেন,‘আমাদের সুনামগঞ্জের কৃতি সন্তান ড. মোহাম্মদ সাদিক মহোদয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাদ্দের ঘর আমাদের সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চলতি অর্থ বছরে বরাদ্দকৃত ২৩টি ঘরের কাজ শেষ হচ্ছে না। এসব ঘর নির্মাণ শেষ না হওয়ায় দরিদ্র পরিবারের ভোগান্তি বেড়ে চলেছে। কাজের মান ও নি¤œমানের। এসব ঘরের কাজ টেকসই এবং দ্রæততার সাথে শেষ করার দাবি জানাই।’

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসমিন নাহার রুমা বলেন,‘গৃহ নির্মাণে কোনো অনিয়ম বা গাফিলতি অবশ্য মানা হবে না।বন্যার জন্য কাজ হয়নি। মালামাল নিয়ে রাখা হয়েছে। আগামী মাসের মধ্যে কাজ শেষ হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক স্যার এসব কাজের খোঁজ-খবর রাখছেন।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..