পুকুর সংকট সাঁতার শিখতে পারছে না নগরীর শিশু-কিশোরেরা

প্রকাশিত: ৫:৫৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৮

পুকুর সংকট  সাঁতার শিখতে পারছে না নগরীর শিশু-কিশোরেরা

Manual4 Ad Code
আহমাদ সেলিম :: সিলেট নগরীর মাছুদীঘির পাড় এলাকায় স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় সত্তরটি পরিবারের বসবাস। এক সময় এলাকায় মাছুদীঘি নামে যে দীঘিটির অনুপম উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন- সিলেটের মানুষ-সেটি ছিলো নগরের বড় কয়েকটি দীঘির অন্যতম একটি। এলাকাবাসীর মতে, দেড় যুগ আগেও মাছুদীঘিরপার ছাড়াও আশপাশ এলাকার বাসিন্দারা সেই দীঘিতে গোসল করতেন। দীঘির কল্যাণে তখন এলাকার প্রতিটি ঘরের শিশু-কিশোর, তরুণ তরুণীরা সাঁতার শিক্ষায় রপ্ত ছিলো। এখনো সেই পরিবারগুলো আছে। হয়তো আগের চেয়ে জনসংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। কিন্তু, মানুষ বাড়লেও বাড়েনি সাঁতার শেখার সংখ্যা। এর অন্যতম কারণ সময়ের সাথে বদলে গেছে দীঘিটিও। বর্তমানে দীঘির দুই তৃতীয়াংশ ভরে গেছে জঞ্জালে। আর সেই পুকুর না থাকায় এলাকার নতুন প্রজন্মের একটি শিশুও সাঁতার শিখতে পারেনি। শুধু মাছুদীঘি নয়, কুয়ারপার, বিলপাড়, সাগরদিঘীরপাড়, লামাবাজার, দাড়িয়াপাড়া, চারাদিঘী, বর্তমানে যেখানে নির্ভানা ইন হোটেল দাঁড়িয়ে আছে এর পেছনের পুকুরসহ নগরীর অধিকাংশ এলাকায় পুকুর দীঘি ভরাট হয়ে যাওয়ায় সাঁতার বিদ্যা থেকে দূরে রয়েছে শিশু-কিশোররা। ফলে, শিশু বয়সে অথবা বড় হয়ে পানিতে ডুবে অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে।

ওসমানী হাসপাতালের বিশিষ্ট চিকিৎসক শিব্বির আহমদ জানান, সাঁতার একটি অন্যতম শরীরচর্চাও। যেসব শিশুরা নিয়মিত সাঁতার কাটে না, ঘরে বসে বসে ঘাড় গুঁজে পড়া-শোনা করে, কম্পিউটার আর মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকে-সেসব শিশু দিন দিন মোটা (স্থ’ূল) হয়ে যাচ্ছে। আর শিশুরা মোটা হলে শরীরে রোগ বাসা বাঁধে। মোটা হয়ে যাওয়ার কারণে অল্প বয়সী শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে নানা জটিল রোগে।

মাছুদীঘির পাড় এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা চল্লিশোর্ধ্ব জাফর খান বলেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনে এক সময় বিশাল যে দীঘি ছিলো-সেখানে আমি সাতাঁর শিখেছি। এখন সেই দীঘির দুই তৃতীয়াংশ ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমানে সাঁতার শিখার জন্য সেটি উপযুক্ত নয়। ফলে আমার তিন সন্তানসহ আমাদের বাড়িতে থাকা অন্তত দশ থেকে পনেরটি শিশু সাঁতার শিখতে পারেনি। এ নিয়ে দু:শ্চিন্তায় আছি। তবে, সিটি কর্পোরেশন ইচ্ছে করলে মাছুদীঘিকে সাঁতার শেখানোর জন্য উপযোগী করে তুলতে পারে।’

পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তানের আশরাফুল কবীর বলেন, শিশু অবস্থায় সাঁতার শেখা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু, সিলেট নগরীতে সাঁতার উপযোগী পুকুর না থাকায় শিশু-কিশোররা সাঁতার শিখতে পারছে না। ফলে শিশু বয়সে অথবা বড় হয়ে পানিতে ডুবে-অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। অথচ দশ থেকে পনের বছর আগেও সিলেট নগরীর প্রতিটি বাড়ির প্রাঙ্গণে অথবা পেছনে থাকতো পুকুর। সেই পুকুরগুলো সংসারের যাবতীয় কাজের পাশাপাশি সাঁতার শিখার পেছনে রেখেছে বিশেষ ভূমিকা। পুকুর থাকার কল্যাণে তখন প্রত্যেক বাড়ির ছেলে-মেয়ের রপ্ত ছিলো সাঁতার শিক্ষায়। যে কারণে তখন পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা খুব একটা শোনা যেতো না। কিন্তু বর্তমানে এক কোটি মানুষের নগরীতে ৫০টি পুকুর খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। আর পুকুর না থাকায় শিশুরা সাঁতার শিখতে পারছে না। ফলে শিশুরা কোথাও বেড়াতে গেলে তাদেরকে পানিতে ডুবে যাবার মৃত্যুভয় সব সময় তাড়া করে। লামাবাজার এলাকার বাসিন্দা কমলজিৎ শাওন বলেন, প্রায় পনের বছর আগেও মির্জাজাঙ্গালস্থ নিম্বার্ক আশ্রমের পেছনে একটি এবং তার ডান পাশে আরেকটি পুকুর ছিলো। তার মধ্যে একটি ভরাট করে তোলা হয়েছে দালান এবং অন্যটিও দালান তোলার অপেক্ষায়। ফলে বর্তমানে এই বৃহৎ এলাকার অধিকাংশ শিশু সাঁতার শিখতে পারছে না। শিক্ষার পাশাপাশি শিশু বয়সে প্রত্যেক শিশুকে সাঁতার শেখার জন্য মনোযোগী করে তোলা জরুরি। শিশু বেলায় সাঁতার শিখালে ভবিষ্যতে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় না। অপরদিকে, শিশু-কিশোরদের সাঁতার শিখার জন্য পুকুরের মতো সিলেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে সুইমিংপুলেরও সংকট রয়েছে। নগরীতে প্রায় পঞ্চাশটির মতো আবাসিক হোটেল থাকলেও কয়েকটি অভিজাত হোটেল ছাড়া সুইমিংপুলও নেই সবখানে। হাতেগোনা যে কয়টিতে আছে,সেগুলোতে গিয়ে সন্তানদের সাঁতার শিখানোর সময় নেই অভিভাবকদের।

তাছাড়া, সাঁতার শিখা প্রত্যেক শিশুর জন্য জরুরি হলেও নগরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকেও এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। যদিও এক সময় প্রতিটি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন ইভেন্টের সাথে সাঁতারও থাকতো নিয়মিত। পুকুর না থাকায় সেই প্রতিযোগিতাও বন্ধ হয়ে গেছে।

Manual2 Ad Code

পুলিশ লাইন স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহ আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের অনেকেই সাঁতার জানে না। তাছাড়া, সাঁতার শিখার মতো উপযুক্ত পুকুরও সিলেটে নেই। ফলে স্কুলগুলো থেকে সাঁতার প্রতিয়োগিতার আগ্রহটাও হারিয়ে যাচ্ছে। এতে ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশুরা।

Manual6 Ad Code

টিকরপাড়া এলাকার আমিনুল ইসলাম নামের আরেক অভিভাবক বলেন, নগর জীবনে পরিবারের সদস্যদের নানা ব্যস্ততায় শিশুরা সাঁতার শিখতে পারছে না। সিলেট শিশুবান্ধব নগরী হলেও সাঁতার শিখার বিষয়ে কোনো ধরনের ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়া হয়নি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে। তবে, ইচ্ছে করলে এখনো করা সম্ভব। চার বছর বয়স থেকে শিশুকে সাঁতার শেখানোর উপযুক্ত সময়। অথচ সিলেটে সাঁতার শিখার পরিবেশ না থাকায় অধিকাংশ শিশুরাই সাঁতার জানে না। যে কারণে এ অঞ্চলের মায়েদের দুশ্চিন্তাও বেশি। অন্যদিকে নগর জীবনে পরিবারের সদস্যদের নানা ব্যস্ততায় শিশুরা সাঁতার শিখতে পারছে না। ফলে বড় হয়ে পানিতে ডুবে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। এ প্রসঙ্গে কথা হলে ওসমানী হাসপাতালের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ এ এস এম জুয়েল জানান, সিলেট নদী হাওর-বাওড় আর জলাশয়ের অঞ্চল। এখানে প্রত্যেক শিশুর সাঁতার শিখা জরুরি। নগরীতে পুকুর না থাকায় নিজের সন্তানকেও নগরীর একটি হোটেলের সুইমিংপুলে সাঁতার শিখিয়েছেন তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাঁতার না শিখার কারণে প্রায় সময় পানিতে ডুবে শিশু-কিশোর মারা যাবার ঘটনা ঘটছে। জীবনের নিরাপত্তার জন্য যেমন সাঁতারের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি সাঁতার জানা থাকলে শরীরও সুস্থ থাকে।

মিরাবাজার এলাকার রাহেনা আক্তার নামের এক অভিভাবক বলেন, আমার দুটি সন্তানই সাঁতার জানে না। এলাকায় যে কটি পুকুর ছিলো সবগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় আমার মতো অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের সাঁতার শিখাতে পারছে না। এই অবস্থায় তাদেরকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যেতে ভয় হয়। একইভাবে নিজের শিশু সন্তানদের নিয়ে দু:শ্চিন্তার কথা বললেন কাজিটুলা এলাকার অভিভাবক মণিকা। তিনি বলেন, আমার এলাকায় পুকুর থাকলেও সেটি সাঁতার শিখার জন্য উপযোগী নয়।

Manual3 Ad Code

এদিকে, নগরীর ভেতর সাঁতার শেখার উপযোগী পুকুর সংকট থাকায় কয়েকটি অভিজাত আবাসিক হোটেল বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের হোটেলে আছে সাঁতার শেখানোর জন্য সুইমিংপুল। তার মধ্যে একটি মির্জাজাঙ্গাল এলাকার হোটেল নির্ভানা ইন। ২০১৩ সালের দিকে সেখানে শিশুদের সাঁতার শিখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। তারপর পুকুরবিহীন নগরে তাদের সেই উদ্যোগ বেশ সাড়া ফেলে সচেতন মহলে। হোটেলের কর্ণধার তাহমিন আহমদ জানান, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মাত্র আড়াই হাজার টাকায় আমাদের এখানে সাঁতার শিখানো হয়। তাঁর দেয়া তথ্য মতে, ইতিমধ্যে প্রায় ১০ হাজার শিশু তাদের কাছে এসে সাঁতার শিখেছে। একইভাবে সাঁতার শিখানোর ব্যবস্থা রেখেছে আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্স ও কমপ্লেক্সের পাশের গার্ডেন ক্লাবে।

ব্লু-বার্ড স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাসেল, পুলিশ লাইন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী ফারহানাসহ সাঁতার না শিখা একাধিক শিক্ষার্থী জানায়, সাঁতার না জানায়-তারা পানিতে নামতে ভয় পায়। কোথাও বেড়াতে গেলে প্রাণ খুলে আনন্দ করতে পারে না। সব সময় মনের মধ্যে ভীতি কাজ করে বলে জানায় এসব শিক্ষার্থী।

সূত্র- দৈনিক সিলেটের ডাক

Manual8 Ad Code

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

September 2018
S S M T W T F
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  

সর্বশেষ খবর

………………………..