আজ সেই ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস

প্রকাশিত: ৩:২৬ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২৫, ২০১৮

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক :: গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আজ এক মিনিটের জন্য প্রতীকী অন্ধকারে ঢেকে যাবে গোটা দেশ। রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত্ম জরম্নরি স্থাপনা ছাড়া সবখানেই এই প্রতীকী অন্ধকার (বস্ন্যাক আউট) কর্মসূচি পালন করা হবে
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্ত্মানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরম্নল হক হল), এস এম হল ও জগন্নাথ হলে ঢুকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের। ইকবাল হলের ক্যান্টিনের সামনে বেশ কয়েকটি মরদেহ এভাবে পড়ে ছিল ২৭ মার্চ পর্যন্ত্ম -ছবি সংগৃহীতএকাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিভীষিকা ছড়িয়ে দিয়ে দিকে দিকে ছুটে যায় সাঁজোয়া গাড়ির বহর। হননতৃষ্ণা নিয়ে জলপাই রঙের ট্যাংক নেমে আসে ঢাকার রাজপথে। রাতের স্ত্মব্ধতা গুঁড়িয়ে গর্জে ওঠে বন্দুক, কামান আর ট্যাংক। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে রাতের বাতাস। ইতিহাসের পাতায় রচিত হয় কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত্ম মানুষকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনায় স্ত্মম্ভিত হয় বিশ্ববিবেক। বাঙালি জাতির ইতিহাসে রচিত হয় এক নৃশংস, ভয়ংকর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। আজ গণহত্যা দিবস।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পূর্তির প্রাক্কালে জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে পঁচিশে মার্চের সেই কালরাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার অগণিত শহীদকে। গণহত্যা দিবস হিসেবে এক মিনিটের জন্য প্রতীকী অন্ধকারে ঢেকে যাবে গোটা দেশ। রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত্ম জরম্নরি স্থাপনা ছাড়া সবখানেই এই প্রতীকী অন্ধকার (বস্ন্যাক আউট) কর্মসূচি পালন করবে। এছাড়াও রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কালরাত’ স্মরণে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দিনভর থাকছে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও রাতে মোমবাতি প্রজ্বলন। গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র বা প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী করা হবে।

একাত্তরের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানম-িস্থ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল ঘোষণা করেন। ঠিক একই সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। এর কয়েক ঘণ্টার পর রাত সাড়ে ১১টায় ট্যাংক এবং সৈন্যভর্তি ট্রাকগুলো ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে।
রাত ১টা থেকে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরম্নর উদ্দেশ্যে ঢাকার কেন্দ্রের দিকে এগোতে থাকে। তবে হানাদার বাহিনী ফার্মগেটের সামনে এলেই পিকেটারদের বাধার মুখে পড়ে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ে অপারেশন শুরম্নর অপেক্ষা না করে হিংস্র হানাদাররা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরম্ন করে। অপারেশন শুরম্নর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই কর্নেল জেড এ খান ও মেজর বিলস্নাল স্বাধীনতার স্থপতি, অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসা থেকে তুলে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে আসে।
গ্রেপ্তারের আগ মূহূর্তে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোপন ওয়ারলেস বার্তায় তিনি বলেন, ‘পাকিস্ত্মানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআর শত্রম্নর বিরম্নদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম শুরম্ন হয়েছে। আমি ঘোষণা করছি- আজ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। সর্বস্ত্মরের নাগরিকদের আমি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন, যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার বাহিনীর বিরম্নদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত্ম প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সম্মিলিতভাবে শত্রম্নর মোকাবিলা করম্নন। এই হয়তো আপনাদের প্রতি আমার শেষ বাণী হতে পারে। আপনারা শেষ শত্রম্নটি দেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত্ম সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যান।’
এদিকে পিলখানায় ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী ওয়ারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এই বার্তা গ্রহণ করে। ওই সময় চট্টগ্রাম অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন।
এদিকে রাত ১টা বাজার সাথে সাথে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টারে গার্ডে ১৮ জন বাঙালি জওয়ান থাকলেও তারা পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পায়নি। পিলখানার সাথে সাথে রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারীবাজারসহ সমগ্র ঢাকাতেই শুরম্ন হয় প্রচ- আক্রমণ। রাজারবাগে পুলিশের বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই। তবে ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের মুখে এ প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো সদর দপ্তর। বিভিন্ন এলাকায় যথেচ্ছ হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে চলে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। পাকিস্ত্মানি বর্বর সেনারা বাংলাদেশকে সশস্ত্র উপায়ে স্বাধীন করার উদ্যোক্তা কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরম্নল হক হল) এবং জগন্নাথ হলে হত্যা করা হয় কয়েকশ নিরীহ ছাত্রকে এবং বড় বড় গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয় ওইসব লাশ। ওই কালরাতেই হত্যা করা হয় ক্ষণজন্মা আন্ত্মর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরদা, ড. ফজলুর রহমান খান, অধ্যাপক এম মনিরম্নজ্জামান, অধ্যাপক এম এ মুক্তাদির, অধ্যাপক এম আর খাদেম, ড. মোহাম্মদ সাদেক প্রমুখ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে। রোকেয়া হলের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হলো ক্যান্টনমেন্টে। সারা শহরে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করে পাষা- বাহিনী। রিকশাওয়ালা, ভিখারি, শিশু, ফুটপাতবাসী কেউই তাদের ভয়াল থাবা থেকে রেহাই পায়নি। বস্ত্মির পর বস্ত্মি জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং প্রাণভয়ে পলায়নপর আবালবৃদ্ধবনিতাকে ব্রাশফায়ার করে পাখির মতো হত্যা করা হয়। ভস্মীভূত করা হয় দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক গণবাংলা এবং দৈনিক পিপলের দপ্তর। মিরপুর, মোহাম্মদপুরের বিহারিরা নিজেদের বাঙালি প্রতিবেশীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হিংস্র উলস্নাসে। রাতারাতি ঢাকা পরিণত হলো মৃত মানুষের শহরে। ২৬ মার্চের সূর্য উঠলে দেখা গেল ঢাকা শহরজুড়ে নিরীহ মানুষের লাশ ও ভস্মীভূত ঘরবাড়ি।
১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামের এক হত্যাকা- স্ত্মম্ভিত করে দিয়েছিল গোটা পৃথিবীকে। ২৫ মার্চ ‘৭১-এর রাতে বাংলাদেশজুড়ে সংঘটিত হয় তার চেয়েও শতগুণ নৃশংসতা। ৯ মাস ধরে চলে বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে মাইলাইয়ের বিভীষিকা। ওইদিনই শুরম্ন হয় বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য মুক্তির লড়াই মুক্তিযুদ্ধ।
বিভিন্ন কর্মসূচি
২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধু আন্ত্মর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আলোচনা সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এবং সংগঠনের সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া সারাদেশে জেলা, মহানগর, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মীসহ দলের সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনসহ সর্বস্ত্মরের জনসাধারণকে দিবসটির যথাযথ মর্যাদা অনুযায়ী সভা, সমাবেশ,র্ যালি, আলোকচিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাক-হানাদার বাহিনীর আক্রমণে নিহত শহীদদের স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হল পরিবার আজ সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত্ম হল প্রাঙ্গণে আয়োজন করেছে নানা অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে সন্ধ্যায় শহীদদের স্মরণে স্থাপনাশিল্পের প্রদর্শন, জাগরণের গান, দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা আবৃত্তি। মধ্যরাতে গণসমাধিতে মোমবাতি প্রজ্বলন এবং শ্রদ্ধা নিবেদন।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

March 2018
S S M T W T F
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  

সর্বশেষ খবর

………………………..