চুল ঢেকে রাখলেই মেয়ে ভালো?

প্রকাশিত: ৮:৪১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৩, ২০১৭


Manual5 Ad Code

বাংলাদেশের এক মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম—দেশে বিশাল এক পরিবর্তন হয়েছে লক্ষ্য করছি। পরিবর্তনটা মেয়েদের শরীরেই বেশি। মেয়েরা শাড়ি পরুক, সালোয়ার কামিজ পরুক, জিন্স পরুক, স্কার্ট পরুক, মাথার চুল ঢেকে রাখছে। চুল কী দোষ করলো হঠাৎ? মেয়েটি উত্তর দিল—চুল ঢেকে রাখলে অথবা হিজাব পরলে মানুষ ভালো বলে। হিজাব না পরলে নানা রকম কুকথা শুনতে হয়। সে কারণেই মেয়েরা কুকথা থেকে বাঁচতে হিজাব পরে। হিজাবি মেয়েদের সকলে সম্মান করে।
চুল ঢেকে রাখলেই মেয়েটি ভালো, আর ঢেকে না রাখলে খারাপ—মেয়েদের চরিত্রের এমন সরলীকরণ ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে আমার জানা নেই। তবে এমন হওয়া বড় ভয়ঙ্কর। চুল শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটিকে হাওয়া বাতাস লাগতে না দেওয়া চুলের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

দেড় হাজার বছর আগে মেয়েদের চুল ঢেকে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সে সময় মরুভূমির ধুলোবালি আর লু-হাওয়া থেকে বাঁচতে নারী পুরুষ উভয়কে এমনিতেই চুল ঢেকে রাখতে হতো। আরবের পুরুষেরা মেয়েদের শরীরের যে অংশ দেখতে পেতো না, সে অংশ দেখলে স্বভাবতই যৌন আকর্ষণ অনুভব করতো। এ কারণেই পুরুষদের যেন যৌন আকর্ষণ না জাগে, মেয়েদের বলা হয়েছিল বুক চুল এসব ভালো করে ঢেকে রাখতে। বাংলাদেশ তপ্ত মরুভূমির দেশ নয়। এই জল-পাহাড়ের অঞ্চলে কারো হাত পা মুখ মাথা ঢেকে রাখার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে মেয়েরা স্বল্প বসনেই বাস করেছে। মেয়েদের চুল দেখে অভ্যস্ত পুরুষেরা। চুল দেখলে হুট করে তাদের যৌনতৃষ্ণা জাগে না। যদি জাগেও, এই তৃষ্ণা দমন করার পদ্ধতিও পুরুষেরা জানে। সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলতেই সবাই শেখে। আজ অবধি এ অঞ্চলে যত ধর্ষণ, যত যৌন হেনস্থা করেছে পুরুষেরা, তা মেয়েদের চুল দেখেছে বলে করেনি, করেছে মেয়েদের সহযাত্রী ভাবার শিক্ষা পায়নি বলে, অথবা মেয়েদের নিচুজাতের, নিচুমানের, কমবুদ্ধির, কমমেধার যৌনবস্তু ভাবতে শিখেছে বলে। যারা এই কুশিক্ষাটা পেয়েছে, তারা তাদের মাথা থেকে এই কুশিক্ষাটা ঝেড়ে ফেললেই কিন্তু যৌন হেনস্থা আর ধর্ষণের সমস্যাটা সমাজ থেকে উবে যায়। মেয়েদের সমান অধিকার চাই, মেয়েরাও মানুষ, মেয়েদের সম্মান করো—এই সব উপদেশবাণীর কোনও প্রয়োজনই পড়ে না।

আমি নিজে জানি হিজাব পরা মেয়েদের অনেকে অসৎ, লোভী, স্বার্থপর, কুটিল, হিংসুক, নিষ্ঠুর। আবার হিজাব না পরা মেয়েদের অনেকে সৎ, নির্লোভ, নিঃস্বার্থ, হৃদয়বতী, সরল, সংবেদনশীল। হিজাবের সঙ্গে চরিত্রের কোনও সম্পর্ক নেই। সততারও নেই। হিজাব একটি ধর্মীয় পোশাক, ছলে বলে কৌশলে পুরুষেরা এই পোশাকটিকে মেয়েদের ওপর চাপিয়েছে। পুরুষেরা হিজাব পছন্দ করলেও নিজেরা হিজাব পরে না। নামাজ রোজা করা ধর্ম বিশ্বাসী পুরুষও দিব্যি জিন্স শার্ট পরে চলাফেরা করে, প্রতিদিন আলখাল্লাও পরছে না, দাড়িও রাখছে না, মাথায় টুপিও পরছে না। মেয়েদের কিন্তু প্রতিদিন বোরখা বা হিজাব পরতে হচ্ছে। ধর্ম বিশ্বাস করলেই সেই বিশ্বাসকে শরীরে বয়ে বেড়াতে হয় না, মনে সেই বিশ্বাসটা থাকলেই হয়। মনের বিশ্বাস নিয়ে যাদের সংশয় আছে, তারাই শরীরে কিছু সাঁটে, অথবা নিশান নিয়ে হাঁটে।

Manual7 Ad Code

মেয়েরা যদি যৌন হেনস্থা থেকে বাঁচার জন্য হিজাব পরে, তাহলে এর সব দায় এবং কলঙ্ক পুরুষের। পুরুষ এমনই বর্বর, এমনই দানব যে, এক সমাজে বাস করেও এক প্রজাতির মানুষ হয়েও আরেক মানুষের প্রাপ্য স্বাধীনতাকে দুমড়ে মুচড়ে সর্বনাশ করে। পৃথিবীতে আর কোনও প্রজাতি নেই, যারা নিজের প্রজাতির ওপর এমন নৃশংস হামলা চালায়।

বাংলায় মুসলমান আগেও ছিল। ধর্মপ্রাণ নারী আগেও ছিল। আমি ষাট-সত্তর-আশির দশকের বাংলা দেখেছি। খুব অল্প কিছু বয়স্ক মহিলা ছাড়া কেউ বোরখা বা হিজাব পরতো না। মেয়েরা যে ধর্ম বিশ্বাস করে তার প্রমাণ হিসেবে চুল ঢাকতে হয়নি তাদের। চুল ঢাকার সংস্কৃতি বাংলায় ছিল না। কিন্তু তাই বলে আজকের মতো মেয়েরা এত ধর্ষণের শিকারও হতো না। দেশে বোরখা-হিজাবের সংখ্যা বাড়ছে, ধর্ষণের সংখ্যাও সমান তালে বাড়ছে। আগেই বলেছি, মেয়েদের চুলের সংগে যৌন হেনস্থার সম্পর্ক নেই। অন্তত বাংলায় নেই। আরব দেশে ছিল, এখনও হয়তো আছে। দেড় হাজার বছর আগের সেই চুল ঢাকার উপদেশ পৃথিবীর সব অঞ্চলের জন্য ছিল না, ছিল ধু-ধু মরু অঞ্চলের জন্য। এক এক অঞ্চলে জীবন এক এক রকম। দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন। কোনও কোনও অঞ্চলে মিনিস্কার্ট পরে রাস্তায় হাঁটলেও পথচারী পুরুষেরা কেউ ফিরে তাকায় না। কোথাও কোথাও ভেবে নেয় মিনিস্কার্ট পরেছে, নিশ্চয়ই সেক্স টেক্স করতে চাইছে। মেয়েদের পোশাকে নয়, সমস্যা দৃষ্টিভঙ্গিতে। সেটিকেই সুস্থ করতে হবে।

Manual1 Ad Code

মিয়া খলিফা নামের এক মুসলমান পর্নতারকা হিজাব পরে পর্ন ছবি করে। ছবি করার সময় মাথায় হিজাব ছাড়া শরীরে আর কোনও কাপড় থাকে না তার। অনেকে বলে, মিয়া খলিফার ওই হিজাবই নাকি যৌন আকর্ষণ বাড়ায়। আসলে কী দেখে কার কী জাগে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। মেয়েদের জুতো দেখলে অনেক পুরুষের যৌন তৃষ্ণা জাগে, তাই বলে কি মেয়েরা জুতো পরবে না? পুরুষের শরীরের যে অংশ দেখলে মেয়েদের যৌন তৃষ্ণা জাগে, সেসব অংশ তো কেউ বলছে না ঢেকে রাখতে? নারী পুরুষের পরস্পরের প্রতি যৌন আকর্ষণ থাকবেই, সেটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকত্বকে নোংরামো না ভেবে বরং একে নান্দনিক ভাবা উচিত। আমরা যত সভ্য হচ্ছি, যত শিক্ষিত হচ্ছি, তত এই আকর্ষণকে পারস্পরিক পছন্দের এবং ভালো লাগার ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে শিখেছি। ভয় দেখিয়ে, বা জোর খাটিয়ে এই সম্পর্ক চলে না, শিখেছি।

Manual2 Ad Code

হিজাব যে মেয়েদের রক্ষা করতে পারে না, তা হিজাবি তনুর ধর্ষণের এবং মৃত্যুর ঘটনা থেকেই জানি। মেয়েদের শরীরে বাড়তি কাপড় চড়িয়ে পুরুষকে চরিত্রবান বানানো যায় না, সমাজকে শুদ্ধও করা যায় না। সমাজকে নিরাপদ করতে হলে সমাজের মানুষকে কুশিক্ষা থেকে সরে থাকতে হবে। মেয়েদের প্রতি পুরুষের নষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পাল্টাতে হবে। মেয়েরা যে পোশাকই পরুক, মাথা উঁচু করে যেন সর্বত্র চলাফেরা করতে পারে। যখনই মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য হিজাব, বা প্রহরী, বা সন্ধের মধ্যে হলে ফেরার সময়সূচি ইত্যাদির প্রয়োজন হয়, তখন মনে রাখতে হবে, এভাবে মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনও দিনই সম্ভব হবে না, বরং চলাফেরার সীমা আরও কমতে থাকবে, এবং বিধি নিষেধ দিন দিন বাড়তে থাকবে। এ কোনও সুস্থ সমাজের চিত্র নয়। একটি সমাজ কতটুকু সুস্থ তা দেখতে হলে দেখতে হবে সেই সমাজে মেয়েরা কতটুকু স্বাধীনতা ভোগ করে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন 

Manual4 Ad Code

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

November 2017
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
252627282930  

সর্বশেষ খবর

………………………..