হকার তালিকায় বাড়ির মালিক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক

প্রকাশিত: ১:০৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৩০, ২০১৮

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন এ ধরনের খাবার গাড়ি বিনামূল্যে বিতরণ করলেও প্রকৃত হকাররা তা পাননি বলে অভিযোগ উঠেছে -ফাইল ছবিরাজধানীর হাতিরপুলে নিজ বাড়িতে স্বপরিবারে বসবাস করেন মোসা. আকলিমা খাতুন। অথচ তিনি শাহবাগ এলাকায় চা বিক্রেতার কোটায় ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে বিনামূল্যের খাবার গাড়ি পেয়েছেন। শুধু আকলিমাই নয়, তার মতো আরও অনেক বাড়ির মালিক. ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের সামর্থ্যবান নেতাকর্মী হকার সেজে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার নিরাপদ খাদ্য কর্মসূচি প্রকল্পের বিনামূল্যের ভ্যানগাড়ি হাতিয়ে নিয়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভ্যানপ্রাপ্তির তালিকা থেকে প্রকৃত হকাররা ছিটকে পড়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বিনামূল্যের খাবারের গাড়ি দিতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিটি করপোরেশনের অসাধু কর্মকর্তারা মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। যদিও সংশিস্নষ্ট প্রশাসন এসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের যথেষ্ট সত্যতা পাওয়া গেছে।
বাড়ির মালিক আকলিমা কিভাবে বিনামূল্যের খাবারের গাড়ি পেলেন, তা জানতে চাওয়া হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, ‘আমি কোনো গাড়ি পাইনি, গাড়ি পেয়েছে আমার স্বামী। সিটি করপোরেশনের তালিকায় হয়তো ভুল করে আমার নাম উঠেছে।’ আকলিমার দাবি, তার স্বামী নিজেই ওই ভ্যানে শাহবাগে চা-পুড়ি-সিঙ্গাড়া বিক্রি করেন। কখনো কখনো পরিবারের অন্য সদস্যরাও ওই দোকানে বসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাড়ির মালিক আকলিমার নামে গাড়ি নেয়া হলেও তা অন্য হকার ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন। আর সিটি করপোরেশন থেকে ওই গাড়ি পেতে আকলিমা মোটা অংকের অর্থ খরচ করেছেন।
এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও অনেক বিত্তশালী এই কর্মসূচি থেকে দেয়া বিনামূল্যের এসব গাড়ি পেলেও ফুটপাতের হকাররা বঞ্চিত হয়েছেন। আগের মতোই রাস্ত্মার পাশে ধুলাবালির মধ্যে বিভিন্ন খাবার বিক্রি করছেন তারা। এই কর্মসূচির আওতায় সবচেয়ে বেশি গাড়ি দেয়া হয়েছে রাজধানীর শাহবাগে। সরেজমিনে ওই এলাকা ঘুরে অন্ত্মত শতাধিক খাবারের খোলা খাবার দোকান দেখা যায়।
পাবলিক লাইব্রেরির সামনে এক বিক্রতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোক ছাড়া কেউই এসব গাড়ি পাননি। তার মতে, বিভিন্ন সিস্টেম করে এসব গাড়ি নিতে হয়। টাকা খরচ করতে পারেননি, তাই তিনি গাড়ি পাননি। পাশাপাশি আরও কয়েকজন ডিম, পিঠা, চা বিক্রেতার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে এইক ধরনের উত্তর পাওয়া যায়। তাদের একজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা রাস্ত্মায় বসে খাবার বেচি। অথচ সরকারের সুন্দর সুন্দর গাড়িগুলো তালা দিয়ে রাখা হয়েছে।’
বাড়ির মালিক বিনামূল্যের গাড়ি পায় কী করে? ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এমএ হামিদ খানের কাছে প্রশ্ন করা হলে যায়যায়দিনকে তিনি বলেন, গাড়ি বিতরণ বা হকারদের তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে তার কোনো ভূমিকা ছিল না। সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ ও দাতা সংস্থার লোকজন সরেজমিনে পরিদর্শন করে তালিকা করেছেন। ওই তালিকা অনুযায়ী গাড়ি বিতরণ করেছে। আর বাড়ির মালিক গাড়ি পাওয়ার বিষয়টি তার জানা নেই।
পরে সংস্থাটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শেখ সালাহউদ্দীনের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে টেলিফোনে কোনো মন্ত্মব্য করতে রাজি হননি তিনি।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৬ সালের শুরম্নতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার নিরাপদ খাদ্য কর্মসূচির আওতায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে বিনামূল্যে ১৮০টি গাড়ি দেয় হয়। এর আগে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ফুটপাতে অস্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রি করে এমন হকারদের বাছাই করা হয়। বাছাইকৃত হকারদের বিশেষ প্রশিক্ষণের পর প্রত্যেককে একটি করে গাড়ি দেয়া হয়। ওই বছর একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ ধরনের ১০০ গাড়ি বিনামূল্যে বিতরণের দাবি করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তারা। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বিতরণ করে ৮০টি গাড়ি।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৫টি গাড়ি পেয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এক নেতা। যিনি ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে চলাচলসহ সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ হিসেবে পরিচিত। রাজধানীর খিলগাঁয়ে বিভিন্ন হকারদের কাছে তিনি ভাড়া দিয়েছেন এসব গাড়ি। বিনিময়ে প্রতিটি গাড়ি থেকে এককালীন ২০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। এরপর দৈনিক ভাড়া তো আছেই। অন্যান্য এলাকায়ও গাড়ি বিতরণের ক্ষেত্রে একই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। এসব খাবার গাড়ি যারা পেয়েছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ফুটপাতে ব্যবসায় করেন না। ভাড়া একটু বেশি হলেও উচ্ছেদের ঝামেলা কম থাকায় গাড়িগুলো পেতে আগ্রহী হকাররাও। তাই বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে জামানত ও উচ্চ ভাড়ায় এসব গাড়ি ভাড়া নিয়েছেন অনেকেই।
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় সিটি করপোরেশনের এসব ভ্যানে করে চা-সিগারেট ও বেকারির বিভিন্ন খাবার সামগ্রী বিক্রি করেন এমন একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই গাড়িটি স্থানীয় এক নেতার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছেন তিনি। মাসে ৪ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। শুরম্নতে ৩০ হাজার টাকা জামানত রেখেছেন। সেখান থেকেও প্রতি মাসে কেটে নেয়া হয় ১ হাজার টাকা করে। এ ছাড়া প্রতি মাসে থানা পুলিশকে দিতে হয় ১ হাজার টাকা। তবে গাড়ির মালিককে তা জানাতে বা ফোন নম্বর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। শুধু জানান, ‘এলাকার বড় ভাই, বড় নেতা। সমনে আরও বড় নেতা হবেন।’
সিটি করপোরেশন থেকে বরাদ্দ পাওয়া গাড়িতে রাজধানীর মগবাজার থেকে বাংলামোটর যাওয়ার রাস্ত্মার ডান পাশের ফুটপাতে নানা রকম ফাস্ট ফুড বিক্রি করেন একজন। ওই বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় প্রতিদিন গাড়িটির ভাড়া বাবদ ২৫০ টাকা করে দিতে হয় তাকে। তবে কাকে ভাড়া দেন, তা বলতে তিনিও অস্বীকৃতি জনান।
কারওয়ান বাজার এলাকার এক বিক্রেতা বলেন, প্রতিদিনই টাকা দিতে হয়। তবে কাকে টাকা দেন বা গাড়ির মালিকের নাম বলতে পারেননি তিনি। শুধু বলেছেন, ‘যে টাকা নেয়, সে সিটি করপোরেশনের লোক।’
তবে সিটি করপোরেশনের কোনো লোক এসব গাড়ি থেকে টাকা আদায় করে না বলে জনিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কারওয়ান বাজার অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম অজিয়র রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব গাড়ি থেকে সিটি করপোরেশনের টাকা আদায় করার কোনো প্রশ্নই আসে না। গাড়িগুলোর জন্য স্থান নির্ধারণ করে তাদের বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে, যাতে পথচারীরা নাগালের মধ্যে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায়।সূত্র যায়যায় দিন

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..