সিলেটের পানি নামার পথেই নয় হাওরের সেই সড়ক

প্রকাশিত: ২:৪৭ পূর্বাহ্ণ, জুন ২০, ২০২৪

সিলেটের পানি নামার পথেই নয় হাওরের সেই সড়ক

Manual3 Ad Code

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক :: কিশোরগঞ্জে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম হাওরে অল ওয়েদার সড়কের দুই পাশের পানির উচ্চতায় কোনো পার্থক্য নেই। সেখানে পানিতে স্রোতও নেই। তবে অন্যান্য বছরের এই সময়ের তুলনায় পানি কিছুটা বেশি।

গত কয়েক দিনের পাহাড়ি ঢলে বিপর্যস্ত সিলেট-সুনামগঞ্জ। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কিশোরগঞ্জের হাওরে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একাংশের দাবি, এ সড়কটির কারণেই বন্যার পানি নেমে যেতে পারছে না।

কেবল এবারই নয়, গত বৈশাখে সুনামগঞ্জে অকাল বন্যায়ও এই সড়কটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছিল। তবে সে সময় সড়কের ১০ কিলোমিটারের আশপাশেও পানি ছিল না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিলেট থেকে নেমে আসা পানি যেদিক দিয়ে নামে তার বিপরীত দিকে সড়কটির অবস্থান। সিলেটের পানি নামে ধনু নদী দিয়ে। এটিই সিলেটে সুরমা নদী। এ নদীর দক্ষিণে সড়কটির অবস্থান।

এই সড়কের পুরো ৩০ কিলোমিটারের যে তিনটি নদী রয়েছে সেগুলোতেও বড় আকারের তিনটি সেতুসহ অনেক বক্স কালভার্ট রয়েছে।’

Manual5 Ad Code

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমান বলেন, ‘যারা এগুলো বলে তাদের কাছে কোনো স্টাডি নেই। বলতে হয় তাই বলে। সমালোচনা করতে হয় তাই করে। তাদের কাছে কোনে স্টাডি নেই, কোনো সার্ভে নেই। তারা এমনিতে বলে। সিলেটের পানি এই অল ওয়েদার সড়কের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না।

‘অনেকেই বলে, ভৈরব ব্রিজে এই পানি আটকে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা স্টাডি করে দেখেছি, এই কথারও কোনো সত্যতা নেই। আমরা বিভিন্নভাবে পানির লেভেল নিয়েছি, একই দিনে একাধিক পয়েন্টের পানি পরীক্ষা করে দেখেছি, তাতেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তারা এ কথা কীভাবে বলে তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।’

এই প্রকৌশলী বলেন, ‘সিলেটের পানি দুই-তিনটি নদী দিয়ে নামে। একটি হলো সুরমা ও পুরাতন সুরমা হয়ে নামে ধনু দিয়ে। সুনামগঞ্জের পানিও এই নদী দিয়ে নামে। নদীটির অবস্থান সড়কের এক পাশে সমান্তরালে। সিলেট অঞ্চলের আরেক নদী কুশিয়ারা হাওরে এসে হয়েছে কালিনী নদী। এটি সড়কের আরেক পাশ দিয়ে নামে। সেই বিবেচনায় এই অল ওয়েদার সড়ক কোনো ক্রমেই পানি নামতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। কারণ, নদীর স্রোত আর সড়কের অবস্থান সমান্তরালে, আড়াআড়ি নয়।’

এই সড়ক নির্মাণের ফলে পরিবেশের কোনো ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের বড় একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিতে আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত স্যার আছেন। তার নেতৃত্বে এই কমিটি দেখভাল করছেন। এই সড়কের কারণে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি-না ও পানিপ্রবাহ কোনো ধরনের বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না। হলে কী কারণে হচ্ছে তারা এই বিষয়গুলো দেখতেছেন।

‘তারা অলরেডি অল ওয়েদার সড়কসহ কিশোরগঞ্জ হাওরের বিভিন্ন পয়েন্ট ও নেত্রকোণার খালিয়াজুরী হাওরের বিভিন্ন পয়েন্ট সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করেছেন। এই বিষয়ে চূড়ান্ত রিপোর্ট এখনও আসেনি। তবে প্রাথমিক ধারণা মতে, এই সড়ক নির্মাণের ফলে পরিবেশেরও কোনো ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে না এবং পানি প্রবাহেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না বলে আমরা জানতে পেরেছি।’

Manual6 Ad Code

এই সড়ক আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সড়কটি নির্মাণের আগে আমরা এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় যেতে পারতাম না। এখন হাওরের তিন উপজেলাতেই সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ বেড়েছে।

Manual3 Ad Code

‘সরেজমিনে এসে দেখে যান’

ইটনা উপজেলা সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ফেসবুকে যে লেখালেখি, তাদের কেউ এখানে এসেছেন বলে মনে হয় না। আপনারা এসে দেখে যান। তারপর বলুন।’

তিনি বলেন, ‘এই সড়ক আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সড়কটি নির্মাণের আগে আমরা এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় যেতে পারতাম না। এখন হাওরের তিন উপজেলাতেই সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ বেড়েছে।

‘আগে কেউ অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে থাকলে নৌকা ছাড়া হাসপাতালে নেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বর্তমানে যেকোনো মহূর্তে আমরা সেই সেবা নিতে পারছি। আগে অনেক নারীর প্রসববেদনা শুরু হলে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই প্রসব বা মারা যেত। এখন অনায়াসেই হাসপাতালে যেতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে দেখলাম এই সড়কটিকে হাওরবাসীর দুঃখ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। আরেকটি প্রতিবেদনে দেখলাম এই সড়কের কারণে নাকি সিলেট থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, কারও মুখের কথা শুনে প্রতিবেদন না করে সরেজমিনে এসে দেখেন আপনার ধারণারও পরিবর্তন হবে। সিলেট থেকে পানি যেদিক দিয়ে নামে এই সড়কটি তার বিপরীত দিকে নির্মাণ করা হয়েছে।’

‘যখন সড়কের ১০ কিলোমিটার দূরে পানি ছিল না, তখনও একই কথা বলা হয়েছে’

ইটনা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল হাসান বলেন, ‘সুনামগঞ্জের বন্যার সঙ্গে এই সড়কটির কোনো সম্পর্ক নেই। সুনামগঞ্জ থেকে নেমে আসা পানিপ্রবাহের জন্য যে পয়েন্টগুলো রয়েছে সে পয়েন্টগুলোর সঙ্গেও এই সড়কের কোনো সম্পর্ক নেই।

‘গত বৈশাখ মাসেও সুনামগঞ্জে অকাল বন্যার কারণ হিসেবে এই সড়কটিকে দায়ী করা হয়েছিল। অথচ ওই সময়ে এই সড়কের ১০ কিলোমিটারের আশপাশেও পানি ছিল না। যারা এই সড়কটিকে নিয়ে অপপ্রচার করছেন তাদের সরেজমিনে এসে ঘুরে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

এই সড়কের কারণে যদি পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতো তবে দুই পাশের পানির লেভেলে তারতম্য থাকত। পানি তো সমান লেভেলে আছে। সিলেটের পানি নামার রাস্তার পয়েন্ট হচ্ছে ধনু নদীর উত্তর দিক দিয়ে আর অল ওয়েদার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে দক্ষিণ দিক দিয়ে।

মিটামইন উপজেলার ঢাকী ইউনিয়নের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম ভূইয়া উজ্জ্বল বলেন, ‘গতকালও এই সড়কের পুরোটা ঘুরে দেখেছি। তিন উপজেলায় যে তিনটি বড় সেতু রয়েছে সেগুলোও ঘুরে এসেছি। সড়কের দুই পাশেই সমান পানি। সেতুগুলোর নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে, তাতেও খুব বেশি পানির চাপ দেখিনি।

‘এই সড়কের কারণে যদি পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতো, তবে দুই পাশের পানির লেভেলে তারতম্য থাকত। পানি তো সমান লেভেলে আছে। সিলেটের পানি নামার রাস্তার পয়েন্ট হচ্ছে ধনু নদীর উত্তর দিক দিয়ে আর অল ওয়েদার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে দক্ষিণ দিক দিয়ে।’

‘স্টাডি করেই সড়কটি নির্মাণ হয়েছে’

অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হারুন অর রশিদ বলেন, ‘ভারতের মেঘালয় রাজ্যে গত কয়েক দিনের অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার বিপুলসংখ্যক বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। পুরো সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহর বর্তমানে পানিতে ভাসছে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, কেউ কেউ অজ্ঞানতাবশত এই অকাল বন্যা/ফ্লাশফ্লাডের জন্য নবনির্মিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অল ওয়েদার সড়ককে দায়ী করছে।

‘তাদের সবার অবগতির জন্য জানাতে চাই, এই সড়কের সঙ্গে অকাল বন্যার ন্যূনতম সম্পর্কও নাই। বিস্তারিত স্টাডির ভিত্তিতে এই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে নদী ও স্রোতের সমান্তরালে। ফলে নদীর পানিপ্রবাহে কোনো বাধার সৃষ্টি হচ্ছে না। বর্ষাকালে অতিরিক্ত উপচে পড়া পানিপ্রবাহের জন্য পর্যাপ্ত ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।’

এই সড়কটি হাওর অঞ্চলের মানুষের কৃষি, মৎস্য, পর্যটন ও যাতায়াতসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

যারা বন্যার জন্য এ সড়ককে দায়ী করছেন, তাদের বক্তব্য একপেশে। এ সড়ক নির্মিত হওয়ার আগেও হাওরে বন্যা হয়েছে। তখনও গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে।

সুনামগঞ্জ জেলা ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের উত্তরে অবস্থিত। সব সুনামগঞ্জ জেলার জলধারাকে ৩টি অংশে ভাগ করা যায়।

প্রথম ধারা সুনামগঞ্জ, বিশ্বরম্ভপুর, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ উপজেলার পানি নেত্রকোণার খালিয়াজুরী হয়ে ইটনা উপজেলার উত্তর-পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নিকলি, কুলিয়ারচর হয়ে ভৈরবে মেঘনায় মিলিত হয়। সুরমা, বাউলাই, ধনু, ঘোড়াউত্রা, মেঘনা নদী এই প্রবাহপথে অবস্থিত। সুনামগঞ্জের বেশির ভাগ জল এই পথে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহপথের মধ্যে কোথাও অল ওয়েদার রোড পড়েনি। ছবিতে নীল রঙের তীর চিহ্ন দিয়ে পানির প্রবাহপথ দেখানো হয়েছে।

দ্বিতীয় ধারা সুনামগঞ্জ, জামালগঞ্জ, দিরাই ও শাল্লা উপজেলার পানি নেত্রকোণার খালিয়াজুরী হয়ে ইটনা উপজেলার পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আজমিরীগঞ্জের কাছে কালনী নদীতে মিলিত হয়। যা আরও অগ্রসর হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এই প্রবাহপথের মধ্যেও অল ওয়েদার রোড পড়ে নাই।

তৃতীয় ধারা দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, ছাতক, জগন্নাথপুর, দিরাই ও শাল্লা উপজেলার পানি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে কুশিয়ারা নদীতে পতিত হয়, যা অগ্রসর হয়ে কালনী এবং আরো অগ্রসর হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এই প্রবাহপথের মধ্যেও অল ওয়েদার রোড পড়ে নাই।

কিশোরগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সাইফউদ্দীন আহমেদ লেনিন বলেন, ‘যারা বন্যার জন্য এ সড়ককে দায়ী করছেন, তাদের বক্তব্য একপেশে। এ সড়ক নির্মিত হওয়ার আগেও হাওরে বন্যা হয়েছে। তখনও গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে।’

লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার সব পানি উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। বাউলাই, ধনু, ঘোড়াউত্রা নদী উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত। বাউলাই, ধনু, ঘোড়াউত্রা নদীর প্রবাহ পথের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামে অল ওয়েদার রোড উত্তর-দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত করে তৈরি করা হয়েছে, যাতে পানির প্রবাহ কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়।

২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আনুষ্ঠানিকভাবে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ৮৭৪ কোটি ৮ লাখ টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে।

২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসি গার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে।

৭.৬০ লাখ বর্গমিটার সিসি ব্লক দিয়ে স্লোপ প্রটেকশনের কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬১.৮১ মিটার দীর্ঘ ভাতশালা সেতু, ১৭১.৯৬৪ মিটার ঢাকী সেতু এবং ১৫৬.৭২ মিটার দীর্ঘ ছিলনী সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

২০২০ সালের ৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকাল সাড়ে ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।

সূত্র : নিউজবাংলা

Manual6 Ad Code

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

June 2024
S S M T W T F
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  

সর্বশেষ খবর

………………………..