বাবা বলেছিলেন, তাই ২২ বছর পাখিসেবা

প্রকাশিত: ৪:২৬ অপরাহ্ণ, জুন ২২, ২০১৯

বাবা বলেছিলেন, তাই ২২ বছর পাখিসেবা

Manual2 Ad Code

হাওরপারে বাড়ি। ঝড়ের এক রাত। একঝাঁক বক আশ্রয় নেয় বাড়ির আঙিনার গাছগাছালিতে। পরে তাদের দেখাদেখি আরও পাখপাখালি চলে আসে। বাড়িটি রূপ পায় পাখিবাড়িতে। ‘বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া পাখি মাইরো না। মারতেও দিয়ো না। পারলে সেবা দিয়ো।’ মৃত্যুর আগমুহূর্তে বাড়ির মালিক তাঁর বড় ছেলেকে এ কথা বলেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর ছেলে ১৭ বছর সেই নির্দেশনা মেনেছেন। এই ছেলে মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলেরা পাঁচ বছর ধরে পাখিসেবার সেই মহৎ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

Manual1 Ad Code

পিতৃভক্তি থেকে পাখিসেবার পরম্পরার এ কাহিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শ্রীরামপুরের। ওই গ্রামের প্রয়াত হাবিবুর রহমান বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া পাখিদের সেবা করতেন। বাড়িটি তখন থেকে ‘পাখিবাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৯৯৭ সালে হাবিবুর রহমান মারা যাওয়ার সময় তাঁর পাঁচ ছেলেকে ডেকে পাখির সেবা অব্যাহত রাখার কথা বলেন। ছেলেদের কাছে তা ‘বাবার অন্তিম কথা’ হিসেবে মনে গেঁথে ছিল। বড় ছেলে দুদু মিয়া বাবার কথা রাখতে শুরু করেন পাখিসেবা। এ নিয়ে ২০১২ সালে বিশ্ব বাবা দিবসে প্রথম আলোয় ‘পিতৃভক্তের পক্ষীসেবা’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়।

দুদু মিয়া ১৯৯৭ সাল থেকে একনাগাড়ে ১৭ বছর পাখিসেবা করেন। ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর তিনি মারা যান। তিনিও তাঁর বাবার মতো ছেলেদের ডেকে পাখিসেবা অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দিয়ে যান। এরপর থেকে তাঁর পাঁচ ছেলে প্রায় পাঁচ বছর ধরে পাখির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখিয়ে চলেছেন। তাঁরা পাঁচ ভাই পালা করে সেবা করেন বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া পাখিদের। একইভাবে প্রয়াত হাবিবুর রহমানের কথা রাখতে তাঁর অন্য ছেলেরা এবং নাতিরাও পাখির সেবা দিচ্ছেন।

গতকাল শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় ২৪০ শতাংশ আয়তনের এই পাখিবাড়ি। ঠিক বাড়ির পেছনেই রয়েছে হাওর। সেখান থেকে বাড়ি পর্যন্ত পাখির আনাগোনা। বাড়িটির এমন কোনো গাছ নেই, যে গাছে পাখির বাসা নেই।

বাড়ির লোকজনের হিসাব অনুযায়ী, এ মৌসুমে (বৈশাখ থেকে আষাঢ়) জন্ম নেওয়া বকের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ হাজার হবে। গত দেড় দশকে এ বাড়িতে কয়েক লাখ বক বেড়ে উঠেছে।

গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওই বাড়িতে অবস্থান নিয়ে প্রয়াত দুদু মিয়ার ছেলেদের পাখিসেবার নানা কৌশল দেখা যায়। বাঁশঝাড়ে সদ্য জন্ম নেওয়া দুই জোড়া বকছানার মধ্য থেকে হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় তিনটি মাটিতে পড়ে যায়। ছানাদের আর্তনাদে মা-বক উদ্ভ্রান্তের মতো ওড়াউড়ি শুরু করে। বার কয়েক মা-বকের ওড়াউড়ি দেখে বাসাটি শনাক্ত করেন রুমেন আহমদ। তিনি প্রয়াত দুদু মিয়ার পাঁচ ছেলের মধ্যে তৃতীয়। পরম মমত্বে বকছানা দুটিকে নীড়ে তুলে দিলেন। কোথায় কোন পাখির বাসা, তাতে ডিম কতটি আছে, সবই নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। রুমেন জানান, বর্ষা শেষে বকেরা হাওর-বাঁওড়ের দিকে চলে যায়। তখন বাড়ির গাছগাছালিতে ঠাঁই নেয় টিয়াসহ নানা জাতের দেশীয় পাখি।

Manual1 Ad Code

বাড়ির উঠানের দিকে বড় বাঁশঝাড়ে সবচেয়ে বেশি বক প্রজাতির পাখি। সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন প্রয়াত দুদু মিয়ার বড় ছেলে রুবেল আহমদ। যে ঝোড়ো রাতে এই বাড়িতে প্রথম একঝাঁক বক আশ্রয় নিয়েছিল, তার দিনক্ষণ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না তিনি। তবে সময়টা মুক্তিযুদ্ধের সময় হবে এবং সেই সময় থেকে তাঁদের বাড়িতে পাখিসেবার শুরু বলে জানান তিনি।

Manual6 Ad Code

রুবেল বলেন, ‘আমার বাবার বাবা (দাদা) বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া পাখির প্রতি যেভাবে ভালোবাসা দেখাতে বলছিলেন, ঠিক সেইভাবে বাবাও (দুদু মিয়া) আমাদের বলেছিলেন। বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া পাখিগুলো যেন ছিল বাবার সন্তানের মতো। তাই আমরাও বাবাকে স্মরণ করে একই মায়া দেখাচ্ছি। যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন বাবার মায়ায় পাখিগুলোর সেবা করে যাব।’

Manual2 Ad Code

২০১২ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে প্রয়াত দুদু মিয়াকে ‘পাখিপ্রেমী’ বলে সংবর্ধনা দিয়েছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘ওই বাড়ির আশপাশে আরও অনেক বাড়ি আছে। কিন্তু সব পাখির বিচরণ শুধু ওই এক বাড়িতে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। পরে যখন জানলাম, এর পেছনে তাঁদের প্রয়াত বাবার স্মৃতি জড়িত, তখন অন্য রকম শ্রদ্ধাবোধ জাগে তাঁদের প্রতি।’

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..