জনগণের টাকা মেরে ওরা লাপাত্তা

প্রকাশিত: ১:৩১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০

জনগণের টাকা মেরে ওরা লাপাত্তা

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : জনগণের টাকা লোপাট করে অনেকেই এখন লাপাত্তা। তাদের নামের পাশে রয়েছে প্রভাবশালী তকমা। কেউ কানাডায়, কেউ দুবাই কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন। কেউবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে নিশ্চিন্তে দিন গুজরান করছেন। বেগমপাড়ার কথাতো সবারই জানা। জনগণের টাকা লোপাট করে কেউ কেউ হলিউডে সিনেমা বানানোর ঘোষণাও দিচ্ছেন। দেশীয় অন্যান্য সংস্থার মতো দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) চলছে এসব ‘হাই প্রোফাইল’ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান। কারো কারো বিরুদ্ধে হয়েছে মামলাও। মামলা মাথায় নিয়েই গা-ঢাকা দিয়েছেন তারা।

২০১২ সালের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ওই গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির। দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে গা-ঢাকা দেন তিনি। জানা গেছে, কানাডা ও মালেয়শিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন হুমায়ুন কবির। তার পরিবারের সদস্যরাও কখনো কানাডায় কখনো মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করেন। হলমার্ক গ্রুপের প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় দুদক এখন পর্যন্ত ৩৭টি মামলা করেছে। এসব মামলায় হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, এমডি তানভীর মাহমুদ, সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবিরকে আসামি করা হয়। এছাড়া ব্যাংকের আরো ২০ কর্মকর্তাসহ তানভীরের কয়েক আত্মীয়কেও এ মামলায় আসামি করা হয়।

বেসিক ব্যাংক ইস্যুতে অনেক আলোচনা রয়েছে। ব্যাংকটির সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারিতে দুদকের দায়ের করা মামলার আসামি ১২০ জন। বছরের পর বছর কেটে গেলেও দুদকের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর নাম আলোচনায় এসেছে বার বার। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কার দুর্নীতির সব আলামত, দলিল, কাগজপত্র দুদকের হাতে। সে সময়ের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত ও অর্থ আত্মসাতে যোগসাজশ থাকা ব্যাংকের গুলশানসহ কয়েকটি শাখার দুর্নীতি-সংক্রান্ত সব নথিও রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তাদের ফাইলে। এরপরও তদন্তের কোনো কূল-কিনারা হয়নি। বর্তমানে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি মামলার তদন্ত করছেন। দুদক ২০১৫ সালের ২১-২৩শে সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৩৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৫৬টি মামলা করে।

৩৬শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার কানাডায় চম্পট দেন। অভিযোগ রয়েছে, পিকে হালদার পিপল্‌স লিজিং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) দায়িত্ব পালন করে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন। ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। মামলার এজাহারে পিকে হালদার ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকার লেনদেনের বিষয়ে তথ্য ছিল। দুদক ও বিএফআইইউ সূত্রে জানা গেছে, কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন পিকে হালদার। দুদকের অনুরোধে পিকে হালদারের অপকর্মের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বিএফআইইউ। সম্প্রতি এই প্রভাবশালী ব্যাংকার দেশে ফিরতে আদালতের আশ্রয় চেয়েছেন।

ক্রিসেন্ট গ্রুপ পরিবারের অন্যতম সদস্য আব্দুল আজিজ। হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, আজিজের পুরো পরিবারের হাতে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ওই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ। দেশীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধারও তিনি। দুদক সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি না করেও ভুয়া রপ্তানি বিলের মাধ্যমে জনতা ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে সংস্থাটি। এ মামলায় অন্যতম প্রধান আসামি রিমেক্স ফুটওয়্যারের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ। মামলার এজাহারে ক্রিসেন্ট লেদারের বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। ক্রিসেন্ট ট্যানারির বিরুদ্ধে ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ৯৫ হাজার ১২০ টাকা, লেসকো লিমিটেডের ৭৪ কোটি ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৯ টাকা, রূপালী কম্পোজিট লেদারের ৪৫৪ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮৪ টাকা এবং রিমেক্স ফুটওয়্যারের বিরুদ্ধে ৬৪৮ কোটি ১২ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। এ মুহূর্তে দুদক আব্দুল আজিজকে গ্রেপ্তারের জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে এই ব্যক্তি বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে পলাতক থাকলেও সামাজিক মাধ্যমে সরব আজিজ। সম্প্রতি তিনি ফেসবুকে এক পোস্টে হলিউডে সিনেমা নির্মাণের ঘোষণাও দেন।

স্বাস্থ্যখাতের মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। পুরো স্বাস্থ্যখাতে বিস্তৃত মিঠুর জাল। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টেন্ডারবাণিজ্যসহ নানা পথে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক তিনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদপ্তর, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর এজেন্ট। তারা মিঠুর হয়ে কাজ করে। স্বাস্থ্যখাতে মিঠু মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর ইউনিয়নে। মিঠু বেশির ভাগ সময় বিদেশে থাকেন। তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্যখাত। বিদেশেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। ২০১৬ সালের ৯ই মে প্রকাশিত বহুল আলোচিত পানামা পেসার্স কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারী হিসেবে মিঠুর নাম আসে। গত অর্ধযুগে দুদক তার বিরুদ্ধে কয়েক দফায় তদন্তের উদ্যোগ নিলেও কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোনো নোটিশ হলেই হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মিঠু। পরে সেটি নথিভুক্ত করার মাধ্যমে ‘অভিযোগ নিষ্পত্তি’- করিয়ে নেন। মিঠুর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত একটি ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করেছে দুদক। ২০১৬ সালের ১০ই মে বনানী থানায় মামলাটি করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক। গত দুই বছরে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে দুদক অনেক অনুসন্ধান করলেও মিঠু রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এমনকি দুদকের সুপারিশের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করেছে সেখানে মিঠুর একটি প্রতিষ্ঠানেরও নাম নেই।

শিক্ষকতা থেকে ঠিকাদারিতে নাম লেখান স্বাস্থ্যখাতের আরেক ডন জাহের উদ্দিন সরকার। ধীরে ধীরে তার পুরো পরিবারকে ঠিকাদারির সঙ্গে সম্পৃক্ত করান। দুদকে রয়েছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ। জানা যায়, জাহের ঠিকাদারি করে বাড়ি কিনেছেন অস্ট্রেলিয়াতে, সেখানে রয়েছে ব্যবসাও। তার এক স্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার ওই বাড়িতে থাকেন এবং তার সেখানকার ব্যবসা দেখাশোনা করেন। দেশে থাকেন আরেক স্ত্রী। সাবেক স্কুলশিক্ষক জাহেরের সম্পদের পরিমাণ কত তার সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও দিনাজপুরের ফুলবাড়ী এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ঠিকাদার চক্র গঠন করে জাহের এখন শতকোটি টাকার মালিক। ঢাকা ও দিনাজপুরসহ দেশে-বিদেশে রয়েছে তার সম্পদের পাহাড়। তিনিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরখাস্ত হওয়া হিসাবরক্ষক আবজালের (বর্তমানে কারাবাসে থাকা) মতো বিপুল সম্পদের মালিক। আর আবজালেরই হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সূত্র- মানবজমিন

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

September 2020
S S M T W T F
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
2627282930  

সর্বশেষ খবর

………………………..