বড়লেখায় ধনাঢ্য লন্ডন প্রবাসীর বাড়িতে তরুণীর মৃত্যুর রহস্যের জট খুলছে

প্রকাশিত: ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৬, ২০২০

বড়লেখায় ধনাঢ্য লন্ডন প্রবাসীর বাড়িতে তরুণীর মৃত্যুর রহস্যের জট খুলছে

ক্রাইম ডেস্ক :: নবীগঞ্জের রূপসী তরুণীর মৃত্যুর রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। বড়লেখায় ধনাঢ্য লন্ডন প্রবাসী জয়নাল চৌধুরীর পানিসাইল গ্রামের বাংলো বাড়িতে ২৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে যুবতী সাহিদা আক্তারের লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ।

সাহিদা আক্তার মোবাইকলে মাধ্যমে ওই প্রবাসীর সাথে তার সম্পর্কের শুরু হয়। একপর্যায়ে তরুণীর বড়বোন ও বোনের জামাইসহ একটি চক্রের ক‚টচালে লন্ডন প্রবাসীকে ব্যাকমেইল করার চাপেই সাহিদা আক্তার আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলেই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে।

এদিকে সাহিদার আত্মহত্যার ঘটনায় তার বাবা বাদী হয়ে গত বুধবার ধনাঢ্য লন্ডন প্রবাসী জয়নাল চৌধুরীসহ তার পরিবারের কয়েকজনের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েক মাস আগে লন্ডন অবস্থানকালে হঠাৎ বাংলাদেশী একটি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে মিসডকল পান বড়লেখার পানিশাইল গ্রামের বাসিন্দা ধনাঢ্য লন্ডন প্রবাসী জয়নাল চৌধুরী। জরুরী মনে করে তিনি তাৎক্ষণিক কলব্যাক করতেই নারী কন্ঠ শুনতে পান। এরপর থেকেই ষাটোর্ধ জয়নাল চৌধুরীর সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে তরুণী সাহিদা তাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করতে থাকেন। জয়নাল চৌধুরী তার রুমান্টিক কথাবার্তা ও রূপযৌবনে মজে যান। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে।

সাহিদার সাথে জয়নাল চৌধুরীর সম্পর্কের বিষয়টি লুফে নেয় তার সুচতুর বড়বোন ও বোনের জামাই ফুল মিয়া। তারা সাহিদাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে জয়নাল চৌধুরীর নিকট থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখে। বিভিন্ন সময় নানা অসহায়ত্বের কথা বলে সাহিদাকে দিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করতে থাকে।

বড়ধরণের ব্যাকমেইল করতে একটি মহলকে নিয়ে তারা জাল বুনতে শুরু করে। সহায় সম্পত্তির খোঁজ-খবর নিতে জয়নাল চৌধুরী দেশে আসলে তরুণী সাহিদা আক্তার বাবা-মায়ের কথা বলে তাকে নবীগঞ্জে নেয়ার জন্য বারবার চাপ দিচ্ছিল। তিনিও ঘনিষ্ট রূপসী তরুণীর সান্নিধ্য পাওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি।

গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে তিনি নবীগঞ্জের আউশকান্দিতে ফুলকলি মিষ্টির দোকানে সাহিদার সাথে দেখা করেন। একপর্যায়ে সাহিদা ভাত খাওয়ার কথা বলে জয়নাল চৌধুরীকে আউশকান্দি বাজারের একটি রেষ্ট্যুরেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান সাহিদা আক্তারের বড়বোন, বোনের ছেলে নয়ন মিয়া, বোন জামাই ফুল মিয়াসহ পরিবারের ১০-১২জন লোক পুর্ব থেকে সেখানে অবস্থান করছেন।

এসময় তারা জয়নাল চৌধুরীকে ঘেরাও করে জোরপূর্বক গাড়ীতে তুলে রাইয়াপুর গ্রামে তাদের বসতবাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে জয়নাল চৌধুরী তাদের হাবভাব দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সাহিদার পরিবারের লোকজন তার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করে। তাৎক্ষনিক সাহিদাকে বিয়ে না করলে অবস্থা খারাপ হবে বলে হুমকি দেয়। এসময় তার সাথে সাহিদা আক্তারের সাথে অন্তরঙ্গভাবে দাড় করিয়ে একটি ছবিও তারা তুলে নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ঐ দিন জয়নাল চৌধুরী তাদের হাতে পায়ে ধরে সাহিদার সহযোগিতা পেয়ে কোনমতে ফিরে আসেন। কিন্তু তার পিছু ছাড়েনি সাহিদার বোন, বোনের জামাইসহ লোভী চক্রটি।

এরপর থেকে জয়নাল চৌধুরীকে ফুল মিয়া ও তার স্ত্রী সাহিদাকে সিলেটের বাসা লিখে দিয়ে বিয়ে কর‍তে অব্যাহত চাপ ও হুমকি দিতে থাকে। বিয়ে না করলে তাকে অপহরণ মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। অব্যাহত হুমকি ধমকিতে নিজের নিরাপত্তা ও মান সম্মানের ভয়ে জয়নাল চৌধুরী গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নবীগঞ্জে গিয়ে বড়বোনের ছেলে নয়নসহ সাহিদাকে বড়লেখায় নিয়ে এসে নিজের বাগান বাড়িতে রাখেন।

একটি সুত্র জানায়, প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে সাহিদা আক্তারের বোন ও বোনের জামাই সাহিদার বোনের ১৬ বছরের কিশোর ছেলে নয়নকে তার সাথে পাঠিয়ে দেয়। চক্রটি জয়নাল চৌধুরীর ছায়া সঙ্গী হিসেবে নয়নকে নিয়োজিত রাখে যাতে তার সবধরণের খবরা-খবর তার মাধ্যমে তারা পেয়ে থাকে।

কিন্তু এরইমধ্যে ভাগ্য বিড়ম্বিত সাহিদা আত্নহত্যার পথ বেচে নিলে প্রবাসী জয়নাল চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেইল করে সম্পদ আত্মসাৎ ও বড় অঙ্কের টাকা কামানোর সব স্বপ্ন-স্বাদ ভেস্তে যায়।

কি ঘটেছিল মৃত্যুর আগে ও পরে :

জয়নাল চৌধুরী গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সকালে শাহিদা আক্তারকে বাগান বাড়িতে রেখে তার বোনের ছেলে নয়নকে নিয়ে বড়লেখা পৌরশহরের নিজের মালিকানাধীন আল আমিন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের নিয়ে জরুরী সভা করেন। মিটিংয়ে অবস্থান কালিন বাগানবাড়ির পাশ্ববর্তী বাসিন্দা অনন্ত দাস ফোন করে জানায় সাহিদা আক্তার একটি কক্ষে ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। তাৎক্ষনিক নয়নকে সাথে নিয়ে জয়নাল চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে ওই কক্ষে দেখতে পান ভিতর থেকে ছিটকারি আটকানো। নয়ন ও তিনি কেয়ারটেকারদের নিয়ে দরজা ভেঙে ঝুলন্ত লাশ নামিয়ে মেঝেতে রাখেন।

ঘটনার আকস্মিকতায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন জয়নাল চৌধুরী। পরে নয়নের বাবা মৃত সাহিদার দুলাভাই ফুল মিয়াকে জয়নাল চৌধুরী ফোন দিয়ে সাহিদার আত্মহত্যার ঘটনা জানান। ঘটনা শুনে শোকাভিভূত না হয়ে উল্টো তিনি তার ছেলেকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। ফুল মিয়া বলেন তার ছেলে নয়নকে লন্ডনে নিয়ে গেলে সাহিদার আত্মহত্যার ঘটনাটি তিনি সামাল দিবেন। আর এটা না করলে তিনি জয়নাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করার হুমকি প্রদান করেন।

এ কারনেই তিনি লন্ডন নেয়ার কথা বলে সিলেট নগরীর সোবহানীঘাটের একটি আবাসিক হোটেলে রাত্রি যাপন করে পরদিন বিকালের একটি ফ্লাইটে নয়নকে নিয়ে তিনি যাত্রা করেন। এরপর কৌশলে তিনি নয়নকে ঢাকা বিমান বন্দরে রেখে লন্ডনে ফাঁড়ি জমান। সেখান থেকে নয়ন মিয়া এনা পরিবহণের একটি বাসে করে নবীগঞ্জের রাইয়াপুর গ্রামে পৌঁছে।

কি কারণে সাহিদার (খালার) মোবাইল ভেঙে ফেললো নয়ন? :

সাহিদার আত্মহত্যার ঘটনার পর জয়নাল চৌধুরীর বাড়ি থেকে নয়ন নবীগঞ্জে তার বাবা ফুল মিয়ার সাথে মোবাইলে অনেক্ষণ কথা বলে। এসময় তার বাবা মৃত সাহিদার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি তাৎক্ষনিক ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিলে নয়ন তা দ্রুত ভেঙে চুরমার করে দেয়।

বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ফুলমিয়া কেন তার পুত্র নয়নকে দিয়ে শালিকা সাহিদার ব্যবহৃত মোবাইলটি ভেঙে ফেললো। মোবাইলে কী এমন তথ্য ছিলো বা আত্মহত্যার পুর্বে সাহিদার সাথে দুলাভাই ফুল মিয়ার কী এমন কথা হয় যা ফাঁস হলে তারাই ফেঁসে যেতে পারে। যে কারণে মোবাইলটি ভেঙে ফেলার প্রয়োজন পড়লো। এ রহস্য উদঘাটিত করতে পারলে সাহিদার আত্মহত্যার মূল কারণ বেড়িয়ে আসবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।

এদিকে বড়লেখা ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যাকারী তরুণী সাহিদার নবীগঞ্জের গ্রামের বাড়ি রাইয়াপুর গেলে তার পরিবারের লোকজনের রহস্যজনক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। বারবার অনুরোধ করার পরও সাহিদার বোনের ছেলে অনেক ঘটনার সাক্ষী নয়নকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করতে দেয়া হয়নি।

দুলাভাই ফুল মিয়াও মিডিয়ার সামনে আসেননি। কারণ এ দু’জন মিডিয়ার মুখোমুখি হলে সাহিদাকে ব্যবহার করে লন্ডন প্রবাসী জয়নাল চৌধুরীকে ব্ল্যাকমেইল করে বড় ধরনের ফায়দা লোটার যে পরিকল্পনা আঁটা হয়েছিলো সাংবাদিকদের প্রশ্নবানে মুখ ফসকে তা বেরিয়ে আসার আশংকায়ই তারা নিজেদের আড়াল করছে বলে সচেতন মহল মনে করেন।

এদিকে গত ৪ মার্চ বুধবার মৃত সাহিদা আক্তারের বাবা নবীগঞ্জ উপজেলার রাইয়াপুর গ্রামের রব্বান মিয়া মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় লন্ডন প্রবাসী জয়নাল চৌধুরীসহ তার পরিবারের ৫ জনের নাম উল্লেখ ও আরো কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামী করে বড়লেখা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলা করতে বড়লেখা থানায় অবস্থান করলেও এক সেকেন্ডের জন্যও রব্বান মিয়া গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে পড়েননি।

জয়নাল চৌধুরী যা বললেন-লন্ডন প্রবাসী জয়নাল চৌধুরী জানান, কয়েক মাস আগে লন্ডন থাকা কালিন মিসডকলের মাধ্যমে সাহিদা আক্তার তার সাথে যোগাযোগ শুরু করে। ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, মেয়েটিকে তারও ভাল লেগেছিলো। বিয়ে করারও চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। তার নিকট থেকে বিভিন্ন ভাবে সে ও তার বোন, বোন জামাই টাকা পয়সাও হাতিয়ে নেয়। কিন্ত দেশে আসার পর দেখা করতে নবীগঞ্জ যাওয়ার পরই তার চোখ খোলে যায়। ক্লিয়ার হয়ে যান ওই রূপসী নারীকে দিয়ে একটি চক্র তাকে ব্ল্যাকমেইল করে সম্পদ ও টাকা লুটে নেয়ার ফাঁদ পাতছে। মান সম্মান ও জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে সাহিদাকে বড়লেখায় নিয়ে আসতে বাধ্য হন।

তার বোনের ছেলেকে সাথে নিয়ে বড়লেখা শহরে এক সভায় থাকা কালিন খবর পান সাহিদা আক্তার আত্মহত্যা করেছে। তিনিও বুঝতে পারছেন না কেন সে আত্মহত্যা করেছে। সাহিদার ভাই ফুল মিয়াকে আত্মহত্যার ঘটনা জানালে সে তার ছেলে নয়ন মিয়াকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার ছাপ দিতে থাকে। না নিলে আমাকে হত্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি প্রদান করে। এরপর আমার ক্ষতি সাধনের নানামুখী তৎপরতা ও ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়েই লাশ রেখে লন্ডন নেয়ার কথা বলে নয়নকে সাথে নিয়ে তিনি ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। সাহিদা তার বাড়িতে পালিয়ে আসার অভিযোগ অস্বীকার করে জয়নাল চৌধুরী প্রশ্ন রাখেন, তাহলে তার বোনের ছেলে নয়ন মিয়া আসলো কেন, দিব্বি স্বাভাবিক চলাফেরা করলো কিভাবে।

বড়লেখা থানার ওসি মো. ইয়াছিনুল হক বুধবার রাতে জানান, নবীগঞ্জের তরুণী সাহিদা আক্তার নিহত হওয়ার ঘটনায় তার বাবা রব্বান মিয়া জয়নাল চৌধুরীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ মামলাটি রেকর্ড করে ঘটনার তদন্ত কাজ শুরু করেছে। গত ২৭ ফেব্র“য়ারী সন্ধার পর পুলিশ জানতে পারে জয়নাল চৌধুরীর বাংলাবাড়িতে এক নারীর লাশ পড়ে রয়েছে। রাত একটায় তার লাশ উদ্ধার করে পরদিন শুক্রবার ময়না তদন্ত শেষে স্বজনদের নিকট লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..