সিলেটের গোলাপগঞ্জে বেদেপল্লীর সবুজ বিদ্যাবাড়িতে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে তাসমিনা

প্রকাশিত: ২:১০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১২, ২০১৯

সিলেটের গোলাপগঞ্জে বেদেপল্লীর সবুজ বিদ্যাবাড়িতে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে তাসমিনা

Manual4 Ad Code

বেদেপল্লীর স্কুলটির নাম সবুজ বিদ্যাবাড়ি। সিলেটের গোলাপগঞ্জের কদমতলীতে এই স্কুল। স্কুলটি পরিচালনা করে তাসমিনা খান সোমার প্রতিষ্ঠা করা মিজারেবল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন।  সোমার বাবা জয়নাল আবেদিন একজন কাঠমিস্ত্রি। তাঁর মা হাজেরা বেগম গৃহিণী। সোমা এইচএসসি পাস করেছেন মেট্রোসিটি উইমেন্স কলেজ থেকে। এখন ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে বিএসসি (নার্সিং) চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন।

সংগঠনের জন্মকথা
২০১৭ সাল। ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলেন সোমা। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই মানুষের নানা রকম সমস্যা দেখে আসছেন। যেমন—কারো ওষুধ কেনার পয়সা নেই, কেউবা ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছে না ইত্যাদি। বেশির ভাগ রোগীই নারী। স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের সচেতনতা নেই বলাই ভালো। তাসমিনার মনে এগুলো দাগ কাটে। তাদের জন্য কিছু করার কথা ভাবতে থাকেন। আগস্ট মাসের এক বিকেলে বন্ধুদের ডাকলেন। বসলেন কলেজের খোলা মাঠে। কুলসুম আক্তার, নাহিদা বেগম, তানভীর আহমদসহ ছয়জন উপস্থিত। নিজের ভাবনা জানালেন বন্ধুদের। বন্ধুরা খুশি হলেন, উৎসাহ দিলেন। সবাই মিলে নাম ঠিক করলেন মিজারেবল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। নিজে ১০০ টাকা চাঁদা দিলেন। সদস্য ফি নির্ধারিত হলো ৫০ টাকা।

কর্মকাণ্ড
প্রথমে করলেন ব্লাড ক্যাম্প। বিনা মূল্যে কয়েক হাজার মানুষের রক্তের গ্রুপ জানিয়ে দিলেন। তারপর ব্লাড ডোনারদের একত্র করলেন। আরো পরের দিকে দুই ঈদে কাপড়-চোপড়, সেমাই, নারকেল দিলেন গরিবদের। বস্ত্রহীনদের শীতবস্ত্র দিলেন। সোমার আগ্রহ নারী স্বাস্থ্য নিয়েও। নারীর স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে বেশ কিছু অনুষ্ঠান করেছেন।

Manual8 Ad Code

সুবজ বিদ্যাবাড়ি
সংগঠনের এক বছর পার হয়েছে। একদিন সকাল ১০টায় আদালতের সামনের রাস্তা ধরে যাচ্ছিলেন। এক বেদে মহিলা পথ আগলে দাঁড়ালেন। তারপর এক রকম জোর করেই সোমার হাত দেখলেন। বললেন বেশ কিছু কথা। তাদের জীবন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন সোমা। জানতে পারলেন, তাদের  নির্ধারিত থাকার জায়গা নেই। ঘুরতি-ফিরতি পেশা। শহরের অলিগলি আর পাড়া-মহল্লা ঘুরে ঘুরে ছোটখাটো ব্যবসা করে। বাসন-কোসন বেচে। শিঙা লাগায়। কেউ কেউ ঝাড়ফুঁকও করে। বলতে গেলে সবাই অক্ষরজ্ঞানহীন।

তাদের বর্ষা কাটে নদীতে ভেসে ভেসে। গ্রীষ্মে উঠে আসে ডাঙায়। ডেরা বাঁধে কোনো চর বা পতিত কোনো মাঠে। এক জায়গায় কিছুদিন থেকে আবার অন্য কোথাও চলে যায়। এভাবেই এক রকম যায় জীবন। বেদেপল্লীর শিশুরা স্কুলে যায় না। স্কুল তাদের বসতি থেকে বেশ দূরে। কোনো বিদ্যালয়ে দিনকয় গেলেও মা-বাবার সঙ্গে অল্প কিছুদিন পরই চলে যেতে হয় অন্য কোথাও। দেখা গেল সেখানে স্কুল নেই। এসব শিশুর জন্য খুব মায়া হলো তাসমিনার। তাদের স্কুলে না যাওয়ার ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছিলেন না। খোঁজ করে বেদেপল্লী ঘুরতে লাগলেন। গেলেন ছাতক, ফেঞ্চুগঞ্জ আর গোলাপগঞ্জে। সব জায়গার বেদেদের চিত্র একই রকম করুণ। বন্ধুদের বললেন, ‘বেদেপল্লীর শিশুদের পড়াব।’ বন্ধুরা দারুণভাবে সাড়া দিলেন। কলেজ হোস্টেল থেকে গোলাপগঞ্জ ২৫ কিলোমিটার। এক বিকেলে গেলেন। কিছু চকোলেট ভরলেন ব্যাগে। প্রথমে দূর থেকে বাচ্চাদের দেখলেন যে খেলায় খুব ব্যস্ত। মার্বেল, ঘুঁটি, ক্রিকেট আর তাস বেশি খেলে তারা। বাচ্চাদের ডেকে চকোলেট দিলেন। এভাবে কয়েক দিন গেল। নিয়ম করেই চকোলেট দিতেন। বেদেপল্লীতে তাঁর নাম হয়ে গেল ‘চকোলেট আপা।’ বাচ্চারা দেখলেই বলত—‘চকোলেট আপা আসছে।’ বাচ্চাদের পড়াশোনার কথা বললেন। অভিভাবকদেরও বোঝালেন। একটি সময় তারা তাঁর কথায় কান দিল। তারপর খোলা আকাশের নিচে বেদেদের তাঁবুর সামনেই ক্লাস শুরু হলো। বাচ্চাদের বিনা মূল্যে বই, খাতা, কলম ও ব্যাগ দিলেন। শওকত আমিন তৌহিদ সাহায্য করেছিলেন সেবার। সোমা বললেন, ‘প্রথমে শিক্ষার্থীরা আসতে চাইত না। ছয় অথবা সাতজন আসত। আমরাই ডেকে ডেকে নিয়ে আসতাম। খেলা থেকে ধরে নিয়ে আসতাম। প্রতি ক্লাসে খাবার দিতাম। চকোলেট, সমুচা, শিঙাড়া ইত্যাদি। এভাবে তারা জড়ো হতে শুরু করে। সবুজ বিদ্যাবাড়ি জমে ওঠে।’

Manual2 Ad Code

শুরুতে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস হতো। সোমা ও তাঁর বন্ধুরা এসে ক্লাস নিতেন। এভাবে এক বছর গেল। নিয়মিত শিক্ষার্থী ২৮ জন। মাঝেমধ্যে বেশিও হয়। এখন সপ্তাহে ছয় দিন ক্লাস হয়। দুজন বেতনধারী শিক্ষক আছেন। বেদেপল্লীরই একজন আছেন হুমায়রা নামে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। কখনো কখনো তিনিও পড়ান। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নানা রকম খেলা হয়। অনুষ্ঠান হয়। পুরস্কার বিতরণ চলে। ওদের নিয়ে ঘুরতেও যান সোমা।

Manual8 Ad Code

সবুজ বিদ্যাবাড়ির ঘর
শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আসছে। পড়াশোনা ভালো হচ্ছে। কিন্তু দেখা যায়, কড়া রোদ বা বৃষ্টিতে খোলা মাঠে অসুবিধা হয়। স্কুল ছুটি দিয়ে দিতে হয়। তাই আবার সভায় বসলেন বন্ধুদের নিয়ে। সাড়া পেলেন। জায়গা ভাড়া নিলেন। ঘর করার জন্য টাকা দিল জিবি অনলাইন টেলিভিশন ও রোটারি ক্লাব অব সিলেট। একচালা টিনের ঘর উঠল। বেড়ায় লাগালেন কিছু টিন আর ফেস্টুন। বাচ্চাদের স্কুল হলো। এখন তারা ঘরের ভেতর পড়াশোনা করে। ‘তাদের জন্য ঘর করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। ভয় লাগে, কখন জানি বাচ্চাদের মা-বাবারা এই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। তাদের তো আর নির্ধারিত ঘর নেই। তবে আমি সব সময় বেদেদের জন্য কাজ করব। সেটা দেশের যেখানেই হোক।’ বললেন তাসমিনা খান সোমা।

পরিবার তাঁকে ভালোবাসে
ছোট ভাই তানভীর আহমদ আছে সোমার পাশে। সব রকম সাহায্য তাঁকে দিয়ে যাচ্ছে। বাবা বিদ্যাবাড়িটি দেখে গেছেন। দোয়া করেছেন। সোমার জীবনে মায়ের প্রভাব অনেক। ছোটবেলায় দেখতেন, সবার শেষে মা খেতে বসছেন। এমন সময় দরজায় ভিক্ষুক হাজির। মা না খেয়ে তাদের খাইয়েছেন। বললেন, ‘আমি জীবনে দেখি নাই, আমাদের বাসা থেকে কোনো ভিক্ষুক খালি হাতে বিদায় নিয়েছে। প্রতিবেশীদেরও মা অনেক ভালোবাসেন। আত্মীয়দের যত্ন করেন। মায়ের কাছ থেকে মানবতার অনেক পাঠ নিয়েছি।’

Manual8 Ad Code

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..