সিলেট ৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৬ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি
প্রকাশিত: ১:১২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩১, ২০১৯
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য শারমীন মুরশিদ বলেন, বাউলীখাল নদীর উৎসমুখে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সে নদীকে হত্যার আয়োজন করা হয়েছে। অবৈধ এ বাঁধের প্রভাবে নদী ভাঙ্গন তীব্র রূপ ধারণ করছে, নদী গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের বসতবাড়ী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্ষেত-খামার। নদী-নালা, খাল-বিল-হাওর-বাওর-বিলের প্রাণ, পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে। বদলে যাচ্ছে ভূপ্রকৃতি ও জীব বৈচিত্র্য। অবিলম্বে এ অবৈধ বাঁধ অপসারণ করতে হবে।
শারমীন মুরশিদ আরও বলেন, একটি প্রাণবন্ত নদীর উৎসমুখে বাঁধ নির্মাণ কেবলমাত্র বে-আইনি নয়, এটি একটি অপরাধও। জনগণের করের টাকা দিয়ে নদী হত্যা কিছুতেই বরদাস্ত করা হবেনা। বর্তমান সরকার নদী খেকো ও ধ্বংসকারীদের তালিকা তৈরি করছে । নদী খেকোদের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করছে। নদী দখল, দূষণ ও ভরাটের কাজে যারা লিপ্ত তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেনো, তাদের বিরুদ্ধে জাতীয নদী রক্ষা কমিশন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তিনি স্থানীয় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পরিবেশ ও প্রকৃতির দিকটির প্রতি যতœবান হওয়ারও আহŸান জানান। ৩০ আগষ্ট শুক্রবার বিকাল ৩টায় নদী ও পরিবেশ বিষয়ক এক গণজমায়েতে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সারি নদী বাঁচাও আন্দোলন, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ ও স্থানীয় এলাকাবাসীর উদ্যোগে জৈন্তাপুর উপজেলার ৪নং বাংলাবাজারে রাংপানি নদীর তীরে গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। সারি নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আব্দুল হাই আল-হাদীর সঞ্চালনায় ও জৈন্তাপুর ইউপি’র চেয়ারম্যান মোঃ এখলাছুর রহমান‘র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক শরীফ জামিল। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ, বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম, ৩নং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফুর রহমান লেবু, চারিকাটা ইউপি‘র চেয়ারম্যান শাহ আলম চৌধুরী তোফায়েল, অধ্যাপক মনোজ কুমার সেন, সাংবাদিক ছামির মাহমুদ, বাপা হবিগঞ্জের সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল, গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবের সদস্য মিনহাজ উদ্দিন, জৈন্তাপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড জৈন্তাপুর শাখার সহ-সভাপতি আব্দুল কাদির, ইউপি সদস্য আবুল হাসানাত, বিলাল আহমদ। কর্মসূচীতে আরও উপস্থিত ছিলেন, জৈন্তাপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার হাজী মোঃ আনোয়ার হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা যাদবময় বিশ্বাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাব আলী, জৈন্তাপুর প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আবুল হোসেন মোঃ হানিফ, সাবেক অর্থসম্পাদক গোলাম সরওয়ার বেলাল, জৈন্তাপুর অনলাইন প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক মোঃ রেজওয়ান করিম সাব্বির, গোয়াইনঘাটে কর্মরত সাংবাদিক মিনহাজ মির্জা, ইলিয়াস আকরাম, মনসুর প্রমূখ। কর্মসূচীতে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার সহ¯্রাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, হিদাইরখাল কোন ছড়া নয়, নয় কোন মানবসৃষ্ট ছোট খাল। আবহমানকাল থেকে চলা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট প্রাণবন্ত প্রমত্তা এক নদী হচ্ছে হিদাইরখাল। এ বাঁধের কারণে প্রায় ৩৪ টি হাওর, ৩৫ টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ ও প্রায় ১০ টির মতো ছোট-বড় নদী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ বাঁধের কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত দু’টি প্রকল্পও হুমকির মুখে পড়েছে। এটি প্রকৃতির উপর এক মারাত্বক নিপীড়ণ বৈ কিছু নয়। স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের ব্যক্তিস্বার্থে নির্মিত এ বাঁধ অবিলম্বে অপসারণ সেখানে একটি সেতু নির্মাণের জন্য সরকারের প্রতি আহŸান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এডভোকেট এমাদ উল্ল্যাহ শহীদুর ইসলাম বলেন, যে কোন প্রাকৃতিক নদীতে বাঁধ দেওয়া বাংলাদেশ পানি আইন-২০১৩ এর ২০(১) ও (২) ধারার স্পষ্ট লঙ্ঘন। বর্তমান সরকার এদেশের নদী, প্রাণ ও প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করেছেন, প্রণয়ন করা হয়েছে ’ডেল্টা প্ল্যান’। হিদাইরখাল বাঁধ বর্তমান সরকারের এসব আন্তরিক প্রয়াসের সম্পূর্ণ উল্টো যা স্থানীয় কিছু মানুষ ব্যক্তি স্বার্থে করেছে। এছাড়া এটি উন্মুক্ত জলাধার আইন ও পরিবেশ আইনের দৃষ্টিতেও অবৈধ।
গণজমায়েতে বক্তারা বলেন, বিতর্কিত ও অপরিকল্পিত হিদাইরখাল বাঁধের কারণে উত্তর-পুর্ব সিলেটের প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ভয়াবহ হুমকীর মুখে পড়েছে। এ বাঁধের কারণে শুধু কৃষি আবাদ কিংবা যাতায়াত ব্যবস্থাই ধ্বংস হচ্ছেনা, পুরো এলাকা মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের সানকীভাঙ্গা হাওর, আসামপাড়া, আসামপাড়া হাওর, চৈলাখেল ৯ম খন্ড, চৈলাখেল ৮ম খন্ড, বাউরভাগ হাওর, নয়াগাঙ্গেরপার(একাংশ), আলীরগাঁও ইউনিয়নের কাকুনাখাই খলা, রাজবাড়ীকান্দি, বুধিগাঁও হাওর, নাইন্দা হাওর, তিতকুল্লী হাওর, লাম্বাডুবা হাওর, বালির হাওর এবং জৈন্তাপুর উপজেলার বিড়াখাই, হাটিরগ্রাম, গাথি, ডুল্টিরপার, চাতলারপার, শেওলারটুক, মল্লিফৌদ, কান্দি, বাউরভাগ, ভিত্রিখেল, গুফরাজান, খাড়ুবিল, ববরবন্দ, লামনীগ্রাম, কাকুনানাইখলা, কাটাখালসহ দুই উপজেলার শতাধিক গ্রামের অগণিত রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, প্রতিষ্ঠান, গোরস্তান, শ্মশান ইত্যাদি রক্ষা করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। অর্ধশতাধিক বছর আগে নির্মিত পুরনো পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধসহ এ অঞ্চলের অগণিত ফুটব্রিজ, রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গিয়ে বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। হিদাইর খালের ভয়াবহতার কারণে এ অঞ্চলের মানুষজন কৃষি আবাদ, যাতায়াত এবং গৃহপালিত গবাদি পশু পালনে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
গণজমায়েত কর্মসূচীতে বক্তারা আরও বলেন, উত্তর-পূর্ব সিলেটের পানির মূল প্রবাহ হচ্ছে সারি-ডাউকী-পিয়াইন নদী। মেঘালয়ের পাহাড়ী পানি এসব নদী দিয়েই প্রবাহিত হয়। সাধারণত: পাহাড়ি ঢল নেমে আসলে ঘণ্টা দু’এক কিংবা দু’একদিন অবস্থান করে সে পানি নেমে যেত। কিন্তু হিদাইরখাল বাঁধ তৈরির ফলে এখন সারি ও তার শাখা-প্রশাখার পানির উচ্চতা অনেক বৃদ্ধি পায় এবং নিষ্কাষণের পথ বন্ধ হওয়াতে সেই পানির স্থায়িত্বকাল অনেক বেড়ে গেছে। সহজে নামতে না পারার কারণে তা নদীর পারের মাটিকে নরম করছে এবং চাপ বৃদ্ধি করছে যার কারণে তা জনপদকে বিলীন করতে শুরু করছে। ৩৫ বছর পুরনো পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত জাফলং-সানকীভাঙ্গা বেড়িবাঁধ-কাম-রাস্তা বিভিন্ন স্থানে পানি ফুলে ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে। স্থানে স্থানে বড় বড় গর্ত, খানাখন্দ অবস্থা সৃষ্টি হওয়াতে জনসাধারণ, যানবাহন চলাচলে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। হাওরের মানুষজন উদ্বাস্তু হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বক্তারা একইসাথে সারি নদী, বড়গাঙ্গসহ সকল নদ-নদীর দখল,দূষণ, ভরাট ও নব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের উপর জোর দেন।
Sharing is caring!


………………………..

Design and developed by best-bd