শেষ হচ্ছে জীবন যুদ্ধে এক লড়াকু সৈনিকের বিশ্বকাপ

প্রকাশিত: ৫:২৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ৫, ২০১৯

শেষ হচ্ছে জীবন যুদ্ধে এক লড়াকু সৈনিকের বিশ্বকাপ

Manual6 Ad Code

২০০১ সাল। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মুখোমুখি বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ে। টস জিতে প্রথমে ব্যাট করতে আসলো সফরকারীরা। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ওভারটি করতে আসলেন হালকা-পাতলা গড়নের লম্বা একটি ছেলে। কলারটা উচিঁয়ে লাল-সবুজের জার্সিতে নিজের প্রথম ওভারটা করলেন মেইডেন।

ইনিংসের তৃতীয় ওভারে নিজের দ্বিতীয় ওভারটি করতে আবারো আসলেন সেই ছেলেটি। এই ওভারে প্রথম দুই বলও দিলেন ডট। তৃতীয় বলটাও; কিন্তু এই বলে ঘটলো আরো একটি ঘটনা। হালকা-পাতলা গড়নের সেই ছেলেটির বলের গতিতে পরাস্ত গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে প্রথম রান দেওয়ার আগেই পেয়ে গেলেন প্রথম উইকেট।

সেই ছেলেটির নাম মাশরাফি বিন মর্তুজা কৌশিক। নড়াইলের মফস্বলে কৌশিক নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত তিনি। যে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। তাতে নিজের ডানা মেলে সাতঁরে বেড়ানো আর বাউন্ডুলেপনাই ছিল যার নিত্য কাজ, সেই কৌশিক।

বেশিদিন আর কৌশিক নামে পরিচিত ছিলেন না। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার পর থেকে ধীরে ধীরে কৌশিক নামটার ওপর একটা ছায়া পড়ে গেছে। মূল নাম, মাশরাফিতেই পরিচিত হয়ে উঠলেন। শুধু তাই নয়, একটা সময়ে হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমার্থক শব্দ। হয়ে উঠলেন লড়াকু আর সাহসী এক ক্রিকেটার। সেখান থেকে একজন অধিনায়ক, ‘মাশরাফি বিন মর্তুজা’। যার জীবন থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে নিতে পারেন বাংলাদেশের তরুণ-কিশোররা।

Manual6 Ad Code

বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বটা প্রথমবার পেয়েছিলেন ২০০৯ সালে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং জিম্বাবুয়ে সিরিজের জন্য। বিধাতার পরীক্ষায় প্রথম ম্যাচেই পড়ে গেলেন ইনজুরিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্টের শেষ দিনে হাঁটুর ইনজুরির কারণে মাঠেই নামতে পারেননি। সাকিবের কাছে নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে হয়।

২০১০ সালে ইনজুরি থেকে ফিরে আসেন মাশরাফি। তবে নানা ঘটনার পর অবশেষে ইংল্যান্ড সফরে ওয়ানডেতে নেতৃত্ব ফিরে পান তিনি এবং তার নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রিস্টলে ঐতিহাসিক জয় পায় বাংলাদেশ। ২ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি, সঙ্গে ব্যাট হাতে করেছিলেন ২২ রান। ম্যাচ সেরার পুরস্কারও উঠেছিল তার হাতে। এরপর আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ ব্যবধানে সিরিজ ড্র করলেও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ১ ম্যাচের সিরিজটি হেরে আসে বাংলাদেশ।

ঘরের মাঠে অক্টোবরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। সেই সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ইনজুরির থাবা। গোড়ালির ইনজুরিতে প্রথম ম্যাচ থেকেই ছিটকে পড়লেন দলের বাইরে। আবারও নেতৃত্ব ছেড়ে দিলেন সাকিবের কাঁধে।

Manual8 Ad Code

চার বছর পর আবারও মাশরাফির কাঁধে উঠলো নেতৃত্বের ভার। ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টির নেতৃত্বের জন্য ঘোষণা করা হয় মাশরাফির নাম। তবে অধিনায়ক হিসেবে তার পুনঃযাত্রা শুরু হলো ২০১৪ সালের নভেম্বর জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে। যার আগে ওই বছর খেলা ১৩ ম্যাচের কোনোটিতেই জিততে পারেনি টাইগাররা। বিধ্বস্ত এক দলের দায়িত্ব উঠলো ইনজুরিতে বিধ্বস্ত আরেক ক্রিকেটারের কাঁধে।

তিনি হতাশ করলেন না। জন্ম দিলেন রূপকথার। ভাঙাচোরা আর বিধ্বস্ত একটি দলকে দেখাতে শুরু করলেন বড় স্বপ্ন। জিম্বাবুয়েকে ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে গেলেন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে। সেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো দলকে পৌঁছে দিলেন নক আউট পর্ব, কোয়ার্টার ফাইনালে।

বিপর্যস্ত আর বিধ্বস্ত একটা দলকে ঘরের মাঠে ওয়ানডেতে পরিণত করলেন অপ্রতিরোধ্য এক দলে। প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ হারালেন দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও পাকিস্তানকে। এরপর দলকে নিয়ে খেলালেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালও।

Manual8 Ad Code

তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে খেলেছে ৮৪ ওয়ানডে। যার ৪৭ টিতেই জিতেছে, হেরেছে ৩৫টিতে। শতাংশের হিসাবে যা ৫৭.৩১। বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে খেলেছেন ১২ ম্যাচ (ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ পর্যন্ত)। যাতে জয়, পরাজয় সমান ৬টি করে।

Manual7 Ad Code

বয়স ৩৫ পেরিয়েছে আগেই। শরীরও আগের মতো আর সায় দেয় না। ৭ বার তার পাঁয়ের উপর দিয়ে যে ছুরি-কাঁচি চালিয়েছেন ডাক্তাররা, সে ভারই তো সহ্য করার কথা নয়। তিনি তা পেরেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্যারিয়ারের মালিকও হয়েছেন।

কিন্তু সব কিছুরই তো শেষ আছে। তারও। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই জানিয়েছিলেন, এটাই তার শেষ বিশ্বকাপ। ভারতের বিপক্ষে হারের পরই নিশ্চিত হয়েছে পাকিস্তানের বিপক্ষেই এবার বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ খেলতে নামবে বাংলাদেশ, সঙ্গে শেষ ম্যাচ মাশরাফিরও।

আজই সেই ম্যাচটি খেলতে মাঠে নামছে টাইগাররা। সঙ্গে শেষ হবে জীবন যুদ্ধের এক লড়াকু সৈনিকের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারও। ২৩ ম্যাচে ১৯ উইকেটের বিশ্বকাপের অনুজ্জল ক্যারিয়ারের ইতিটা আজই টেনে দেবেন মাশরাফি। লর্ডসে।

নিজের ভাঙা পাঁ নিয়ে ভাঙাচোরা একটা দলকে বানিয়েছেন বিশ্বমঞ্চের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে। হয়ে উঠেছে ঘরের মাঠের অপ্রতিরোধ্য একটি দলে। ক্রিকেটার মাশরাফি বাদ থাকুক। খেলোয়াড় কিংবা অধিনায়ক মাশরাফি বাদ থাকুক, বিশ্বকাপের অধিনায়ক মাশরাফিকে কৃতজ্ঞতাবোধ জানালে তাতেও ভুলের কিছু নেই নিশ্চয়ই। ধন্যবাদ অধিনায়ক মাশরাফি।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..