সিলেটিদের উপস্থিতিতে ওভাল নয়, এটাই যেন বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২:১৪ পূর্বাহ্ণ, জুন ৩, ২০১৯

সিলেটিদের উপস্থিতিতে ওভাল নয়, এটাই যেন বাংলাদেশ

একসময় ছিল যখন সবাই আগ্রহ প্রকাশ করতো না বাংলাদেশের খেলা নিয়ে। কারণ ফলাফল সবার জানা ছিল যে বাংলাদেশ বলিং ব্যাটিং ভালো না। বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশের খেলার অগ্রগতি দেখে কুপোকাত পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। বাংলাদেশকেও সবাই হিসেবে নিয়ে আসে। সকাল থেকেই ওভালের মাঠে বাংলাদেশের সমর্থকদের দাপটে কোণঠাসা প্রোটিয়া দর্শকরা। টসে হারলেও ব্যাট করতে নেমে মাঠেও দাপট দেখাতে শুরু করলো বাংলাদেশ দল। ব্যাটে যত ঝড় উঠছে গ্যালারি ততোই ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠছে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপেই নিজেদের সর্বোচ্চ ওয়ানডে স্কোর ৩৩০ রান তুলতে খরচ হয়েছে মাত্র ৬ উইকেট। এমন ব্যাটিং দাপটে যেন কোনঠাসা দক্ষিণ আফ্রিকা। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তান উপমহাদেশের তিন দল বিশ্বকাপ শুরু করেছে ব্যাটিং বিপর্যয়ে। তাই টাইগারভক্তদের মনে ছিল ভয় আর শঙ্কা। তবে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ, সৌম্য সরকাররা সেই ভয় উড়িয়ে সমর্থকদের দিয়েছেন দারুণ ব্যাটিংয়ে ঈদ উপহার। মাঠে আসা লন্ডন প্রবাসী দর্শকরাও তেমনই বলছিলেন। ওহ! বলে রাখা ভালো আর একদিন পরেই হতে পারে ইংল্যান্ডে প্রবাসী মুসলিমদের জন্য ঈদের দিন। তবে যাই হোক ঈদের আগে টাইগাররা তাদের উপহার দিয়েছে বলেই জানালেন বেশ কয়েকজন ভক্ত। এর আগে বাংলাদেশ দলের সর্বোচ্চ ৩২৯ রানের ইনিংসটি ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। সকালে টসে হেরে ব্যাট করতে নামার সময় বাউন্সারের ভয় ছড়িয়ে গিয়েছিল দর্শকদের মাঝেও। শুরু থেকেই পাওয়ার প্লে দারুণ কাজে লাগিয়েছেন তামিম ও সৌম্য, দুজনের ওপেনিং জুটিতে এসেছে ৬০ রান ৫০ বলে। দু’জন এগিয়ে যাচ্ছিলেন অন্তত সতর্কতার সঙ্গে। যেমনটা এই উইকেটে ব্যাটিংয়ের প্রয়োজন সেটাই করছিলেন তারা। আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মাশরাফি বলেছিলেন ইংল্যান্ডের উইকেটে তিনশ করতে হলে হতে হবে ভীষণ সতর্ক। দুই ওপেনার যেন অধিনায়কের কথাই পালন করছিলেন। অবশ্য ম্যাচের পঞ্চম ওভারের শেষ বলে লুঙ্গি এনগিডির বলে স্লিপে কোনোভাবে বেঁচে যাওয়া সৌম্য এগোচ্ছিলেন ইতিবাচক ব্যাটিংয়ে। কিন্তু হঠাৎ করেই ছন্দপতন। দলের ৬০ রানের সময় আউট হলেন ব্যাটিং ভরসা তামিম ইকবাল। হঠাৎ ম্যাচের দু’দিন আগে ইনজুরিতে পড়েছিলেন হাতে বলের আঘাত লেগে। শঙ্কা ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে একাদশে থাকায় স্বতি ফেরে সবার মাঝে। তবে এদিন ২৯ বলে ১৬ করে আউট হন তিনি। এই আঘাত সামাল দিতে সৌম্যকে সঙ্গ দিতে আসেন সহঅধিনায়ক সাকিব আল হাসান। তবে প্রোটিয়ারা হয়তো জানতেন বাংলাদেশের পুরানো রোগটা। একজন আউট হলেই পরের জন সেই পথ ধরে। তাই দ্বিতীয় শিকার পেতে বেশি সময় লাগলো না তাদের। এবার আউট হলেন রিভিউ নিয়ে বেঁচে যাওয়া সৌম্য সরকার। আগে থেকেই জানা ছিল, শর্ট বল হবে দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। সেই অস্ত্রেই ক্রিস মরিসের বলে জীবন দিলেন ৩০ বলে ৪২ রান করা সৌম্য। তবে যাওয়ার আগে দলকে পাওয়ার প্লেতে বড় স্কোরের পথ করে দেন সৌম্য। দলীয় ৭৫ রানে দুই ওপেনার ফিরে যাওয়ার পর মুশফিকুর রহীমকে নিয়ে দলের হাল ধরেন সাকিব। ২০১৫ বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ভীষণ চাপে ১১৪ রানে অসাধারণ এক জুটি গড়েছিলেন এ দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। অন্যদিকে সাকিব বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ফিফটি করার রেকর্ড ধরে রেখেছেন এ ম্যাচেও। ২০০৭, ২০১১, ২০১৫ প্রতিটি আসরে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ফিফটি এসেছে তার ব্যাট থেকে। দলের বিপদ সামলে তৃৃতীয় উইকেটে ১৪২ রানের জুটি গড়েছেন তারা। যেকোনো উইকেটে বিশ্বকাপে এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এখানেই থামলেন তারা। স্কয়ার লেগ ফাঁকা দেখে সুইপ করতে গিয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু ইমরান তাহিরে বলের লেংথ সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে হলেন বোল্ড। সেই সঙ্গে ৮৪ বলে ৭৫ রানের সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগানো ইনিংসটি থামে। এবারও যেন ফের সাকিবের জুড়ি বাধলেন মুশফিক। নিজের ৭৮ রানের সময় মুশফিক ক্যাচ তুলে দিলেন আন্দিলে ফিকোয়াওর শর্ট বল চালাতে গিয়ে। খুব দ্রুততম সময়ে অকাল মৃত্যু হয় জোড়া সেঞ্চুরির সম্ভাবনার। তাদের সঙ্গে সাজঘরের পথ ধরেন ২১ রান করা মোহাম্মদ মিঠুনও। দারুণ খেলতে খেলতে ফের পথ হারায় টাইগাররা। দলীয় ২৪২ রানে হারায় ৫ম উইকেট। সেখান থেকে দলের হাল ধরেন অভিজ্ঞ মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও তরুণ মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। তাদের দুজনের দারুণ ব্যাটিংয়ে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে আসে ৬৬ রান। এ জুটিটাই বাংলাদেশকে এনে দেয় ৩৩০ রানের স্কোর। শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশের স্কোর বোর্ডে যোগ হয় ৮৬ রান। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ইনিংসটি এত দিন ছিল স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। ২০১৫ বিশ্বকাপে নেলসনে ওই ম্যাচে বাংলাদেশ করেছিল ৩২২ রান।

সিলেটিদের উপস্থিতিতে ওভাল নয়, এটাই যেন বাংলাদেশ : সিলেটকে দ্বিতীয় ইংল্যান্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ হলো সিলেটের বেশি সংখ্যক লোক বিদেশ যেতে হলে ইংল্যান্ডকেই বেছে নেয়। হোক চাকরি, ভিজিট বা পড়ালেখা। শুধু তাই নয় ওই দেশের রাজনীতিতেও সিলেটিরা একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছেন। কেউ ছুটছেন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে। কেউ ছুটছেন সাকিব সাকিব বলে। গ্যালারি তামিম, সৌম্য, মুশফিক ধ্বনিতে প্রকম্পিত। লন্ডন নাকি বাংলাদেশ? কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে লন্ডনের ওভাল স্টেডিয়ামে খেলা হচ্ছে। মনে হওয়ার কথাও না। গতকাল সকালে স্টেডিয়ামে ঢোকার আগেই শোনা গেলো সব টিকিট শেষ। বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। যার বেশির ভাগই কিনে নিয়েছেন ইংল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশকে সমর্থন দিতে ছুটে এসেছেন মাঠে। কারো হাতে পতাকা। কারো হাতে বাঘ। কেউবা পড়েছেন বাঘের পোশাক। খেলা শুরু হতেই গোটা ওভালই চলে গেলো টাইগার সমর্থকদের দখলে। মাঠেই দেখা হলো সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমনের সঙ্গে। ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয় এসেছিল তার হাত ধরেই। আজ ফের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে টাইগারদের প্রথম প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা। এতো সমর্থক দেখে সুমন বলেন, ‘সত্যি অভিভূত। আমরা জানতাম এখানে বাংলাদেশের সমর্থন পাবো। তবে এতটা পাবো ভাবিনি। দেখে মনে হচ্ছে এটাই বাংলাদেশ।’ অন্যদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক কাজী এনাম আহমেদও এসেছেন বাংলাদেশের খেলা দেখতে। তিনি বিসিবি পরিচালকের চেয়ে দেশের ক্রিকেটের সমর্থক ও ভক্ত হিসেবে এসেছেন বলেই জানালেন। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের দারুণ ভক্ত। আমার বিসিবি পরিচালক পরিচয় পরে। আমি অবশ্য চাই আজ বাংলাদেশ দারুণ খেলে শুরু করুক। যেন এখানে এত কষ্ট করে আসা দর্শকরা খুশি মনে বাসায় ফিরতে পারেন।’ এছাড়াও ম্যাচ নিয়ে হাবিবুল বাশার বলেন, ‘২০০৭ এ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা দল। সেখানেই আমরা জিতেছি। আর ক্রিকেট এমন যে এখানে একটি নির্দিষ্ট দিন নিয়ে কিছুই বলা যায় না। বাংলাদেশ দল এখন অনেক বেশি শক্তিশালী।

লন্ডনে স্থানীয় সময় সকাল ৭টা থেকেই বাংলাদেশের পতাকা হাতে মানুষের ভিড়। ট্রেন, বাস যার যেভাবে সম্ভব সবারই গন্তব্য ওভাল স্টেডিয়াম। বেশির ভাগ টাইগারভক্তের দেখা মিললো ট্রেনে। এর মধ্যে, ফরহাদ, সুজন, সুমন, হাবিব, মিরাজ ছুটছিলেন মাঠের দিকে। বাংলাদেশের সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে বললেন, গাড়িতে নয়, ট্রেনে চলেন দেখবেন কত দর্শক মাঠে যাচ্ছে। তাদের পিছনে পিছনে যাত্রা শুরু পাতাল ট্রেনে। সেখানে উঠেও ভিমড়ি খাওয়ার মত অবস্থা। প্রায় সব সিটই দখল করে আছে লাল সবুজ জার্সি পড়া টাইগারভক্তরা। ট্রেনে এমন লাল সবুজের মিছিল দেখে খাটি ইংলিশরাও ভীষণ খুশি। বার বার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের জন্য সবাইকে শুভকামনা জানাচ্ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, ‘আশা করি বাংলাদেশ আজ জিতবে।’ লন্ডনে দীর্ঘদিন বসবাস করা মোস্তাফিজুর রহমান রকি ম্যাচ দেখে ভীষণ খুশি। বিশেষ করে মুশফিকুর ও সাকিব আল হাসানের ব্যাটিং দেখে তিনি বলেন, ‘আমাদের কষ্ট করে আসাটা সার্থক। সাকিব-মুশফিক দারুণ ব্যাট করছে।’ গতকাল লন্ডনে ছিল ছুটির দিন। আর বেশির ভাগ টাইগার সমর্থকই এসেছেন পরিবার নিয়ে। এছাড়াও পাওয়া গেলো এখানে পড়তে আসা বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে। তাদের মধ্যে ফারহা বলেন, ‘আমি এখানে এক বছর হলো পড়তে এসেছি। যখন শুনলাম বাংলাদেশ এখানে খেলবে তখন থেকেই টিকিট সংগ্রহ করতে শুরু করি। আমরা চাই বাংলাদেশ দল ফাইনালে খেলুক।’

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..