সিলেট ৯ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৩ই মহর্রম, ১৪৪৭ হিজরি
প্রকাশিত: ১১:৩৬ অপরাহ্ণ, মে ১৮, ২০১৯
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ বিশ্বনাথের রেদওয়ানুল ইসলাম খোকনকে (২৬) মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে নৌকায় উঠতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার। এ ঘটনায় দালাল রফিকুল ইসলাম (৫০)সহ ৫ জনের নামোল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরো ১০/১১ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে দালাল রফিক সপরিবারে আত্মগোপনে চলে গেছে।
খোকনের পরিবারের সদস্যরা জানান, দালালচক্র মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া নিয়ে যায় তাক। সেখানে খোকনসহ অন্যান্য যুবকদেরকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয় এবং ইতালি পাঠাতে খোকন ও তার সহযাত্রীদের নৌকায় উঠতে বাধ্য করে সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সরেজমিনে উপজেলার নওধার মাঝপাড়া গ্রামে রেদওয়ানুল ইসলাম খোকনের বাড়িতে গেলে সংবাদকর্মীদের এমন অভিযোগ করেন খোকনের পিতা-মাতা।
যেভাবে লিবিয়া যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয়ঃ
বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের নওধার গ্রামের ইলিয়াস আলী ও জোছনা বেগম দম্পতির ছোট ছেলে রেদওয়ানুল ইসলাম খোকন। সে সিলেট সরকারি কলেজে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। নওধার গ্রামের পার্শ্ববর্তী বৈরাগীবাজারে খোকনের বড় ভাই রেজাউল ইসলাম রাজুর ‘ফিজা এন্ড কোম্পানি’ নামে একটি ব্যবসা রয়েছে। যেখানে খোকন ও তার বাবা বেশিরভাগ সময়ই বসতেন। প্রায় ৬ মাস আগে বৈরাগীবাজারের পার্শ্ববর্তী কাঠলীপাড়া গ্রামের চমক আলীর ছেলে আদম ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম রফিক তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ইতালি পাঠানোর সুবর্ণ সুযোগের কথা বলেন। আর এতে খোকন রাজি হয়ে গেলে পরিবারের সকলেই টাকার জন্য হিমশিম খান। একপর্যায়ে দালাল রফিকের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বমোট সাড়ে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে খোকনকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন তার পরিবার।
কথা রাখেনি দালালরা :
সাড়ে ৫ লাখ টাকায় বাংলাদেশ থেকে বিমানে লিবিয়া, সেখান থেকে এক মাসের মধ্যে আরো আড়াই লাখ টাকায় জাহাজে করে এবং লিবিয়ার সেনাবাহিনীর হেলিকাপ্টারের প্রহরায় খোকনকে ইতালি পৌঁছানোর কথা হয় দালাল রফিকের সঙ্গে খোকনের বাবা-মার। ছেলেকে ইউরোপ পাঠানোর আশায় খোকনের পিতা ইলিয়াস আলী বৈরাগীবাজারস্থ তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ফিজা এন্ড কোম্পানি’র নামে ব্রাক ব্যাংক বিশ্বনাথ শাখা থেকে ৮ লাখ টাকা লোন উত্তোলন করেন। এরপর সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রায় ৬ মাস আগে খোকনকে লিবিয়া পাঠাতে উত্তোলনকৃত লোনের টাকা থেকে প্রথমে সাড়ে ৫ লাখ টাকা দালাল রফিককে প্রদান করেন ইলিয়াস আলী। গত নভেম্বর মাসের শেষের দিকে খোকনকে লিবিয়া পাঠায় দালাল রফিক। কথা ছিল লিবিয়া পৌঁছার পর এক মাসের মধ্যে সেখান থেকে ইতালি পৌঁছানো হবে তাকে এবং ইতালি পৌঁছার পর চুক্তির বাকি আড়াই লাখ দেওয়া হবে। কিন্তু, লিবিয়া পৌঁছার এক সপ্তাহের মধ্যে চুক্তির বাকি টাকা সহ মোট ৮লাখ ২০হাজার টাকা খোকনের পরিবারকে চাপ দিয়ে আদায় করে নেয় দালালচক্র।
লিবিয়ায় গেইম ঘরে যেভাবে রাখা হয় :
৮ লাখ টাকা আদায়ের পর গেইম ঘর নামক একটি তালাবদ্ধ ঘরে বিশ্বনাথে শিমুলতলা গ্রামের ইর্শাদ আলী মাস্টারের পুত্র দিলাল মিয়া, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদের ছোট ভাই আহসান হাবিব শামীম, তার শ্যালক গোলাপগঞ্জের কামরান আহমদ মারুফ, ফেঞ্চুগঞ্জের বিলাল সহ অন্যান্য যুবকদের সাথে রাখা হয় রেদওয়ানুল ইসলাম খোকনকে। ওই ছোট্ট ঘরে শতাধিক লোককে রাখা হয়। একটি টয়লেট থাকায় অনেক কষ্ট হয় তাদের। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলে, খাবার-গোসল ছাড়া পরনের কাপড় পড়ে থাকতে হয় তাদেরকে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সাথে কথা হলে খোকন জানিয়েছিলেন- তাদেরকে তালাবদ্ধ ঘরে অনাহারে রাখা হয়। প্রতিদিন একবার মাত্র একটি করে রুটি দেওয়া হতো। কেউ খাবারের জন্য এক বারের পর দুই বার কল করলে শাস্তি স্বরূপ সবাইকে ৭২ ঘণ্টা পর খাবার দেওয়া হতো। একজন মাত্র ১০ মিনিট শুয়ে থাকার পর, অন্যজনকে শুবার সুযোগ দিয়ে ৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তাদের এভাবেই চলে গত ১১ মে পর্যন্ত টানা ৫ মাস।
টাকা আদায়ে দালালের কৌশল :
খোকনকে গেইম ঘরে আটকে রাখার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে খাবারের জন্য বাড়ি থেকে বিকাশের মাধ্যমে ৩ হাজার টাকা দালালকে দেওয়া হতো। তাও এই তিন হাজার টাকা থেকে খোকন পেতেন মাত্র ৩শত টাকা। লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রার এক সপ্তাহ পূর্বে বাড়িতে বড় ভাই রেজাউল ইসলাম রাজুর কাছে ফোন করেন খোকন। এ সময় শেষ বারের মতো ৩ হাজার টাকা পাঠাতে বলেন খোকন।
খোকনের বাঁচার আকুতি :
গেইম ঘরে যখন দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম তখন বাড়িতে ফোন করে মায়ের কাছে বাঁচার আকুতি জানান খোকন। গেইম ঘর থেকে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে বলেন। এরপর খোকনকে গেইম ঘর থেকে ছেড়ে দিতে অথবা দেশে ফেরত পাঠাতে দালাল রফিককে বলেন খোকনের পরিবার। তখন দালাল রফিক তাদেরকে বলে গেইম ঘর থেকে মুক্ত করতে আরো ৮ লাখ টাকা দিতে হবে। কিন্তু, এই টাকা দেওয়া তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয়নি। তাই গেম ঘরে থাকতে হয় খোকনকে। এরপর গত ১১ মে অন্যদের সাথে খোকনকে ইতালি পাঠানোর জন্য গেইম ঘর থেকে সমুদ্রের পাড়ে নেওয়া হয়। নৌকায় উঠার পূর্বে খোকন একটি ভয়েস ম্যাসেজের মাধ্যমে তার ভাইকে জানায়, কিছু সময়ের মধ্যে সে যাত্রা করবে। এরপর থেকে তার সাথে পরিবারের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।
নৌকায় উঠতে বাধ্য করা হয় :
গত ১১ মে তিউনিসিয়ার উপকূলবর্তী ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী নৌকা ডুবির ঘটনার পর থেকে খোকনের জন্য দুশ্চিন্তায় পড়ে পরিবার। নৌকা ডুবিতে নিহত ২৭ বাংলাদেশির পরিচয় বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি প্রকাশ করে। এই তালিকায় বিশ্বনাথের নিখোঁজ খোকনের নাম থাকায় ওই নৌকার যাত্রীর মধ্যে যাদেরকে জীবিত উদ্ধার করা হয় তাদের একজন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বিলাল। একপর্যায়ে বিলালের গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান নিখোঁজ খোকনের পরিবারের লোকজন। এরপর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বেলালের সাথে তাদের কথা হলে বিলাল জানান, তার সঙ্গে একই নৌকার যাত্রী ছিলেন খোকন। তখন বিলাল তাদেরকে দালাল চক্রের লোমহর্ষক কুকর্মের কথাগুলো জানান।
বিলাল জানান- একটি বড় স্টিলের নৌকায় করে লিবিয়া থেকে তিউনিসিয়ার উপকূলবর্তী ভূমধ্যসাগরে নিয়ে যায়। গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে দালালরা অভিবাসীদেরকে একটি ছোট নৌকায় উঠতে বলে। ফলে দু’দিকেই মরণের ভয় দেখে সামান্য বাঁচার আসায় তারা নৌকায় উঠতে বাধ্য হন। এই ছোট নৌকাটি সাথে সাথে ডুবে যেতে শুরু করে। নৌকাডুবিতে প্রায় ৬০ জনের মতো পানিতে ডুবে মারা যায় ও বিলাল সহ ১৬ জনকে সেখান থেকে জীবিত উদ্ধার করে জেলেরা।
এদিকে, সন্তান হারিয়ে নির্বাক খোকনের পিতা-মাতা। পরিবারে চলছে শোকের মাতন। তাদেরকে সান্ত¦না দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা।
সপরিবারে আত্মগোপনে দালাল রফিক :
কাঠলীপাড়া গ্রামের চমক আলীর ছেলে আদম ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম রফিক। সে দীর্ঘদিন ধরে আদম পাচার করে যাচ্ছেন। শুধু রফিকই নয়, তার স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে পিংকি আক্তার, পুত্র পারভেজ ও আব্দুর রহমানও জড়িত রয়েছে আদম পাচারে। গত ১২ মে রাতে খোকনের ভাই রাজুর মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়েছে পিংকি জানায়, খোকনকে ইতালী পৌঁছানো হয়েছে। কিন্তু, ১৩ মে রাতে বাড়ি থেকে দালাল রফিক সপরিবারে পালিয়েছে গেছে। তাদের ব্যবহৃত সকল মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।
দালালদের গ্রেফতার ও ফাঁসি দাবি :
খোকনের পিতা ইলিয়াস আলী ও মাতা জোছনা বেগমের দাবি দালাল রফিকুল ইসলাম চুক্তি ভঙ্গ করে তাদের ছেলেকে সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করেছে। সে জন্য দালাল রফিক ও তার মেয়ে দালাল পিংকি সহ সকল দালালকে গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবি জানান তারা। তাদের মতো এভাবে যাতে আর কোনো মা-বাবাকে তাদের সন্তান হারাতে না হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের প্রতি দাবি জানান তারা।
মামলা দায়ের : রেদওয়ানুল ইসলাম খোককে প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশ পাঠানো ও সে নিখোঁজের ঘটনায় তার বড় ভাই রেজাউল ইসলাম রাজু বাদি হয়ে বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের কাঠলীপাড়া গ্রামের চমক আলীর পুত্র দালাল রফিকুল ইসলাম (৫০) কে প্রধান আসামী করে ৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও আরো ১০/১১জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে বিশ্বনাথ থানায় একটি মামলা দায়ের করছেন। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দায়েরকৃত মামলা নং-৮, তাং- ১৬/০৫/২০১৯ইং। মামলার অন্যান্য অভিযুক্তরা হলেন- দালাল রফিকুল ইসলামের পুত্র বর্তমানে লিবিয়ায় বসবাসকারী পারভেজ আহমদ (২৮), মেয়ে অনন্যা প্রিয়া ওরফে পিংকি, গোলাপগঞ্জ উপজেলার পুনাইরচর গ্রামের আব্দুল খলিলের পুত্র ও সিলেট রাজা ম্যানশনস্থ ইয়াহইয়া ওভারসিজ এর কর্মকর্তা এনামুল হক তালুকদার (৪৫) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার ছোট দেওয়ানপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল জব্বার ভূইয়ার পুত্র আব্দুর রাজ্জাক ভূইয়া (৩৪)।
মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে বিশ্বনাথ থানার ওসি শামসুদ্দোহা পিপিএম বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হবে।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd