সিলেট ৯ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৭ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি
প্রকাশিত: ১০:৪৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৮
সিলেট :: অন্যরকম এক আবৃত্তি অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করলো সিলেটবাসী। ‘বীরাঙ্গনা কথা’ অনুষ্ঠানে হলভর্তি দর্শকদের আবেগে আপ্লুত করলেন প্রবাসে বাংলার মুখ খ্যাত বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীন। অপূর্ব শর্মার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা থেকে আবৃত্তি করে দর্শক-শ্রোতাদের কাঁদালেন তিনি। কাঁদলেন নিজেও। আবেগঘন এই আবৃত্তি সন্ধ্যাটি গত শনিবার নগরের কবি নজরুল অডিটরিয়ামে আয়োজন করে শ্রæতি। তিন পর্বে সাজানো বিজয় দিবসের এই অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিলো প্রামান্যচিত্র প্রদর্শন। ‘রক্তে মুছে গেছে সিথির সিদুর’ শিরোনামের এই প্রমান্যটিতে মুনিরার হৃদয় নিঙরানো উপস্থাপনা শুরুতেই আপ্লুত করে সকলকে। এরপর মঞ্চে যখন প্রবেশ করেন তিনি করতালির মাধ্যমে তাঁকে স্বাগত জানান আবৃত্তিপ্রেমিরা। আবৃত্তি ও পাঠপর্বের সূচনাতে নিজেকে একজন বীরাঙ্গনা ঘোষণা করে মুনিরা শুরু করেন উপস্থাপনা। অডিটরিয়ামে তখন নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। প্রথমেই ‘পাঞ্জাবীর বউ’ শিরোনামে প্রভারাণীর জীবনের করুণ আখ্যান আবৃত্তি করেন। একাত্তরে যুদ্ধ শেষ না হওয়া এই নারীর জীবনের দুর্বিসহ কতকথার পর বড়লেখার দুখিনী সাফিয়ার মর্মবেদনা পাঠ করেন তিনি। সাফিয়াকে দিনের পর দিন ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন এবং একাত্তর পরবর্তী পাঞ্জাবীদের বীজ থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানকে ফেলে দেওয়া এবং সর্বশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার চাইতে গিয়ে রাজাকারদের হুমকি-ধমকির কথা ওঠে আসে তাঁর সাবলীল উপস্থাপনায়। জকিগঞ্জের এশনু বেগমের একাকীত্বের কথা দাগ কাটে উপস্থিত সকলের মনে। অনুষ্ঠানে বীরাঙ্গনা বলছি থেকেও দুটি আখ্যান আবৃত্তি করেন মুনিরা। টানা একঘন্টার আবৃত্তি উপস্থাপনার ইতি টানেন তিনি ‘ফিরে আসেনি ওরা’ গ্রন্থের সিরাজুল আবদালের হারিয়ে যাওয়া কাহিনী দিয়ে। কুতুব উদ্দীনের বাঁশির সুর অশ্রæতআখ্যান পাঠে ভিন্ন এক আবহ তৈরি করে। আবৃত্তির ফাঁকে ফাঁকে রিয়া চক্রবর্তীর দেশাত্ববোধক সংগীত অনুষ্ঠানে যুক্ত করে ভিন্নমাত্রা। আবৃত্তি করতে করতে নিজেও আবেগপ্রবন হয়ে পড়েন মুনিরা। বেশ কয়েকবার চোখের জল মুছতে দেখা যায় তাঁকে। কান্নাভেজা কন্ঠেই তিনি বিবৃত করেন বিভীষিকাময় আখ্যানগুলো। ঘটনাগুলোর সাথে যেনও একাকার হয়ে গিয়েছিলেন প্রখ্যাত এই বাচিক শিল্পী। দর্শক-শ্রোতাদের সামনে তখন ছবির মতো ভেসে ওঠে দুঃসহ সেই সময়।
বিজয়ের মাসে যুদ্ধজয়ী বিজয়িনীদের অবর্ননীয় নির্যাতন, একাত্তরে শেষ না হয়ে যাওয়া যুদ্ধের কথা, তাদের সাথে সামাজিক নিপীড়ন, পারিবারিক অবহেলা আর কটু কথা যন্ত্রনাকাতর করে সমবেতদের। অনুষ্ঠানটি নিজের যেমন প্রথম একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান ছিলো মুনিরা পারভীনের তেমনই সিলেট অঞ্চলেও এ ধারার এটি ছিলো প্রথম অনুষ্ঠান। বিভীষিকাময় একাত্তর যেনও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিলো রিকাবীবাজারে। যার লেখা থেকে পাঠ করা হয়েছে তিনিও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে, যাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে প্রামান্য চিত্র তিনিও প্রত্যক্ষ করেন তা। রণাঙ্গনা, লেখক আর আবৃত্তিশিল্পীর সম্মিলনে অনন্য এক ইতিহাসের সাক্ষি হন এদিন সিলেটের হল ভর্তি দর্শক-শ্রোতা। ফেসবুকের কল্যানে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।
আবৃত্তি পর্ব শেষে বীরাঙ্গনা সন্ধ্যারাণীকে সম্মাননা জানানো হয় শ্রæতির পক্ষ থেকে। তাঁকে প্রথমে উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়, এরপর তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় সম্মাননা স্মারক। একইভাবে শুভেচ্ছা স্মারক প্রদান করা হয় গবেষক অপূর্ব শর্মা এবং বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীনকে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার তাদের হাতে সম্মাননা ও শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দেন।
শেষপর্বে ছিলো আলোচনা। এ পর্বের প্রথমেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অপূর্ব শর্মা। তাঁর বক্তব্যে বীরাঙ্গনাদের বিভীষিকাময় সময়ের কথা জেনে সংবেদনশীলভাবে তা উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা বর্ননা করে তিনি বলেন, ‘আমার অনেক রাতের ঘুম উবে গিয়েছিলো পাকিদের বর্বরতার কথা শুনে। বিক্ষত হয়েছে হৃদয়। তাদের যতটুকু বেদনা তুলে ধরেছি তার চেয়ে অধিক বেদনা থেকে গেছে অপ্রকাশিত। সেটা বুঝে নিতে হবে উপলব্ধি দিয়ে। তিনি বলেন, একজন লেখক হিসেবে আমার স্বার্থকতা হচ্ছে, যেসব বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লিখেছি তাদের প্রত্যেককেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। এটা আমার জীবনের পরম এক পাওয়া। তিনি বলেন, উদ্দেশ্যের প্রতি যদি সৎ থাকা যায় এবং দাবি যদি যুক্তিযুক্তভাবে উপস্থাপন করা যায় তাহলে সরকার সেটা অবশ্যই মেনে নেন। এক্ষেত্রেই তাই হয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সকলকে ভেদাভেদ ভুলে কাজ করার আহŸান জানান।
বাচিক শিল্পী মুনিরা পারভীন তার বক্তব্যে বলেন, ‘এই শহরেই আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা। এখান থেকেই গ্রহন করেছি সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতার শিক্ষা। একজন বাচিক শিল্পী হিসেবে আমার যেটুকু অর্জন তার অভিযাত্রাও শুরু হয়েছিলো এই সবুজ ভূমি থেকে। মা-বাবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর গুরু হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্যরে আপত্য স্নেহ-ই আমাকে আজকের আমি যতটুকু তাতে রূপান্তরিত করেছে। একজন আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে প্রবাসে বাংলার কাব্যধারাকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপনের যে প্রয়াস দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছি তার সূচনাও হয়েছিল সুরমা উপত্যকায়। যে অডিটরিয়ামের দ্বিতীয় তলায় বসে আবৃত্তি শিখেছি এবং একসময় শিশু একাডেমিতে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছি চিরচেনা সেই অডিটরিয়ামে আমার একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান ‘বীরাঙ্গনা কথা’ হবে তা ছিলো আমার কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্নই আজ স্বার্থক হয়েছে শ্রæতি সিলেটের কল্যানে। তিনি বলেন, অপূর্ব শর্মা অক্লান্ত পরিশ্রম করে বীর নারীদের বেদনাবহ আখ্যান তুলে ধরার কারনেই আজ আমরা এই অঞ্চলের বীরাঙ্গনাদের সেই দুর্বিসহ আখ্যান জানতে এবং আপনাদের জানাতে পারলাম। এজন্য তিনি লেখককে ধন্যবাদ জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ রায় বর্মনও ফিরে যান একাত্তরে। যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথায় তিনি স্মরন করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বলেন, তাঁর আহŸানে সারা দিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসেছি বিজয়ীর বেশে। কিন্তু অনেক সহযোদ্ধা ফিরতে পারেননি। তাদের বুকের তাজা রক্তে লাল হয়েছে বাংলার সবুজ প্রান্তর। সাথী হারানোর বেদনা আজও আমাকে তাড়িত করে। তিনি বলেন, যুদ্ধ চলাকালে মা-বোনদের উপর অকথ্য নির্যাতনের কথা শুনেছি। কিন্তু নভেম্বর মাসে দু’জন বীরাঙ্গনাকে একটি বাঙ্কার থেকে যখন উদ্ধার করলাম তখন আর স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। তিনি দুঃখ করে বলেন, তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আজও সেই বেদনা আমাকে তাড়িত করে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বিনির্মান করতে গিয়ে এক সাগর রক্ত দিতে হয়েছে আমাদেরকে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ এবং অগনন নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া এ স্বাধীনতাকে রক্ষা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় সবাইকে একযুগে কাজ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে একাত্তরের যুদ্ধআখ্যাগুলো তুলে ধরতে হবে বেশি বেশি করে নতুন প্রজন্মের সামনে। তাহলে বিপথগামী হবে না তারা। তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক জাগরণই পারে একটি প্রগতিশীল সুস্থ সমাজ বিনির্মান করতে। সেই জাগরণের প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে শ্রæতি। তিনি এ ধরনের যে কোনও উদ্যোগে তাকে শামিল করার অভিষ্পা ব্যক্ত করে বলেন, আজ বীরাঙ্গনাদের যে অশ্রæত আখ্যান তুলে ধরলেন মুনিরা পারভীন তা এ ধারার চর্চায় যুক্ত করলো এক ভিন্নমাত্রা। এজন্য তিনি আয়োজক সংস্থা এবং লেখককে ধন্যবাদ জানান।
সবশেষে অনুভূতি ব্যক্ত করেন বীরাঙ্গনা সন্ধ্যারাণী। আবেগাপ্লুত কন্ঠে একাত্তরের পরবর্তী তাঁর নিঃসঙ্গতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার কেউ নেই। বাড়ি নেই, ঘর নেই। ভাইয়ের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে ছিলাম এতদিন। কিন্তু আজ আমি আর গলগ্রহ নই। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অপূর্ব শর্মাকে ধর্ম আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘তার কারনেই আজ আমি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছি। ভাতা পাচ্ছি। তিনি এ ধরনের আয়োজন করে তাঁকে সম্মানিত করায় শ্রæতি সিলেটের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠান সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আয়োজক সংগঠনের অন্যতম কর্ণধার সুকান্ত গুপ্ত শ্রæতির অগ্রযাত্রায় সকলকে আগামীতেও পাশে থাকার আহŸান জানিয়ে বলেন, সকলকে সঙ্গে নিয়েই সুন্দর এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে চায় শ্রæতি।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে সমাপ্তি টানা হয় অনুষ্ঠানের। সকলে দাঁড়িয়ে যখন দাড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ উচ্চারণ করেন তখন গর্বে ভরে উঠে সন্ধ্যারাণীর বুক। তিনিও কন্ঠ মেলান জাতীয় সংগীতে।
Sharing is caring!


………………………..

Design and developed by best-bd