ছাতকে ফসলি জমি নষ্ট করছে লাফার্জ সিমেন্ট কারখানা

প্রকাশিত: ৩:০৫ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৮

Manual4 Ad Code

ছাতক প্রতিনিধি :: ছাতকে অবস্থিত লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেডের ক্ষতিকর বর্জ্য ও ধুলোবালিতে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও ফসলি জমি। ভারত থেকে আমদানিকৃত চুনা পাথর আনলোডের সময় লাফার্জের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় ক্ষতিকারক ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। এ কারণে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা ১১ বছর ধরে পরিবেশ দূষণসহ বিভিন্ন অভিযোগ করে আসলেও রহস্যজনক কারণে অদ্যবদি পর্যন্ত কোন প্রতিকার পায়নি।

Manual2 Ad Code

লাফার্জ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিবেশ দূষণ ও ফসলি জমি ধ্বংশের মতো একাধিক অভিযোগ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দেয়া হলেও আজো কোন সূরাহা হয়নি বলে ক্ষতিগ্রস্থ ভূমির মালিকরা জানিয়েছেন। বায়োদূষণ, শব্দদূষণ, নদী শাসন, ফসলি জমি নষ্টসহ আরো অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে এই লাফার্জের বিরুদ্ধে।

Manual8 Ad Code

এছাড়া পাহাড়সম মাটি ড্রাপিংয়ের ফলে আশ-পাশের বসত-বাড়িতে ফাঁটল, গ্যাস লাইলে বিস্ফোরণ, সবুজ পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এসব অভিযোগ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার আগেই লাফার্জের উপকার ভোগি একটি স্বার্থান্বেষি মহল কৌশলে দমিয়ে রাখছেন বলে এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনরা অভিযোগ করেছেন। এশিয়ার সর্ববৃহত্ত ক্লিংকার ও সিমেন্ট উৎপাদনকারিপ্রতিষ্ঠান লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লি: ২০০৬ সালে সুরমা নদীর তীরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২শ’ ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে ফান্সের অত্যধুনিকপ্রযুক্তি ভিত্তিক বার্ষিক ১দশমিক ২মিলিয়ন টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন এ লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেড ছাতক শহরের সুরমা নদীর উত্তর পারে নোয়ারাই ইউনিয়নের টেংগারগাঁও এবং নোয়ারাই গ্রামের মধ্যস্থলে স্থাপিত হয়। এটির প্রধান কাঁচামাল চুনাপাথর সংগ্রহের জন্য ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসিয়া বন ভূমি এলাকার ১শ’ ১৬ হেক্টর খরিজাত ভূমি আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্রের মাধ্যমে লিজ গ্রহণ করে লাফার্জ। ভারতের খনিপ্রকল্প থেকে বাংলাদেশের লাফার্জের অভ্যন্তরে ১৭ কিলোমিটার সংক্রিয় কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে শুরু থেকে চুনা পাথর পরিবহন করা হচ্ছে এ পথ দিয়ে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেড’র বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদন শুরু করে। কিন্তু উৎপাদনের প্রায় ৬ মাসের মাথায় পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ভারত থেকে চুনাপাথর আমদানিতে সে দেশে উচ্চ আদালতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেড এর ভবিষ্যত হয়ে পড়ে অনিশ্চিত। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় চুনাপাথর আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে উৎপাদন চলে আসে সর্ব নিম্নে।

Manual6 Ad Code

সূত্র জানায়, পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসিয়া এলাকার বাসিন্ধারা কয়েকটি এনজিও সংস্থার পরামর্শে আদালতে মামলা দায়ের করেন। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির কারণে মেঘালয় রাজ্যের ননগোট্রাই খনি থেকে চুনাপাথর উত্তোলনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ভারতের হাইকোর্ট। এতে ২০০৭ সালের ১২ এপ্রিল থেকে খনি প্রকল্পের চুনাপাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে পড়ার সাথে সাথে লাফার্জের লাভজনক মুল্য পণ্য ক্লিংকার উৎপাদনও সম্পূর্নভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে ওই সময় লাফার্জের প্রায় দেড় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারিকে স্বেচ্ছায় ছুটিপ্রদান করে ছাঁটাই করা হয় আরো কয়েকশ শ্রমিককে।

২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ভারতের আদালতে একটি রায় লাফার্জের অনূকূলে যাওয়ায় লাফার্জ খনিপ্রকল্প থেকে আবারো চুনাপাথর উত্তোলন করে উৎপাদন শুরু করে। ২০১০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একই অভিযোগে চুনাপাথর উত্তোলনের উপর আবারো নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ২০১১ সালের ৬ জুলাই দেশটির পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয় লাফার্জকে সংশোধিত পরিবেশ বিষয়ক অনুমোদন দেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক চুক্তির গুরুত্বের কথা বিবেচনায় এনে দীর্ঘ প্রায় ১৫ মাস পর ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এসএইচ কাপাদিয়া লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেডের পক্ষে রায় প্রদান করেন। এর পর থেকে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লি: পূর্ণ মাত্রায় ক্লিংকার ও সিমেন্ট উৎপাদন শুরু করে।

কিন্তু সিমেন্ট তৈরির আরেকটি প্রধান উপাদান মাটি সংগ্রহের নতুন জটিলতায় পড়ে লাফার্জ সুরমা। কর্তৃপক্ষ কৃষি জমি থেকে স্থানীয় ভাবে মাটি সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ সময় কৃষি জমি থেকে মাটি না দেয়ার পক্ষে স্থানীয় লোকজন ঐক্যবদ্ধ ভাবেপ্রতিবাদ করে।

Manual6 Ad Code

এদিকে কৃষি জমি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় স্থানীয় কৃষকরা তৎকালিন জেলা প্রশাসক জহির উদ্দিন আহমদের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন। তখন লাফার্জ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কৃষি জমির মালিকদের বিভিন্ন অর্থিকপ্রলোভন দেখিয়ে জমি থেকে মাটি সংগ্রহ করতে থাকে দালালদের মাধ্যমে। এর ফলে একের পর এক ফসলি জমি চলে যাচ্ছে লাফার্জের পেটে। মাটি সংগ্রহের কারণে এলাকার কৃষি জমি পরিণত হচ্ছে জলাশয়ে। বাহ্যিক লাভে জমির উর্বর মাটি বিক্রি করে অনেক কৃষক এখন দিশে হারা হয়ে পড়েছেন। অপরিকল্পিতভাবে মাটি বিক্রি করা এসব জমি না জলাশয় না কৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় কৃষি জমিতে লাফার্জ আগ্রাসন চালিয়ে এবং ক্লিংকার বিক্রি করে প্রতি বছর লাখ লাখ মার্কিন ডলার আয় করছে। পাশাপাশি লাফার্জের পার্শ্ববর্তী বাতির কান্দি, টেঙ্গার গাঁও, জয়নগর, জোড়া পানিসহ বিশাল এলাকা জুড়ে ফসলি জমি পরিণত হচ্ছে জলাশয়ে।

অপরদিকে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানায় ডাস্ট ডিভাইজার ব্যবহার না করায় আশপাশের সবুজ পরিবেশের উপর মারাত্বকভাবে ক্ষতি হচ্ছে। লাফার্জের আশপাশ এলাকার গাছ-পালা, ঘর-বাড়ি, এখন ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। ১৭ কিলোমিটার কনভেয়ার বেল্টের উচ্চশব্দের কারণে ছাতক-দোয়ারাবাজার দু’উপজেলা বেল্ট সংলগ্ন অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ মারাত্মক শব্দ দূষণে ভূগছেন। কনভেয়ার বেল্টের উচ্চশব্দের কারণে এসব এলাকার নারী-পুরুষ, শিশু ও অন্ত:সত্ত্বা মহিলারা শব্দ দূষণসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিষয়টি লাফার্জ কর্তৃপক্ষকে বার বার অবহিত করা হলেও উচ্চশব্দ নিয়ন্ত্রনে কোন কার্যকরি প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লি: সুরমা নদীর তীরে স্থাপিত হওয়ায় নদীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ অবৈধ ভাবে দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে রেখেছে লাফার্জ। একাধিকবার পরিবেশ দূষণ, উচ্চশব্দ দূষণ, নদী ভরাট ও স্থানীয়দের চাকরি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও লাফার্জ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি কখনও আমলে নেয়নি। উল্টো স্থানীয় শ্রমিকদের ছাঁটাই করা লাফার্জ কর্তৃপক্ষের রিতিমত অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। প্রচলিত নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কয়েকটি ধাপে স্থানীয় প্রায় ৩ শতাধিক শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরি হারা এসব শ্রমিকরা ন্যায় বিচার ও চাকরি ফিরে পাওয়ার আশায় লাফার্জের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলা করেছেন। বর্তমানে মামলা বিচারাধিন রয়েছে।

২০১৩ সালের ৩ জুলাই স্থানীয় ফসলি জমির ক্ষতি বিষয়ে বোরো ল্যান্ড রিভাইটালাইজেশন প্রকল্পের আওতাধিন কৃষকদের সাফল্য মূল্যায়ন সভা করে লাফার্জ কর্তৃপক্ষ। সভায় ফসলি জমি থেকে মাটি সংগ্রহের বিষয়ে তীব্র সমালোচনা করেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত সচিব জহির উদ্দিন আহমদ ও তৎকালিন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ইয়ামিন চৌধুরি। এ সময় তারা বলেন, মাটি সংগ্রহের বিষয়টি বিজ্ঞান সম্মত নয়।

অন্যদিকে পাহাড়সম মাটি ড্রাম্পিংয়ের ফলে বসতঘরে ফাঁটল ও ফাঁটল জণিত কারণেপ্রাণহানির অভিযোগ এনে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। ২০১৪ সালের ১৩ এপ্রিল লাফার্জের প্ল্যান্ট ম্যানেজারের কাছে এবং মাটি ড্রাম্পিংয়ের কারণে ফসলি জমি অনাবাদি জমিতে পরিণত করার অভিযোগে নোয়ারাই এলাকার শুকুর মিয়া চৌধুরি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বরাবরে পৃথক অভিযোগ দায়ের করেন। ১০ লক্ষাধিক টন মাটি ড্রাম্পিং এর কারণে ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ড্রাম্পিং সংলগ্ন এলাকায় ছাতক সিমেন্ট কারখানার ৬ ব্যারেল গ্যাস লাইনে বিকট বিস্ফোরণ ঘটলে ছাতক সিমেন্ট কারখানার উৎপাদন তখন বন্ধ হয়ে যায়। কনভেয়ার বেল্টের উচ্চ শব্দের কারণে ছাতক-দোয়ারারপ্রায় ২০/২৫টি গ্রামের মানুষ শব্দ দূষণ জনিতসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। লাফার্জের মূল প্লান্টের আশপাশের কয়েকটি গ্রামের সবুজ পরিবেশ সম্পূর্নভাবে নষ্ট হয়ে পড়েছে।

অতিরিক্ত ডাস্টের কারণে লাফার্জ সংলগ্ন সুরমা নদী হারাচ্ছে নাব্যতা। চুক্তি অনুযায়ি ক্ষতিগ্রস্থ ভূমির মালিকদের সব ধরণের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। লাফার্জের আশপাশের এলাকার ফসলি জমি ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছে লাফার্জের পেটে। এসব মাটি বিক্রি বন্ধ করা না হলে এক সময় এলাকার সব ফসলি জমি অনাবাদি ও জলাশয়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল।

এলাকাবাসীর অভিযোগ ও আপত্তির বিষয়ে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেডের কমিউনিটি রিলেশন কর্মকর্তা সাব্বির আহমদ জানান, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেড একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। এটির বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অভিযোগ আপত্তি থাকা স্বাভাবিক। তাই যে কোন ক্ষয়ক্ষতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় এনে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

February 2018
S S M T W T F
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
2425262728  

সর্বশেষ খবর

………………………..