সিলেট ১৭ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৮ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১:৫৭ পূর্বাহ্ণ, মে ১৫, ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :: সংরক্ষিত জলাবন রাতারগুলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত গোয়াইন নদী। এই নদীর বালুমহাল অংশে নিষিদ্ধ যন্ত্র ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় জলাবনটি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। রাতে ড্রেজিং চলায় প্রশাসন বা বন বিভাগও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুলের অবস্থান সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে। বন বিভাগের তথ্যমতে, পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশে আছে দুটি। একটি শ্রীলঙ্কায়, আরেকটি বাংলাদেশের রাতারগুল। সুন্দর বিশাল এ বনের তুলনা চলে একমাত্র আমাজনের সঙ্গে। আমাজনের মতো এখানকার গাছ বছরে চার থেকে সাত মাস পানির নিচে থাকে।
রাতারগুল জলাবন বা সোয়াম্প ফরেস্ট বন্য ও জলার প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষিত। আয়তন ৩ হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ বন বিভাগ, বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে। এ ছাড়া জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণ গাছ, আছে পিঠালি, অর্জুন, ছাতিম, গুটি জাম, আছে বট গাছও। বনে সাঁপের আবাস অনেক বেশি। এ ছাড়া রয়েছে বানর, গুঁইসাপ, সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি।
সংরক্ষিত এই জলাবনের একটি অংশ কেবল দিনের বেলায় পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। রাতে বনটিতে কেউ থাকে না। এই সুযোগে পাশ দিয়ে প্রবাহিত গোয়াইন নদীর বালুমহাল অংশে চলছে ড্রেজার দিয়ে বালু আহরণ। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পালা করে রাতের বেলা চলে বালু উত্তোলন। ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার শব্দ ও কম্পনে সংরক্ষিত বনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। গোয়াইন নদীর পূর্বে পড়েছে রাতারগুল। ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করার কারণে বন এলাকা নদী ভাঙনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
জানা গেছে, গোয়াইন নদীর বালুমহল নতুন করে ইজারা দেওয়া হলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের বালুব্যবসায়ীরা এখনো ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করছেন। পুরো কাজটি তদারক করছেন সোহেল আহমদ ও আলমগীর হোসেনের লোকজন। যন্ত্রের দাপটে এলাকায় তারা ‘বালু খেকো’ চক্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ফতেহপুর ইউনিয়নের মহিষখেড় গ্রামের সোহেল আহমদ ও বাঘবাড়ি গ্রামের আলমগীর হোসেন স্থানীয় একটি চক্র নিয়ে ড্রেজার মেশিন চালাচ্ছেন। সন্ধ্যার পর প্রস্তুতি নিয়ে রাতভর চলে ড্রেজিং। রাতে চলা মেশিন দিনে বন্ধ রাখা হয়। তখন উত্তোলন করা বালু গন্তব্যে নেওয়া হয়। বালুভর্তি প্রতিটি নৌকা থেকে তিন হাজার টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। সোহেল-আলমগীরের ‘ড্রেজিং চক্র’ পুরো গোয়াইন নদী নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা ড্রেজার চালানোর সময় সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা করেন। এতে স্থানীয় কেউ আর বাধা দেওয়ার সাহস পান না।
দিনে ড্রেজার মেশিন না চালালেও বালুমহালের কথা বলে গোয়াইন নদীর নৌপথ ব্যবহারে বালু বোঝাই নৌকা-ভলগেট যাতায়াতে চাঁদা তোলা হয়। প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে পাঁচ শতাধিক নৌকা-ভলগেট থেকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। বালুমহালে ড্রেজার মেশিন চালানো ও নৌপথে চাঁদাবাজির কারণে চলিতাবাড়ি, শিয়ালাহাওর, বাইমারপারসহ রাতারগুলে আধিপত্য বিস্তার করায় পর্যটকসহ সাধারণ মানুষজনের স্বাভাবিক চলাচলে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
রাতারগুল গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কয়েক দিন বিরতি দিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে ড্রেজার চলছে। সোহেল-আলমগীরের লোকজন রাতভর রাতারগুলে অবস্থান নেন। ফোনে যোগাযোগ করলে সোহেল আহমদ দাবি করেন, বালুমহাল এলাকায় তিনি ছিলেন। ড্রেজার কারা চালিয়েছে, তা তিনি জানেন না। যদিও আলমগীর সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন বন্ধ করে দেন।
রাতারগুলে কর্মরত বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা অনুকর চাকমা জানিয়েছেন, গোয়াইন নদীর একাংশ পড়েছে সংরক্ষিত বনের জায়গায়। বালুমহাল হিসেবে চিহ্নিত এলাকা মাড়িয়ে বনের জায়গা থেকে যন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হয়। এতে করে বনের সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্য বছরের তুলনায় এবার বালু উত্তোলন কার্যক্রম আগ্রাসী জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ড্রেজার মেশিন রাতে চলায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি না। আমরা যখন তাদের ধরার প্রস্তুতি নিই তারা টের পেয়ে ওই রাতে আর বালু উত্তোলন করে না।’
পরিস্থিতি মোকাবিলায় বন বিভাগ একা কিছু করতে পারবে না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এ অবস্থায় সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা শিগগিরই সিডিপিবির (জলার বন সংরক্ষণে স্থানীয় অংশীজন) মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে প্রশাসনের কাছে পাঠাব।’
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী বলেন, ‘কোনো বালুমহালে যন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন ইজারা শর্তবিরোধী। এর মধ্যে সংরক্ষিত বন রাতারগুলের আশপাশে কোনোভাবেই বালু উত্তোলন বৈধ নয়। এ চক্রকে হাতেনাতে ধরে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd