কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ব্যবস্থাপত্র জালিয়াতি: নেপথ্যে স্যাকমো খালিক

প্রকাশিত: ২:৫১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১, ২০২১

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ব্যবস্থাপত্র জালিয়াতি: নেপথ্যে স্যাকমো খালিক

স্টাফ রিপোর্টার :: অনিয়ম এবং দুর্নীতি যেন পিছু ছাড়ছে না কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। এবার এই হাসপাতালের এক উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের (স্যাকমো) বিরুদ্ধে উঠেছে ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) জালিয়াতির অভিযোগ। অভিযুক্ত ওই উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের নাম আব্দুল খালিক। রোববার তার বিরুদ্ধে প্রেসক্রিপশন জালিয়াতির অভিযোগ এনে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন কালাইরাগ ইসলামাবাদ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত আব্দুর রবের স্ত্রী ফুলবানু বেগম।

অভিযোগসূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৫ জুন জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন ফুলবানু বেগমের ছেলে কামাল আহমদ ও জামাল আহমদ। ওই দিন বিকেলে আহতবস্থায় কামাল ও জামালকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হয়। এ সময় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার লুৎফুর রহমান। জামাল ও কামালের অবস্থা গুরুতর দেখে তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

কোম্পানীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে কামাল আহমদের নাম রেজিস্ট্রার খাতায় লিপিবদ্ধ করে একটি ব্যবস্থাপত্র দেন কর্তব্যরত লুৎফুর রহমান। ব্যবস্থাপত্রে রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হয় ৯৭৭। রেজিস্ট্রার খাতায়ও একই নম্বরে লিপিবদ্ধ হয় কামালের নাম। এ ঘটনার ৪ দিন পর কোম্পানীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরেক উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার আব্দুল খালিক অনৈতিকভাবে কামালের প্রতিপক্ষ সাইদুল ইসলাম ও সালমা বেগমের নামে দুটি ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন। ২৯ জুন লিপিবদ্ধ হলেও ওই দুটি ব্যবস্থাপত্রে ৪ দিন আগের তারিখ উল্লেখ করা হয়। ২৫ জুন অর্থাৎ যেদিন কামাল ও জামাল আহত অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিলেন, ওই তারিখটি উল্লেখ করা হয় সালমা ও সাইদুলের দুটি ব্যবস্থাপত্রে। রেজিস্ট্রার খাতায় ২৫ জুনের পৃষ্ঠায় ছোট ছোট অক্ষরে লিখা হয় সাইদুল ও সালমার নাম। আহত না হয়েও আব্দুল খালিকের সাথে আঁতাত করে তারা ভুয়া ব্যবস্থাপত্র বাগিয়ে নেন। অথচ তারা আহত হননি এবং ২৫ জুনের সিসিটিভি ফুটেজেও তাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ওই ভুয়া ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ১ জুলাই সিলেটের আদালতে মুক্তিযোদ্ধা মৃত আব্দুর রবের পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন সালমা বেগম।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, রেজিস্ট্রার খাতায় কামাল আহমদের ব্যবস্থাপত্রের রেজি. নম্বর-৯৭৭। কাকতালীয়ভাবে ৯৭৭ নম্বর তার প্রতিপক্ষ সাইদুল ইসলামের রেজি. নম্বরও ৯৭৭। কামালের ব্যবস্থাপত্রে লুৎফুর রহমানের স্বাক্ষর থাকলেও, সাইদুল ইসলামের ব্যবস্থাপত্রে রয়েছে আব্দুল খালিকের স্বাক্ষর।
অথচ হাসপাতালের একটি সূত্র বলছে, ২৫ জুন দুপুর ১২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালেই ছিলেন না আব্দুল খালিক। এমনকি, সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজেও মেলেনি আব্দুল খালিক কিংবা সাইদুল ইসলামের উপস্থিতি। এ সময় ডিউটিতে ছিলেন উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার লুৎফুর রহমান। উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার আব্দুল খালিক অনৈতিকভাবে ৯৭৭ ও ৯৮০ রেজি. নম্বরের দুটি ভুয়া ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন সাইদুল ও সালমাকে। জালিয়াতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রার খাতায়ও লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের নাম।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে কোম্পানীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার আব্দুল খালিক। মূলত তিনি দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়ন কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকলেও, ওই ক্লিনিকের অবকাঠামো ঠিক না থাকায় খালিককে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই রাখা হয়। আব্দুল খালিকের বিরুদ্ধে রয়েছে টাকার বিনিময়ে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগ। রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে রীতিমতো দর কষাকষি করেন তিনি। সম্প্রতি আব্দুল খালিক একটি শিশুর হাতে ব্যান্ডেজ করার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা এক নারীর কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নেন। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও একাত্তরের কথা’র কাছে সংরক্ষিত আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে প্রায়ই লোকজনকে জাল ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন এই উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। গত মাসের উপজেলার মাসিক সভায় আব্দুল খালিকের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে জাল ব্যবস্থাপত্র বিক্রির অভিযোগ তোলেন স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি।

ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন, আমাদের কাছে মাঝেমধ্যে জনগণ হাসপাতালের স্টাফদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে আসে। সেক্ষেত্রে আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা বিষয়টি সুরাহা করে দেন। আব্দুল খালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগটি গুরুতর। আমি কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ (টিএইচও) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাবো, যেন সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সত্য ঘটনাটি উদঘাটন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কারণ ঘটনাটি যদি সত্যি হয়, তবে এটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে রোগীরা এ হাসপাতালের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে, ব্যহত হবে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা।

গত রোববার ব্যবস্থাপত্র জালিয়াতির অভিযোগ এনে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার (টিএইচও) কাছে লিখিত অভিযোগ দেন কামালের মা ফুলবানু। এর প্রেক্ষিতে বুধবার এক অফিস আদেশের মাধ্যমে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন টিএইচও ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন ডা. আরিফুল ইসলাম, মেডিকেল অফিসার ডা. প্রভাকর রায়, এসএসএন ফাতেমা আক্তার এবং এমটি (ইপিআই) ফারুক আহমদকে নিয়ে গঠিত এই তদন্ত কমিটিকে ৩ কর্মদিবসের মধ্যে অভিযোগটির তদন্ত প্রতিবেদন টিএইচও’র কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার আব্দুল খালিকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগের বিষয়ে অবগত আছেন বলে জানান।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচও) ডা. মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বক্তব্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানান এবং সরাসরি তার অফিসে যাওয়ার জন্য বলেন।

সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মন্ডল জানান, আব্দুল খালিকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ এলে অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..