সিলেট ২২শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৩শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৭:০৫ অপরাহ্ণ, মে ২৪, ২০২৪
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক :: কোনো অপরাধ করে কারাগারে গেলে প্রথমদিন আমদানিতে রাখা হয় আসামিদের। এই আমদানিতে একরুমে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন গাদাগাদি করে ফ্লোরে থাকেন। ঠিক একই পন্থায় চলে সিলেট নার্সিং কলেজের আবাসিক হোস্টেল।
নার্সিংয়ের প্রথম বর্ষে যারা আসে তাদেরকে হোস্টেলের হলরুমে রাখা হয়। যেখানে কোনো খাটের ব্যবস্থা নেই। সবাইকে ফ্লোরে বিছানা পেতে থাকতে হয়। ২০ থেকে ২৫ জন ধারণ ক্ষমতার একটি রুমে রাখা হয় ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রী।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই আবাসন সমস্যার কোনো সমাধান করছেন না কলেজ ও হোস্টেল কর্তৃপক্ষ। তাই কিছুদিন পরপরই পর্যাপ্ত রুমের দাবীতে ছাত্রীরা ছোটখাটো আন্দোলন করেন। তখন নতুন ৬তলা ভবনে ছাত্রীদের শিফট করার আশ্বাস, পরীক্ষায় ফেল করানোর ভয়সহ নানা ভাবে ছাত্রীদের আবার ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন বন্ধ করেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার আবাসনের এই সমস্যায় অতিষ্ঠ হয়ে কলেজে গিয়ে শিক্ষকদের কাছে রুমের দাবি করেন বেশ কয়েকজন ছাত্রী ।
হোস্টেলে অবস্থানরত বিভিন্ন ব্যাচের বেশ কয়েকজন ছাত্রীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বিএসসি ১৩ ব্যাচের ৪৪ জন ছাত্রী সিনিয়রদের সাথে রুমে উঠছেন। কিন্তু ২৪ জন ছাত্রী সিনিয়রদের সাথে গাদাগাদি করে রুমে থাকবেন না তাই তারা হলরুমে আছেন। এদিকে আবার প্রতি রুমে একজন করে নতুন ব্যাচের জুনিয়র দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ ।
অপরদিকে মিডওয়াইফারি পুরাতন প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা এখনো হলরুমে। তাদের সিনিয়রদের পরীক্ষা শেষ হয়নি তাই তারা রুম পায়নি। তাই বিভিন্ন ব্যাচের প্রায় ৪৫ জন ছাত্রী বৃহস্পতিবার কলেজ এ গিয়ে আন্দোলন করছে রুমের দাবিতে। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ বেলা ২টা ৪০ মিনিটে এসে নির্দেশ দেয় চারজনের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন রুমে সব ব্যাচমেট মিলে ৮ জন করে রুমে থাকার। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত না মেনে রুমে রুমে তালা ঝুলিয়ে দেয় ছাত্রীরা। এরপর হোস্টেলে আসা শিক্ষকরা তালা ভেঙে রুমে প্রবেশ করে ছাত্রীদের গালাগালি করেন। এরপর কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের ভয় দেখিয়ে তাদের নির্দেশ মানার জন্য হোস্টেলে পুলিশ নিয়ে আসেন। তারপরও কেউ হোস্টেল কর্তৃপক্ষের এই অমানবিক নির্দেশ মানেনি। সবার দাবি ছিল নতুন হোস্টেল।
এদিকে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের এই অমানবিক নির্দেশ মানাতে না পেরে বিকালে সকল ছাত্র ছাত্রীদেরকে হল ছাড়ার জন্য নোটিশ করেন সিলেট নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ শাহিনা বেগম।
নোটিশে বলা হয়,‘ এতদ্বারা সিলেট নার্সিং কলেজে অধ্যয়নরত সকল ছাত্র ছাত্রীদেরকে প্রশাসনিক কারণে অদ্য ২৩.০৫.২০১৪ ইংরেজি সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সকল আবাসিক হোস্টেল ত্যাগের নির্দেশ প্রদান করা হইলো। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকিবে।’
এদিকে হোস্টেল বন্ধের নোটিশ দিয়ে হোস্টেলের বাবুর্চিসহ সকল স্টাফকে সরিয়ে নেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরে রাতে ছাত্রীরা নিজেরা রান্না করে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেন। নাম প্রকাশ না করার সর্তে সিলেট নার্সিং কলেজের ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত এক ছাত্রী বলেন, আমরা এখানে ১৯৭১ সালের মত দিনযাপন করতেছি। গতকাল বৃহস্পতিবার সারাদিন হোস্টেলে অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে। নিজেদের রুমে অতিরিক্ত ছাত্রী নিবে না তাই সিনিয়র আপুরা রুমে তালা দিয়ে দেন। আবার কলেজের স্যার ম্যামরা এসে এই তালা ভেঙে রুমে প্রবেশ করেন। আমাদের শিক্ষকরা আবার হোস্টেলে পুলিশ নিয়ে আসেন। এতকিছুর পর আমরা ছাত্রীরা কলেজ কর্তৃপক্ষের অমানবিক সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়ায় হোস্টেল ত্যাগের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টার ভিতরে হোস্টেল ছাড়ার নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ। কিন্তু এই শর্ট নোটিশে রাতে আমরা কিভাবে হোস্টেল ত্যাগ করবো। এবং আমরা কোনো কারণ ছাড়া কেন হোস্টেল ত্যাগ করবে।
পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং এর আরেক ছাত্রী বলেন, আমাদের কাছে মনে হয় আমরা জেলে আছি। কলেজ কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক তাদের অমানবিক সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। চারজনের থাকার রুমে আটজন থাকার জন্য তারা জোর জবরদস্তি করছেন। তারা হোস্টেলে পুলিশ কিভাবে আনলেন। আমরাতো কাওকে খুন করিনি। আমাদের প্রাপ্য অধিকারটুকু শুধু চেয়েছি। ছাত্রীদের হোস্টেলের জন্য একটি ছয়তলা ভবন রেডি আছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ সেখানে ছাত্রীদের উঠতে দিচ্ছেন না। কিন্তু বারবার এই আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছেন আমাদেরকে ছয়তলা বিল্ডিংয়ে রুম দেওয়া হবে তখন থাকার সমস্যা হবে না। কিন্তু এই আশ্বাস তারা দীর্ঘ পাঁচ ছয় বছর ধরে দিচ্ছেন। আমাদের আগের সিনিয়র আপুরাও এই আশ্বাসের ফাঁদে পরে কোর্স শেষ করে চলে গেছেন। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রাপ্যটা আমাদের বুঝিয়ে না দিয়ে উল্টো আমাদের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করছেন।
জানা যায়, সিলেট নার্সিং কলেজ হোস্টেলে আছেন কলেজের পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন পাবলিক হেলথ, পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং, বিএসসি নার্সিং কোর্স ও ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্রী।
হোস্টেলে অবস্থানরত বিভিন্ন ব্যাচের ছাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হোস্টেলের এই আবাসন সমস্যা চলছে প্রায় পাঁচ ছয় বছর যাবত। দায়িত্বশীলরা দীর্ঘ দিন ধরে নতুন বিল্ডিংয়ে ছাত্রীদের দেই দিচ্ছি বলে আশার বানী শুনিয়ে যাচ্ছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করছেন না। হোস্টেলের চার তলা ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় তিনটি হলরুম আছে। সেগুলোতে নার্সিংয়ের ভর্তি হওয়া প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা থাকে।
মিডওয়াইফারি প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা দ্বিতীয় তলার হলরুমে থাকে, তৃতীয় ও চতুর্থ তলার হলরুমে থাকে বিএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রীরা। ভবনের প্রথম তলায় রান্নাঘর ও খাবার ঘরের পাশাপাশি কয়েকটি থাকার কক্ষও রয়েছে। দ্বিতীয় তৃতীয় ও চতুর্থ তলায়ও থাকার কক্ষ আছে। এই কক্ষগুলোতে এই চার প্রোগ্রামের প্রথম বর্ষ (পুরাতন), দ্বিতীয় বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্রীরা থাকনে। প্রতিটি কক্ষে চার জন করে থাকার ধারণ ক্ষমতা থাকলেও দীর্ঘদিন যাবত এসব কক্ষে ছয়জন ছাত্রছাত্রী গাদাগাদি করে থাকছেন। এই ছয়জনের মধ্যে চারজন সিনিয়র, একজন পুরাতন প্রথম বর্ষের ছাত্রী বেডে থাকছেন। এবং হলরুমে জায়গা না হওয়ার সব রুমে ফ্লোরে একটা জুনিয়রকে (নতুন প্রথম বর্ষ) থাকার জন্য দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে সিলেট নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ শাহিনা বেগম বলেন, আমরা এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে এসেছে। হোস্টেল বন্ধের নোটিশ দেওয়া হলেও মূলত হোস্টেল বন্ধ না। রাতে বেশিরভাগ মেয়েরাই হোস্টেলে ছিল। ছাত্রীরা এখনো হোস্টেলে আছে। তাদের খাওয়াদাওয়া চলছে। হোস্টেলের যে দায়িত্বে আছেন তাকে বলে দিয়েছি ছাত্রীরা থাকবে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে। আমাদের দেওয়া নোটিশটি আমরা বাতিল করবো।
আবাসন সমস্যা নিয়ে অধ্যক্ষ শাহিনা বেগম বলেন, তাদের জন্য নতুন একটি বিল্ডিং হয়েছে। এটা আমাদেরকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে বুঝিয়ে দিলে আমরা ছাত্রীদেরকে সেখানে শিফট করবো। এ বিষয়ে আমরা তাদেরকে বুঝিয়েছি। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। তাদের সাথে আমার টাইম টু টাইম কথা হচ্ছে। এই বিল্ডিং বুঝে পেতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ হেড অফিসের পরিচালক (শিক্ষা) ও ডিজি স্যারের সাথে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন আপনারা ২৫ মে পর্যন্ত ধৈর্য ধরনে আমরা আসতেছি। আপাতত আপনি লোকাল ম্যানেজমেন্টে তাদের রাখেন আমরা ২৫ তারিখের পর এসে আমরা সব সমাধান করে দেব। আমি এ বিষয়ে আমার শিক্ষক ও ম্যানেজমেন্টর সাথে আলোচনা করছি । আশা করছি এর সমাধান দ্রুত হবে।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd