অবশেষে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের দুই আলোচিত দুর্নীতিবাজের শাস্তিমূকল বদলি

প্রকাশিত: ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০২৩

অবশেষে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের দুই আলোচিত দুর্নীতিবাজের শাস্তিমূকল বদলি

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : অবশেষে সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের আলোচিত দুর্নীতিবাজ হিসাব রক্ষক মোঃ ছমিরুল ইসলাম ও ষ্টোরকিপার সুলেমান আহমদ কে স্ট্যান্ডরিলিজ করা হয়েছে।
গত ১৩ জুলাই সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা.শরীফুল হাসান তার কার্যালয়ের প্রশা-৩/২০২৩/৮৩১/১০ নং স্মারকে জেলা সদর হাসপাতালের হিসাব রক্ষক মোঃ ছমিরুল ইসলাম কে জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক পদে এবং ষ্টোরকিপার সুলেমান আহমদ কে ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে বদলীর আদেশ দেন। আদেশে তিনি উল্লেখ করেন আদেশ জারীর ৭ দিনের মধ্যে বদলীকৃত কর্মস্থলে যোগদান না করলে ৮ম দিনে তারা সরাসরি অব্যাহতিপ্রাপ্ত (সাসপেন্ড) হয়েছেন বলে গণ্য হবেন। একই সাথে ষ্টোরকিপার সুলেমান আহমদ এর অনুকূলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মহাখালি ঢাকার স্মারক নং শৃঙ্খলা -১১/সিলেট/২০২১/৩৩৭৭তারিখ ২৯/০৮/২০২১খ্রি: এর নির্দেশনা মোতাবেক সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্মারক নং ৫০৪৬ তাং ২৮/১২/২০১৬ খ্রি: মোতাবেক সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদ থেকে স্টোরকিপার পদে বদলী করে বহালের আদেশ এবং একই কার্যালয়ের স্মারক নং ৩৬৭/৫ তাং ১২/০২/২০১৮ খ্রি: মোতাবেক স্টোরকিপার হিসেবে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে বদলী করে বহাল করার আদেশ দুটি বিধি বহির্ভূত হয়েছে বিধায় উক্ত আদেশ দুটি বাতিল করে তার মূল পদ সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাকে বহাল করা হলো মর্মে আদেশ জারী করা হয়।
সুলেমান আহমদ সুনামগঞ্জের স্পেশ্যাল জজ আদালতে দায়েরকৃত স্পেশ্যাল ৫/২০২৩নং মামলার প্রধান আসামী বলেও জানা যায়। এর আগে সুনামগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আনিসুর রহমান, হিসাব রক্ষক মোঃ ছমিরুল ইসলাম ও ষ্টোরকিপার মোঃ সুলেমান আহমদ এর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অপর একটি অভিযোগ আমলে নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ১২/১২/২০২২ইং তারিখে সুনামগঞ্জ পৌরসভার বাধনপাড়া নিবাসী মেসার্স শামীমা এন্টারপ্রাইজ এর প্রোপাইটর মোঃ সাজিদুর রহমান,ভূয়া প্রশাসনিক অনুমোদন নিয়ে চিকিৎসা ও শৈল চিকিৎসা সরঞ্জামাদি (এমএসআর) সরবরাহের অসদুদ্দেশ্যে কার্যাদেশ হাতিয়ে নিয়ে ভূয়া বিল পরিশোধের অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে ঐ অভিযোগটি দায়ের করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে মহাপরিচালক এর পক্ষে পরিচালক (অর্থ) ডাঃ ফরিদা ইয়াসমিন ৩ (তিন) সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
কমিটিতে ময়মনসিংহ বিভাগের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক কে সভাপতি,সিলেট জেলা সিভিল সার্জনকে সদস্য ও সুনামগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জনকে সদস্য সচিব করা হয়। এ তথ্য গত ১৪/২/২০২৩ইং স্বা:অধি:হিসাব/কমিটি গঠন/২০২২-২০২৩/১৫৭০ নং স্মারকাদেশ সংবলিত অফিস আদেশপত্রে জানা যায়।
অভিযোগে প্রকাশ,স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৫/১২/২০২২ইং তারিখের ১১০২ নং প্রকৃত স্মারকাদেশ বলে কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বিল পরিশোধের জন্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অর্থ) ডাঃ মোহাম্মদ আনিসুল ইসলাম মিঞা স্বাক্ষরিত প্রশাসনিক অনুমোদনপত্র ইস্যু করা হয়।
ইস্যুকৃত উক্ত সঠিক ও মূল পত্রটি তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আনিসুর রহমানের কার্যালয়ে মেইলযোগে আসার পূর্বেই গত ৩/১১/২০২২ইং ২০২২-২০২৩/৬৮৭ নং স্মারকে ভূয়া প্রশাসনিক অনুমোদনপত্র প্রস্তুত করে হিসাবরক্ষক মো. ছমিরুল ইসলাম ও ষ্টোরকিপার মো. সুলেমান আহমদ একে অপরের যোগসাজশে পরিকল্পিত জালিয়াতি প্রতারনার উদ্দেশ্যে নিজেদের সরবরাহকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করত: ৪ কোটি ৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকার বিল পরিশোধ করে। বিল আদায়ের লক্ষ্যে সুনামগঞ্জ জেলা হিসাব রক্ষন অফিসেও প্রদান করে কথিত জাল ও ভূয়া প্রশাসনিক অনুমোদনপত্র। বিনিময়ে তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ আনিসুর রহমান ও নিজেদের নামে মোটা অংকের পার্সেন্টিজ পকেটস্থ করে নেয় তারা। নিজেদের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ চক্রটি জেলা হিসাব রক্ষন অফিসকেও জাল কাগজপত্র দ্বারা প্রতারিত করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে ৪ কোটি ৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা বিলের চেক হাতিয়ে নেয়। কিন্তু বিল পরিশোধের দৃশ্যমান দুর্নীতির এ চিত্রটি তখন পর্যন্ত কারো নজরে আসেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৫/১২/২০২২ইং তারিখের ১১০২ নং প্রকৃত স্মারকপত্রটি সঠিক বলে প্রতীয়মান হওয়ায় বঞ্চিত ও প্রতারিত ঠিকাদার সাজিদুর রহমান বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষের নজরে প্রকৃত সত্যটি তুলে ধরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করেন।
গোপনসূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাভূক্ত সিলেট বিভাগীয় পরিচালক এর পদটি অবসরজনিত কারণে গত ডিসেম্বর মাসে শূন্য হওয়ায় এ পদে প্রমোশন নিয়ে স্থলাভিষিক্ত হওয়ার অভিপ্রায়ে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ আনিসুর রহমান উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন নিবেদন করেন। কিন্তু বিলম্ব হলে পার্সেন্টিজের ভাগের টাকা থেকে বঞ্চিত হবেন বলে তড়িগড়ি করে নভেম্বর মাসেই ভূয়া প্রশাসনিক অনুমোদনপত্র প্রস্তুত করত: সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠাণকে বিল পরিশোধের মাধ্যমে ঘুষের টাকা ভাগাভাগি করেন তারা। বিলের জন্য ইস্যুকৃত পৃথক দুটি প্রশাসনিক অনুমোদনপত্রের মধ্যে কোনটি সঠিক এবং কোনটি জাল তা ইতিমধ্যেই সুস্পষ্ট হয়েছে। যা সঠিক তদন্ত হলে আসল বিষয়টি বেরিয়ে আসবেই।
অভিযোগে প্রকাশ, দীর্ঘদিন যাবৎ জেলা সদরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটি স্টোরকিপার সুলেমান আহমদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলো। সুলেমান আহমদ ২০০৪ সালে ভূয়া ঠিকানা দিয়ে ছাতক উপজেলার ছৈলা আফজলাবাদ ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের নাগরিক সনদপত্র নিয়ে স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকুরী ভাগিয়ে নেন। অথচ তার স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা হচ্ছে সুনামগঞ্জ পৌরসভার মল্লিকপুর আবাসিক এলাকায়।
পরবর্তীতে ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগবিধি লঙ্ঘন, সরকারী বিভিন্ন জিও লঙ্ঘন করে এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে স্বাস্থ্য সহকারী (১৬ নং গ্রেড) হতে নিজ বেতনে ষ্টোরকিপার পদে (১৪ নং গ্রেডে) ২৮/১২/২০১৬ইং তারিখে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পদায়ন করা হয়। পরে ১২/২/২০১৮ইং তারিখে তাকে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হতে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। অথচ সুলেমান আহমদকে অসদুদ্দেশ্যে মোটা অংকের টাকা ঘুষের বিনিময়ে পদায়ন করতে গিয়ে তৎকালীন জেলা সিভিল সার্জন নিয়মিত ষ্টোরকিপারকে অন্যত্রে বদলী করে দেন। সরকার বারবার প্রজ্ঞাপন জারী করে কোন স্বাস্থ্য সহকারী (মাঠকর্মী) কে পদ পরিবর্তন করা যাবেনা। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আদেশ থাকার পরও সিভিল সার্জন ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ লঙ্ঘন করে ঘুষের বিনিময়ে সুলেমান আহমদকে অবৈধভাবে পদায়ন করেন। জেলা সদর হাসপাতালে যোগদানের কিছুদিন পরেই সুলেমান আহমদ গড়ে তুলেন তার দৃশ্যমান দুর্নীতির সিন্ডিকেট। হাসপাতালের রোগীদের খাবার সরবরাহ এবং এমএসআর সামগ্রী ক্রয়ের ঠিকাদার হিসেবে তিনি নিজেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শুরু থেকে। হাসপাতালের কিছু কিছু মূল্যবান দামী যন্ত্রপাতি,ঔষধপত্র ও আসবাবপত্র ক্রয় না করেই ঠিকাদারের সাথে জড়িত হয়ে ভূয়া স্টক এন্ট্রি দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন।
অফিসে বসার রুমের ষ্টিলের আলমারী থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে শত শত প্যাকেট ঔষধ প্রতিদিন তাহার আত্মীয় স্বজন ও প্রতিভূ লোকদেরকে ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই দিয়ে যাচ্ছেন। এমএস আর,পথ্য, কাপড় ধৌতকরন, ষ্টেশনারী ও বিবিধ সামগ্রী কার্যক্রম সংক্রান্ত যাবতীয় টেন্ডার ফাইল এর নথিপত্র এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন তিনি। আরো উল্লেখ্য যে আউটসোর্সিং এর ঠিকাদারের নিয়োগ এর সাথে জড়িত হয়ে তার নিজস্ব আত্মীয় স্বজন এবং এলাকার নিয়োগ প্রত্যাশী অনেককে মোটা অংকের টাকা নিয়ে নিয়োগ নিশ্চিত করেন তিনি। তার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে রাহেলা বেগম আয়া কে নিজের সামনে চেয়ার টেবিল দিয়ে বসিয়ে রাখেন তিনি। মো.তুহিন মিয়া ও মঞ্জুর আলম কে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ করত: বাড়তি সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিভূ এসব কর্মচারীদের দ্বারা হাসপাতালে তার ব্যক্তিগত চোরাই কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। হাসপাতালের দামী ঔষধ ও মূল্যবান জিনিসপত্র পাচারের সাথেও তিনি জড়িত আছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ৫/৬ জন যুবক লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে দায়েরকৃত অভিযোগটি জগন্নাথপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করলে সুলেমান আহমদ অভিযোগকারীদেরকে মোটা অংকের টাকায় বাধ্য বশীভূত করে অভিযোগের দায় থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন।
এদিকে জেলা সদর হাসপাতালের ২ কর্মচারীর শাস্তিমূলক বদলীর ব্যাপারে জানতে চেয়ে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক ডাঃ মোঃ আনিসুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও এ প্রতিবেদকের ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা যায়নি।
বদলী হওয়া ২ কর্মচারীর মুঠোফোনে কল করলে তারাও ফোন রিসিভ করা থেকে বিরত থাকেন।
অন্যদিকে অভিযোগকারী সাজিদুর রহমান বলেন,একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত ২ কর্মচারী ও তাদের গডফাদার আনিসুর রহমান বদলী ঠেকানোর জন্য বিভিন্নভাবে ঢাকায় তদবীর চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কীত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সুনামগঞ্জ ৫ আসনের এমপি জননেতা এম মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, বিএনপি সরকারের আমলে সুলেমান নামের এক কর্মচারী আমার নির্বাচনী এলাকায় ভূয়া ঠিকানা ব্যবহার করে চাকুরী নিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। এ ব্যাপারে সংসদীয় কমিটির কাছে অভিযোগ দায়ের করলে আমরা অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করবো। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি কোনদিকে মোড় নেয় সেদিকে দৃষ্টি এখন সকলের।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..