সিলেট ১৬ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২রা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৫ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৮:৫৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২, ২০২৩
ডেস্ক রিপোর্ট: সিলেটে সিএনজি অটোরিক্সা চালকরা যাত্রীদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। অটোরিক্সা চালকদের এমন নৈরাজ্যের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে যাত্রীরা। ঘর থেকে বের হলেই প্রয়োজন পড়ে যানবাহনের। নগরীর ভেতরে চলাচলের একমাত্র বাহন হচ্ছে অটো রিকশা ও সিএনজি। আর যাত্রীদের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চালকরা প্রতিদিন যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া বেশি নিচ্ছে।
আর এ বিষয় নিয়ে প্রতিদিন চালক ও যাত্রীদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক হচ্ছে। কথা বললেই চালকদের হাতে নাজেহাল হতে হয় যাত্রীদের। ভিন্ন স্থানে মারামারির ঘটনাও ঘটে। গত কয়েকদিন আগে তেমন এক ঘটনা ঘটে নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায়। প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব এক যাত্রীর সাথে ভাড়া নিয়ে অশোভনীয় আচরণের এক পর্যায়ে অটোচালক ওই যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। এতে যাত্রী আহত হয়। অটোরিক্সার নম্বর- ১১, ৫২৫৮।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, কোর্টপয়েন্ট এলাকায় প্রতিদিন এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। যাত্রীদের কাছ থেকে অযৌক্তিক ভাড়া দাবি করলে ওই যাত্রী তা দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তাই তার সাথে এমন আচরণ করে চালক। ২/৩ দিন আগে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে আম্বরখানা পয়েন্টে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। নগরীর রিকাবিবাজার, ওসমানী মেডিকেল কলেজ রোড, তালতলা, সুরমা পয়েন্ট, কামরান চত্ত্বরসহ নগরীতে সিএনজি চালকদের এমন দৌরাত্ম্য চলছে। তারা ১০টাকার ভাড়ার স্থলে ২০ টাকা আদায়ের অপচেষ্টা করেন। এরপর তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে অসহায় যাত্রীদের উপর চড়াও হচ্ছেন। অনেক সময় যাত্রীদের শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের মোবাইল টাকা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। আর হয়রানির ভয়ে যাত্রীরাও এসব ঘটনা চেপে যাচ্ছেন। এ ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে সিএনজি অটোরিক্সার নীতিমালা ও নির্দেশনা প্রয়োজন বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।
কোর্টপয়েন্টে অযথা হয়রানির শিকার হওয়া যাত্রীর সাথে আলাপকালে তিনি নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, চালকটি চরম বেয়াদব। অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করেছে। প্রতিবাদ করায় যাত্রীদের সাথে খারাপ আচরণ করে। তিনি এ ব্যাপারে আইনের আশ্রয় নিবেন কি না, বা চালকদের এ ধরনের আচরণের বিষয়টি তাদের কমিটিকে অবগত করবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতে কোন লাভ হয়না। কেবল হয়রানির শিকার হতে হয়।
এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এসব ব্যাপারে তাদের কাছে কেউ লিখিত কোন অভিযোগ করেনা। তাই তাদের কিছু করারও থাকেনা। লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ জাতীয় অপরাধ হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। কিন্তু তারাও অধিকাংশ সময়ে কুটনৈতিক জবাব দেন। অভিযোগ পেলে অবশ্যই দোষী চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়না বলেই মনে করেন ভুক্তভোগীরা। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সিলেট বিভাগের চার জেলায় কোন নীতিমালা ছাড়াই চলছে লক্ষাধিক সিএনজি অটোরিক্সা। চালকরা তাদের ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ ও আদায় করছেন। কোথায় কত ভাড়া, কিলোমিটার প্রতি ভাড়া, কতজন যাত্রী পরিবহন করা যাবে-এসব বিষয়ে নীতিমালা না থাকায় সিএনজি চালকরাই নির্ধারণ করে থাকেন।
এ ব্যাপারে বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিএনজি অটোরিক্সা শুধুমাত্র রিজার্ভে চলার অনুমোদন রয়েছে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রী আনা নেয়ার ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা নেই । সাধারণ মানুষের স্বার্থে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো সিলেটেও নীতিমালা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিআরটিএ সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিলেট নগরীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে যাত্রী আনা-নেয়ার কোন নিয়ম না থাকলেও প্রতিটি পয়েন্ট থেকে যাত্রী আনা নেয়া করছে সিএনজি চালকরা। প্রায় প্রতিটি মোড়ে অবৈধভাবে সিএনজি স্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। এসব স্ট্যান্ড থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রী আনা-নেয়া করা হচ্ছে। তারা নিজেরাই তাদের ভাড়া নির্ধারণ করছে এবং যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে। প্রতিটি স্ট্যান্ডের কমিটি যে ভাড়া নির্ধারণ করেছে, যাত্রীদের সেই ভাড়াই দিতে হয়। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পর ডিজেল চালিত গাড়ির সাথে সিএনজি চালিত অটোরিক্সার ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন চালকরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, সিএনজি চালকদের কাছে তারা অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। জালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর তেল চালিত বাসে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সিএনজি চালিত বাসের ভাড়া না বাড়লেও সিএনজি অটোরিক্সার ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন চালকরা। বিভিন্ন গন্তব্যে তারা ১০ থেকে ১৫ টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। নগরীর আম্বরখানা-টিলাগড়সহ বিভিন্ন রুটে সিএনজি অটোরিক্সায় ৩ জন করে যাত্রী পরিবহন করা হতো। তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়া আদায় করা হতো। বর্তমানে ৫ জন যাত্রী পরিবহন করেও জনপ্রতি ১৫ টাকা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে কথা বললে যাত্রীদের চালকদের হাতে হেনস্থা হতে হয়।
একাধিক ভুক্তভোগী ব্যক্তি জানান, সিএনজি চালকরা বিভিন্ন গন্তব্যে ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলে বলে স্ট্যান্ডের ম্যানেজারের সাথে কথা বলেন। বেড়েছে তেলের দাম ; কিন্তু সিএনজি চালিত অটোরিক্সার ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন চালকরা। এ ব্যাপারে সরকারের কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। ভাড়া নির্ধারণ ও আদায়ে নজরদারি না থাকায় যাত্রীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।
এ ব্যাপারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকুরীজীবীদের অনেকেই জানান, সিএনজি চালকদের নিকট যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। অনেক সময় তারা হুমকি-ধমকি দিয়ে কথা বলেন। এ অবস্থায় অসহায় যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে। অনেকে চালকদের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা সিএনজিচালিত অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাকারিয়া গণমাধ্যমে বলেন, মঙ্গলবারের বিষয়টি আমি জেনেছি। অবশ্যই এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সবাই এটা জানবেন।
বিচারহীনতার ব্যাপারে এ পরিবহন শ্রমিক নেতা বলেন, আসলে যেসব যাত্রী হয়রানির শিকার হন তারা আমাদের না জানানোর কারণে উশৃঙ্খল চালকদের আমরা শাস্তির আওতায় আনতে পারিনা। ঘটনার সাথে সাথে আমাদের জানালে আমরা অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। জাকারিয়া ভুক্তভোগীদের তার মোবাইল ০১৭১৩৫২১১৫১ নম্বরে যোগাযোগ করতে বা অভিযোগ জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, সিএনজি অটোরিক্সা শুধুমাত্র রিজার্ভে চলাচলের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে যাত্রী আনা নেয়ার কোন অনুমোদন নেই। যাত্রী ও চালক নিজেদের মধ্যে ভাড়া নির্ধারণ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাবেন। সিলেট বিভাগের চার জেলায় রেজিস্ট্রেশন ও রেজিস্ট্রেশন ছাড়া প্রায় লক্ষাধিক সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সিএনজি অটোরিকশার হিসাব থাকলেও রেজিস্ট্রেশনবিহীন অটোরিকশার কোন সংখ্যা বিআরটিএর নিকট নেই। তবে রেজিস্ট্রেশন বিহীন অটোরিক্সার সংখ্যা রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সংখ্যার চেয়ে বেশি বলে মন্তব্য করেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। সিলেটে রেজিস্ট্রেশন ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন অটোরিকশা রয়েছে ৪৪-৫০ হাজার, মৌলভীবাজারে ৩৩-৩৫ হাজার, সুনামগঞ্জে ১৩-১৫ হাজার এবং হবিগঞ্জে ১৬ থেকে ২০ হাজার অটোরিক্সা চলাচল করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে বিআরটিএ সিলেটের সহকারী পরিচালক গণমাধ্যমকে বলেন, যেহেতু সিএনজি অটোরিক্সার শুধুমাত্র রিজার্ভে চলাচল করার নিয়ম; তাই বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি আসেনি। কিলোমিটার প্রতি ভাড়া নির্ধারণ, মিটার স্থাপন, খাচা নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে উল্লেখ করে করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিএনজির নীতিমালা করা হয়েছে। কিন্তু, সিলেটে এখনো কোন নীতিমালা করা হয়নি। তাই সিএনজি চালকরা নিজেরাই তাদের ভাড়া নির্ধারণ করে। সিলেটে সিএনজি অটেরিক্সার ব্যবহার ব্যাপক ভাবে বেড়েছে। তাই এর ভাড়া নির্ধারণে নীতিমালা করা প্রয়োজন। নীতিমালা না থাকায় তাদের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। তারা মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন; কিন্তু তখন চালকরা বলেন তারা রিজার্ভ যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, যাত্রীদের হয়রানি কমাতে তিনি বিষয়টি নিয়ে বিআরটিএ এর সাথে কথা বলে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd