সিলেট ১২ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৬ই মহর্রম, ১৪৪৭ হিজরি
প্রকাশিত: ৬:৪৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২২
মো. রেজাউল হক ডালিম :: নির্মাণ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে গুণে ও মানে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত সিলেটের পাথর কোয়ারির পাথর। প্রাকৃতিগতভাবেই পাহাড় থেকে লাখ লাখ টন পাথর নেমে এসে কোয়ারি অঞ্চলগুলোতে সঞ্চিত হতে থাকে। এসব কোয়ারি থেকে উত্তোলন করা পাথর দশকের পর দশক ধরে দেশের নির্মাণ শিল্পে যোগান দিয়ে আসছেন শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। এসব কাজে জড়িয়ে রয়েছেন অন্তত ১০ লাখ মানুষ।
তবে গত ছয় মাস ধরে পাথর কোয়ারিগুলোর পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে পাথর উত্তোলন, বিপণন ও পরিবহনখাতে জড়িত পাঁচ উপজেলার ১০ লাখের বেশি মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। বেকার হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পাথর ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া বেশিরভাগ ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেটের স্থানীয় অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তির অন্যতম পাথর কোয়ারিগুলো। এখানকার পাথর গুণে মানে উন্নত ও সেরা হওয়ায় কাঁচামাল হিসেবে নির্মাণখাতে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (শাবিপ্রবি) দেশের সব প্রকৌশল সংস্থার মান নির্ধারণে সিলেটের পাথর গুণগতমানে এশিয়া মাহাদেশে শ্রেষ্ঠ মনোনীত হয়েছে। নির্মাণখাতে এই পাথর ব্যবহার করলে অবকাঠামো সবেচেয়ে বেশি মজবুত ও স্থায়িত্ব অর্জন করে। এমন সর্বজন স্বীকৃতির কারণে সিলেটের পাথরের চাহিদা যেমন বেড়ে যায় তেমনি উত্তোলনেও বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন সংশ্লিষ্টরা।
পাহাড়ের খরস্রোতা নদীর ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে প্রাকৃতিকগতভাবেই প্রতিবছর উজান থেকে লাখ লাখ টন পাথর নেমে আসে। এসব পাথর সঞ্চিত হতে থাকে কোয়ারিগুলোতে। তবে গুণে মানে উন্নত হওয়ায় ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অপরিকল্পিতভাবে যন্ত্রের সাহায্যে পাথর উত্তোলন বেড়ে যায় গেল কয়েক বছর ধরে। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছনাকান্দির পরিবেশ। এমনকি, এরই মধ্যে গোয়াইনঘাট উপজেলার নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জাফলংকে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে শুধু পরিবেশের ক্ষতিই নয়, কোয়ারিগুলো থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাথর তুলতে গিয়ে নিয়মিতই ঘটে যাচ্ছিল দুর্ঘটনা। যাতে প্রাণহানি বাড়ছিল। সূত্রমতে, বিগত চার বছরে কোয়ারিগুলোতে অন্তত ৮০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত।
তবে এমন নির্দেশনা উপেক্ষা করে ব্যবসায়ীরা বোমা মেশিন ব্যবহার করে পাথর উত্তোলন করতেন। প্রশাসনের অভিযানে নিয়মিত এ রকম যন্ত্র জব্দ করা হতো। এরপর প্রাণ ও পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের পাঁচটি কোয়ারি অঞ্চল জাফলং, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি ও লোভছড়া থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। যদিও ২০১৭ সালে কিছুদিন ও গত বছরের শুরুর দিকে এসব কোয়ারির মধ্যে জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছনাকান্দিতে পাথর উত্তোলনের অনুমতি দেন উচ্চ আদালত।
পৃথক দুটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৫ জানুয়ারি জাফলং, বিছানাকান্দি ও ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা ছয় মাসের জন্য স্থগিতের আদেশ দেন বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। আদেশে কোনো যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া সনাতন পদ্ধতিতে ও জাফলংয়ের পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) বাইরে থেকে পাথর উত্তোলন করতে বলা হয়। এতে কোয়ারিগুলোতে কার্যত পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত পাথর আহরণ ও বিপণন হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়ায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৫ উপজেলা- কোম্পানীগঞ্জ, জাফলং, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও ছাতকের বৃহৎ জনগোষ্ঠী অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হন। পাশাপাশি পাথর বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, স্টোন ক্র্যাশার, মিল মালিক, পাথর ব্যবসায়ী, ট্রাক-ট্রাক্টর শ্রমিক, বার্জ, কার্গো, নৌকামালিক শ্রমিক, পরিবার পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় সিলেটের পাথর উত্তোলন সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তারা এখন ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখে। বেকার হয়ে পড়া মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সর্বশেষ গত বছর যে তিনটি কোয়ারি ছয় মাসের জন্য যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া সনাতন পদ্ধতিতে উত্তোলনের শর্তে খুলে দেন হাইকোর্ট, জেলা প্রশাসনের বাধায় সে সময় তেমন পাথর উত্তোলন করতে পারেননি শ্রমিকরা। এ অবস্থায় কোয়ারিগুলো খুলে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়ে মিছিল-মিটিং, আবেদন-নিবেদন, সংবাদ সম্মেলনসহ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন পাথর সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গত ছয় বছর ধরে পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায়র কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। আবার দেশীয় উন্নতমানের প্রাকৃতিক সম্পদ রেখে বেশি টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে পাথর আমদানি করে নির্মাণ, স্থাপনা ও মেরামত কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় অভিযোগ উঠেছে, দেশে উন্নতমানের পাথর রেখে রাষ্ট্রীয় রিজার্ভের মুদ্রা অপচয় করে নিম্নমানের পাথর আমদানির নামে দেশির মুদ্রা পাচার করা হচ্ছে। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবেশসম্মতভাবে পাথর আহরণের সুযোগ করে দেওয়ার জোর দাবি পাথর সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সনাতন পদ্ধতিতে পাথর আহরণের শর্তে কোয়ারিগুলো খুলে দেওয়ার জন্য কিছুদিন আগে সিলেট জেলা প্রশাসক বরাবর ডিও লেটার দিয়েছেন সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয় মন্ত্রী ইমরান আহমদ। তবে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও সিলেট জেলা ট্রাক মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম হাদী ছয়ফুল বলেন, সম্প্রতি কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। তবে সে আদেশ বাস্তবায়িত হচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসনের অসহযোগিতায়। তিনি বলেন, মূলত পরিবেশ রক্ষার অজুহাতে একটি চক্রের ইন্ধনেই দেশীয় এ সম্পদ আহরণ বন্ধ রেখে নিম্নমানের বিদেশি পাথর আমদানি করা হচ্ছে। আমরা পাথর উত্তোলনের জন্য দাবি-দাওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি। এ বিষয়ে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি আমরা।
পাথর কোয়ারির বিষয়ে নতুন কোনো নির্দেশনা নেই উল্লেখ করে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, মন্ত্রী মহোদয়ের সুপারিশের বিষয়ে কিছু জানা নেই। আর এ বিষয়ে নতুন কোনো নির্দেশনাও আসেনি। খুলে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা এলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। পাশাপাশি পরিবেশ বিনষ্টকারী যন্ত্র যাতে ব্যবহার না হয় সেদিকে নজরদারি রাখা হবে।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd